skip to Main Content

রসনাবিলাস I রসে-বশে-স্টেকে!

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের খাবারে সমৃদ্ধ এর মেনু। ইন্টেরিয়র নজরকাড়া। বসার আয়োজন আরামদায়ক। তবে স্টেক প্রধান আকর্ষণ। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

তখন দুপুর। শরীরে শর্করা ও পানির ঘাটতি টের পাওয়া যাচ্ছে। বাইরে তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু অনুভূত হচ্ছে ৪৯ ডিগ্রি। ঠান্ডা পানীয় এবং দুদন্ড শীতলতার প্রয়োজনেই ঢুকে পড়লাম বনানীর অভিজাত রেস্টুরেন্টের কাতারে সদ্য নাম লেখানো ভিলা আযুর-এ।
প্রবেশপথেই কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সতর্কতাহেতু কড়া নজরদারি। শরীরের তাপমাত্রা নেওয়া হলো, হাতে দেওয়া হলো স্যানিটাইজার। এরপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। দেয়ালচিত্রে রুচির ছাপ স্পষ্ট, পদ্মফুল। তেতলায় উঠতেই চোখে এসে ধাক্কা দিল একরাশ আলো। কাচের দরজার ওপার থেকে। সিঁড়িঘরের নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে ভিলা আযুর। পেছনে কৃত্রিম প্রকৃতি।
দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই হাতের বামে রিসেপশনে স্বাগত জানালেন ব্যবস্থাপক জিয়া রহমান। বললেন রেস্টুরেন্টের আদ্যোপান্ত নিয়ে। অনানুষ্ঠানিকভাবে এটি চালু হয়েছে জানুয়ারিতে। মার্চে পুরোপুরি খুলে দেওয়ার পরপরই করোনার প্রাদুর্ভাবে বন্ধ করতে হয় কারবার। তবে জুলাই থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবার চালু হয়েছে এই ভোজনশালা। জানা গেল, খাবার খেয়ে উঠে যাওয়ার পর প্রতিটি টেবিল-চেয়ার পরিষ্কার করা হয় পরবর্তী গ্রাহকদের জন্য।
ইন্টেরিয়র সাজানো হয়েছে সাদার প্রাধান্য দিয়ে। সাদা দেয়াল, পায়ের তলায় মর্মর পাথর, টেবিলগুলোও পাথুরে। ফলস সিলিংও সাদা। স্পট লাইটের ব্যবহারে মোলায়েম হলদেটে-সাদা আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ে রেস্টুরেন্ট জুড়ে। মাথার ওপরে রয়েছে আয়না। ইন্টেরিয়রের সঙ্গে বৈপরীত্য এনেছে চেয়ারের ঝলমলে রঙের কভার, সোফা, কয়েকটি কালো পাথরের টেবিল আর দেয়ালে ঝোলানো শিল্পকর্ম। একদম বামের শেষ প্রান্তে রয়েছে অন্যদের থেকে আড়াল করে বসার সুবিধে। অন্দরসজ্জা গত শতকের শুরুর প্রথম যুগের লাউঞ্জ কালচারের নস্টালজিয়ায় ভোগাতে পারে অনেককেই। মাঝখানে বিশালাকৃতির একখানা কৃত্রিম গাছ চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করেছে।
বেশ বড় একটি ব্যালকনি রয়েছে প্রবেশদ্বারের ডানে। অভ্যাস থাকলে তামাকে অগ্নিসংযোগ করে সেখানে বসে থাকা যায় এক কাপ কফি নিয়ে। এখানকার চেয়ার-টেবিল সবই বেতের। দেয়ালের এক পাশে রয়েছে একগাদা অর্কিড, অন্য পাশে ফার্ন। মাঝে রাখা হয়েছে অ্যারাবিয়ান ওয়াক্স, ক্রাউন অব থ্রোন (কাঁটা মুকুট) আর উইপিং ফিগের গাছ। একসঙ্গে ৮০ জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে রেস্টুরেন্টটিতে।
কথা বলতে বলতেই সহকারী পাচক নিয়ে গেলেন মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। এ ব্যাপারে এখানকার দুটো জিনিসের সুনাম আছে। প্রথমত স্টেক আর দ্বিতীয়ত সি ফুড। আলা কার্তে এবং তাবল দ্যোৎ- দু ধরনেরই খাবার রয়েছে। আলা কার্তে থেকে সবচেয়ে স্বাদু আর জ্যুসি একখানা স্টেক দিতে বললাম। আর তাবল দ্যোৎ থেকে গ্রিলড ফিশ। তিনি জানতে চাইলেন কেমন হবে স্টেকখানা? মিডিয়াম বলতেই তিনি চলে গেলেন হেঁসেলে।
বেশ লম্বা একটা বিরতি এরপর। স্টেক তৈরি সময়ের ব্যাপার। এর ভেতরেই কিচেনটা দেখে এলাম। শেফ ব্যস্ত চুলোয়, তার সহকারীরা কলাটা-মুলাটা কেটেকুটে এগিয়ে দিচ্ছে, কেউ বানাচ্ছেন সস। দেখতেও সুখ! পুরো কিচেন বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সবারই মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক।
প্রথমে এলো গ্রিলড ফিশ। ব্যাটারে ভাজা চার টুকরো বাসা ফিলে এর মূল আকর্ষণ। সঙ্গে সতে করা ভেজিটেবল, একগাদা গ্রিন স্যালাড আর ঝরঝরে ফ্রাইড রাইস। সঙ্গে তাবাস্কো সস আর স্পাইসি লেমন-বাটার সস। শেফ জানিয়ে দিলেন এই সসের সিক্রেট। বাটার, লেমন জুস, লবণ আর কাশ্মীরি লঙ্কার মিশ্রণ। অতি সাধারণ এসব উপকরণেই তৈরি হয় বাসা ফিলের জন্য পারফেক্ট ট্যাঞ্জি-বাটারি এই সস।
এরপর এলো রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় উপাদান- স্টেক! ধরন বেছে দেওয়ার ভার ছেড়ে দিয়েছিলাম কিচেনের কর্তার হাতে। তিনি নিয়ে এলেন টমাহক স্টেক! আধা কেজির বেশি এক টুকরো বুকের হাড়সমেত মাংস। অনেকটা হাতলের মতো বা কুঠারাকৃতির হাড়টি মাংসের চেয়ে বড়। এ থেকেই এই রিব-আই স্টেকের নাম টমাহক। নেটিভ আমেরিকানদের ব্যবহৃত কুঠারের নামে। অন্যান্য ব্রিটিশ রিব আই স্টেক বা আমেরিকান কাউবয় কাট স্টেকের সঙ্গে টমাহকের পার্থক্য এর ফ্রেঞ্চ করা হাড়ে। তার মানে হাড়ের বাড়তি অংশের সব চর্বি, টিস্যু পরিষ্কার করে ফেলা। বিশাল টমাহকের সঙ্গে স্টেক সস ও মাশরুম সস, সতে করা সবজি, গ্রিন স্যালাড আর ম্যাশ পটেটো।
খাবারের ঘ্রাণে পরিবেশ সুরভিত। আমি কাঁটা আর ছুরি নিয়ে হাত চালালাম স্টেকের মাঝ বরাবর। উদ্দেশ্য কতটা পারফেক্ট মিডিয়াম করলেন শেফ, সেটা দেখা। প্রায় দেড় ইঞ্চি মোটা মাংস যেন মাখনে পরিণত হয়েছে, ছুরি-কাঁটা কোথাও আটকে গেল না। একটি টুকরো কাঁটায় গেঁথে নিলে দেখা গেল, মাংসে তিনটি স্তরের সৃষ্টি হয়েছে। উপরে-নিচে বাদামি আর মধ্যখানে গোলাপি। একদম কাঁটায় কাঁটায় ১৪৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না পৌঁছালে এ মাংসের গায়ে এমন হওয়া সম্ভব নয়। আবার ১৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে গেলে পুরোটাই হালকা বাদামি হয়ে যাবে। সেটা মিডিয়াম ওয়েল। তবে মিডিয়াম রেয়ার থেকে মিডিয়াম ওয়েল স্টেক খাওয়াই ভালো। এতে সঙ্গে দেওয়া হার্বস আর মাংসের স্বাদ পুরোটাই পারফেক্টলি পাওয়া যায়। তবে বাঙালি স্বাদেন্দ্রিয়ের জন্য মিডিয়াম ওয়েল আর ওয়েল খাওয়াই শ্রেয়। আমার সামনে ছিল পারফেক্টলি মিডিয়াম স্টেক। খেলাম, ফ্রেশ হার্বস আর মাংসের কম্বিনেশন অসাধারণ ছিল। জুসি মাংস, সঙ্গে স্টেকের ডিপ সস, মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নেওয়ার জন্য বেদানার শরবত। ক্রিমি ম্যাশ পটেটো আর সতে করা নোনতা ভেজিসও চলছিল এগুলোর মধ্যে।
শেষে আরেক দফা কফি। কর্ণধারদের একজন জাফর ইকবাল জানালেন, বাইরের দেশে গিয়ে সেখানকার রেস্টুরেন্ট ইন্টেরিয়র, ফুড থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে এখানকার আইডিয়া এসেছে। ইন্টেরিয়রে পুব আর পশ্চিমের মিশেল, তেমনি খাবারের বৈচিত্র্যেও কন্টিনেন্টাল ও এশিয়ান পদ রাখা হয়েছে। এখানে মূলত উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা আসে। তরুণদের সমাগম তো হয়ই। প্রোপার রেস্টুরেন্ট হিসেবে এখানে কেবল খাবার নয়, আরাম করে যেন মানুষ কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে।
মেনুতে আরও আছে ব্রুশেতা, টাপাস, স্যুপ, স্যালাড, পিৎজা, পাস্তা, থাই ফুড, গরম ও ঠান্ডা পানীয়। তবে এগুলোকে ছাপিয়ে অবশ্যই অষ্টপদী স্টেক, সপ্তপদী মাছ আর ষষ্ঠপদী কুক্কুটের পাতার দিকেই সবার নজর যায় আগে।
ঠিকানা: ভিলা আযুর, বাড়ি ৬১, সড়ক ১৫, ব্লক-ডি, বনানী, ঢাকা ১২১৩
ফেসবুক:www.facebook.com/VillaAzzur/

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top