ফিচার I চেনা খাবারে অচেনা ভয়
অতি পরিচিত খাবারই অনেক সময় হয়ে ওঠে অসুস্থতার কারণ। এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে
এমন কিছু খাবার আছে, যেগুলোর মধ্যে বিষ বাইরে থেকে নয়, বরং প্রাকৃতিকভাবেই আসে। মানুষ হরহামেশাই সেগুলো খায়। দীর্ঘ মেয়াদে গিয়ে আক্রান্ত হয়। কেউ হয়তো উচ্চ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা থাকায় বেঁচে যায়। এমন মারণবিষ থাকতে পারে সবজি, ফলমূল কিংবা আমিষে। অনেক সময় প্রক্রিয়াজাত কিংবা বাছাই করে সেসব বিক্রি হয় বলে বিষক্রিয়া থাকে না। এসব খাবারের কিছু কিছু ভিনদেশি, কয়েকটি আবার সুপরিচিত। যেমন আলু।
কিছু আলুর গায়ে সবুজ দাগ দেখা যায়। সেগুলোতে সোলানাইন থাকে; যা বেশ বিষাক্ত। রান্না, এমনকি পোড়ালেও তা দূর হয় না। অনেকে আলু কিনে বাসায় মজুত করেন। ফলে গ্যাজ জন্মায়। তাতে গ্লাইকো অ্যালকালয়েড নামের বিষাক্ত পদার্থ থাকে। আলোর সংস্পর্শে এলে এই উপাদান আরও বাড়ে। সবুজ দাগওয়ালা এবং গ্যাজ হওয়া আলু খেলে ডায়রিয়া ও মাথাব্যথা হতে পারে। কোমায় চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। মৃত্যুও হয়। গ্লাইকো অ্যালকালয়েড থাকতে পারে টমেটোতেও। বিশেষ করে কাঁচা অবস্থায়। তবে তা অল্প খেলে খুব একটা ক্ষতি হয় না।
সবজিতে পাওয়া যায় এমন আরেকটি বিষের নাম ফাইটোহিমাটোগ্লুটানিন। থাকতে পারে শিমের বীজে। এ জন্য তা রান্নার আগে ন্যূনতম ১০ মিনিট সেদ্ধ করা ভালো। তাতে বিষ দূর হয়। অন্যথায় বিপদ।
কাসাভা নামের একধরনের রূপান্তরিত কা- জন্মানো হয়। ব্রাজিলে সহজলভ্য। এটি মূলত আলুজাত। খাবারটিতে থাকে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সায়ানাইড। ভালোভাবে রান্না না করে খেলে মৃত্যুমুখে পড়তে হয়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের জরিপ অনুযায়ী, কাসাভার বিষে আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন মারা যায়।
সবজি ছাড়া ফলমূলেও আছে বিষ। যেমন আপেল। এর মাংসল অংশে না হলেও বীজে থাকে হাইড্রোজেন সায়ানাইড। কোনো কারণে আপেলের বীজ বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেললেই বিপদ। তাই এ ফলের জুস তৈরির সময় বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়। বীজ যেন না থাকে। জ্যামাইকার আকি আপেল তো আরও বিষময়। বিশেষ করে কাঁচা অবস্থায়। তখন তাতে হাইপোগ্লাইসিন থাকে, যা এক প্রকার বিষ। তবে পাকলে ফলের মাংসল অংশ নিরাপদ। তখন বিষ চলে যায় বীজে। তা শরীরে গেলে বমি হয়। অতিমাত্রায় গ্রহণে মৃত্যু ঘটতে পারে।
কিডনি সমস্যায় যারা ভুগছেন, তাদের জন্য কামরাঙা বিপজ্জনক। এতে নিউরোটক্সিন থাকে, যা নীরবে কিডনির ক্ষতি করে। বিদেশি ফল এলডার বেরিও বিষাক্ত। কাঁচা অবস্থায় খেলে মৃত্যু অবধারিত। পাকলে ঠিকমতো রান্না করতে না পারলে আশঙ্কা কাটে না। এই ফলে সায়ানাইড মিশে থাকে। কোনোভাবে পেটে গেলেই সর্বনাশ। সরাসরি চাক থেকে সংগৃহীত মধু পানেও চাই সতর্কতা। এতে থাকে গ্রায়ানোক্সিন, যা বিষাক্ত। এ উপাদানযুক্ত মধু এক টেবিল চামচ পান করলে মাথাঘোরা, দুর্বল লাগা ও বমির উপসর্গ দেখা দেয়। তেতো কাজুবাদামেও আছে ভীতি। এতে প্রচুর হাইড্রোজেন সায়ানাইড থাকে। এ রকম দশটি বাদাম খেলেই বড়রা অসুস্থতায় পড়তে পারে। ছোটরা মৃত্যুমুখে। এর বিষক্রিয়ার কথা ভেবে নিউজিল্যান্ড ও আমেরিকায় তা বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্রাজিলীয় বাদামেও আছে বিষ। সেলেনিয়াম। যা আমাদের শরীরকে সহজেই বিষিয়ে তুলতে পারে। তবে তিনটির বেশি না খেলে বিপদ এড়ানো যায়।
চেরি ফলের সঙ্গে কমবেশি পরিচয় আছে সবারই। এর বীজ চুষলে হাইড্রোজেন সায়ানাইড উৎপন্ন হয়, যা ভয়ংকর বিষ। তাই এই ফলবীজ ফেলে খাওয়া ভালো। ক্যাস্টর তথা রেড়ির বীজও বিষাক্ত। যারা তা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত, তারাও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকেন। সংগ্রহকারীদের মধ্যে প্রায়শই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কথিত আছে, রেড়ির একটি বীজের বিষ একজন মানুষ ও চারটি ঘোড়াকে মেরে ফেলতে সক্ষম। তবে ক্যাস্টর অয়েল প্রক্রিয়াজাত হয়ে আসে বলে রক্ষা।
প্রাণিজ আমিষেও মিশে থাকে ভয়ংকর সব বিষাক্ত উপাদান। জাপানের ফুগু মাছের কথাই ধরা যাক। এতে টেট্রোডোটক্সিন থাকে, যা প্রাণঘাতী। এ জন্য অভিজ্ঞ শেফ ছাড়া এ মাছের পদ তৈরি করতে দেওয়া হয় না। সেসব রসুইকরের থাকে তিন বছরের প্রশিক্ষণ। তবু ফুগু মাছ খেয়ে বছরে ১০০ জনের মৃত্যু হয় বলে বিশ্বপরিসংখ্যান আছে। কোরিয়ান অক্টোপাসেও বিষ থাকে। বিষাক্ত এই প্রাণীর নাম সান-নাকজি। খাদ্যোপযোগী করার আগে এর পাগুলো ফেলে দেওয়া হয়। আহারীদের বলা হয় সাবধানে খেতে। ‘আমানিতা ফ্যালোয়ডেস’ নামের এক প্রকার মাশরুমও বিষভর্তি। বিষের প্রাচুর্যতার কারণে এটিকে অনেকে ‘মৃত্যু ছত্রাক’ বলে। ঠিকমতো রান্না না করলে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে। মৃত্যু না হলেও কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হয়।
কাসু মারসু চিজকে ইতালিতে পচা পনির বলে। সার্ডিয়ান ভেড়ার দুধ থেকে তৈরি পদটি খোলা স্থানে রেখে দেওয়া হয়, যেন তাতে মাছি এসে ডিম পাড়তে পারে। ডিমগুলোই পনিরকে ফার্মান্টেশন করে। তা থেকে লার্ভা বের হয়, যা পনিরের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে। সেটিই মানুষ খায়। এতে অনেক সময় জীবিত লার্ভা মানুষের অন্ত্রে প্রবেশ করে। ফলে ডায়রিয়া হয়। বর্তমানে কাসু মারসু চিজ উৎপাদন নিষিদ্ধ।
এসব ছাড়া আরও কিছু খাবার আছে, যা আমরা খাই, কিন্তু সেগুলোর উল্টো দিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই। যেমন জায়ফল। এতে মাইরিস্টিসিন থাকে। কোনো পদে তা অতিরিক্ত ব্যবহার করলে বমি, ঘাম ঝরা, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, এমনকি হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
আমাদের দেশে না খেলেও গ্রিনল্যান্ডে হাঙর খাওয়া হয়। সে দেশে এক প্রকার হাঙর আছে, যেগুলোর মূত্রাশয় ও কিডনি থাকে না। ফলে বর্জ্য পদার্থগুলো প্রাণীটির শরীরেই জমা থাকে। এ ধরনের হাঙর দিয়ে হাকার্ল নামের একধরনের পদ তৈরি হয়। মানুষ তা স্বেচ্ছায় খায়। ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
নামিবিয়ায় ‘বুলফ্রগ’ খাওয়ার চল আছে। প্রাণীটির শরীরে অশিকেটাকাটা নামের বিষ থাকে। এর ক্রিয়ায় সাময়িক কিডনি ফেইলিওর হতে পারে। মৃত্যুও হয়।
‘ব্লাড ক্লামজ’ বা ‘রক্ত ঝিনুক’ খেলেও বিপদ হতে পারে। এ প্রাণী মূলত হিমোগ্লোবিনের আধার। তাই মানুষ এটি খায়। কিন্তু এতে একধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে; যা আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ‘এ’সহ নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে।
খাবারের এসব বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে অচেনা খাবার খাওয়ার সময় যাচাই-বাছাই করে নেওয়াই ভালো। সন্দেহজনক খাদ্য এড়িয়ে গেলে বিপদমুক্ত থাকা যেতে পারে। যেসব খাবার না খেলেই নয়, তা সঠিক প্রক্রিয়ায় রান্না করে খেলে হয়তো নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।
❙ ফুড ডেস্ক