ফিচার I খাদ্যের নৈবেদ্য
খাবার পূজার প্রধান একটি অনুষঙ্গ। কিন্তু কোন পদে দেবদেবীদের তুষ্ট করতে হয়? লিখেছেন শিবলী আহমেদ
পৃথিবীকে ধরে রেখেছেন বিষ্ণু দেব। তিনি শুয়ে আছেন দুধের সাগরে, ক্ষীরের ওপর। বেদে দুধকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর থেকে উৎপন্ন ঘি যজ্ঞে ব্যবহৃত হয়।
দেবতাদের নৈবেদ্যেও দুধের উপস্থিতি। এমনকি ভূদেবী রূপকী অর্থে গরুর সঙ্গে তুলনীয়। গৌড়ী রূপে সেই দেবী দুধ দান এবং কালী রূপে রক্ত পান করে জীবনবৃত্তকে পরিপূর্ণ করেন।
দেবতাভেদে নিবেদন করা হয় দুধের বিভিন্ন পদ। যেমন শিবকে কাঁচা দুধে তুষ্ট করতে চান পূজারিরা। বিষ্ণুকে দেওয়া হয় মাখন অথবা ঘি। নৈবেদ্যর এমন পার্থক্যের কারণ হচ্ছে, শিব গৃহত্যাগী দেবতা। গৃহছুট একজনের পক্ষে দুধ থেকে মাখন কিংবা ঘি তৈরির ফুরসত নেই। তাই কাঁচা দুধই তার উপযোগী পানীয়। সহজলভ্যও। অন্যদিকে বিষ্ণু হচ্ছেন গৃহীদেবতা। তার কাছে দুধ প্রক্রিয়া করার অবসর ও সুযোগ আছে। তাই তিনি মাখন ও ঘি খান। অন্নকুট উৎসবে শ্রীকৃষ্ণকে ৫৬ প্রকার ভোগ দেওয়া হয়। গৃহীদেবতা হওয়ার ফলেই এত আয়োজন।
দেবতাদের নৈবেদ্যে থাকে ফলও। কাঁচা ও পাকা। দেবদেবীভেদে পূজায় দেওয়া ফলও ভিন্ন। দেবীদের বেলায় সেগুলো মূলত টক। যেমন লক্ষ্মীকে আমলকী দেন ভক্তরা। বিষ্ণুদেবের জন্য বরাদ্দ মিষ্টি ফল। শিব ঠাকুরকে শুকানোগুলো। তবে নৈবেদ্যে ভক্তরা যা-ই খেতে দিন না কেন, প্রায় প্রতি দেব-দেবতারই আছে পছন্দের কিছু খাবার। যেমন শিবপত্নী দুর্গার প্রিয় খাবার খিচুড়ি ও ক্ষীর। তাই পূজার নৈবেদ্যতে ফল ও মিষ্টির পাশাপাশি থাকে এই রসনাজোড়া। এ ছাড়া দেবীর পছন্দের তালিকায় আছে ঘি, সুপারি, এলাচি ও লবঙ্গ। পান-সুপারি মূলত সুখী গৃহস্থের প্রতীক রূপে দেখা হয়। অকৃতদার দেবতার নৈবেদ্যে পান-সুপারি দেওয়া হয় না। কিছু পৌরাণিক চিত্রে দেখা যায় লক্ষ্মী বিষ্ণুকে পান দিচ্ছেন। এই পাতা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্য আনন্দ, বিলাসিতা ও সুখ-সাফল্যের বাহক। দুর্গার পছন্দের খাবারের সঙ্গে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কিছু বিশ্বাস ও আচার যুক্ত। যেমন নৈবেদ্যর ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বালালে ঘরে অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে পারে না। এই ঘি খাওয়া বারণ। শুধু জ্বালানি হিসেবেই তা ব্যবহার্য। দেবীকে দেওয়া সুপারিগুলোর একটি নিজের সঙ্গে রাখলে পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত ফল আসে। কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়া যায়। তা ছাড়া উন্নতির পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নৈবেদ্যর এলাচি চায়ে মিশিয়ে পান করলে শরীরে শুভশক্তি সঞ্চার হয়। লবঙ্গগুলোও একই কাজ করে। এদিকে দুর্গাপতি শিব ঠাকুর পছন্দ করেন দুধ। তাতে ভাং বা কেশর মিশিয়ে পরিবেশন করলে তিনি আরও তুষ্ট হন। ফলে যাপনে আসে সুখ। মন্দের প্রভাব কাটে।
নারায়ণদেবের পছন্দের খাবারগুলো হলদে। তাই ডাল, হলুদ লাড্ডু ও গুড় দিয়ে তার আরাধনা করেন ভক্তরা। পূজা চলে বৃহস্পতিবার। হলদে খাবারযোগে তার স্তুতি করলে কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়া যায় বলে বিশ্বাস পূজারিদের। এ ছাড়া সব ক্ষেত্রেই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। মনের ইচ্ছা পূরণ হতে থাকে। নারায়ণের একটি অবতার শ্রীকৃষ্ণ। তিনি পছন্দ করেন মাখন। তাকে তুষ্ট করতে সামান্য চিনিযোগে মাখন নিবেদন করে প্রার্থনাকারীরা। কৃষ্ণের মাখনপ্রীতি এতই তুঙ্গে যে তিনি ‘মাখন চোর’ নামেও পরিচিত। জন্মাষ্টমীতে এখনো বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষ্ণের চুরির অনুকরণ করতে মাখনের হাঁড়িটি উঁচুতে বেঁধে তা ভাঙার প্রচলন আছে। কিন্তু এর কিছু প্রতীকী ব্যাখ্যাও রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ সব সময় সাদা হৃদয় চুরি করতেন। সেটিকেই মাখনের প্রতীকে তুলে ধরা হয়েছে। অন্য ব্যাখ্যায় এসেছে, এই চুরির মূলবার্তা হচ্ছে, আমাদের মনকেও মাখনের মতো কোমল হতে হবে।
দেবতাদের মধ্যে মিষ্টিপ্রীতি রয়েছে গণেশ ঠাকুরের। বিশেষ করে মোদক। ময়দা, গুড় ও নারকেলযোগে তৈরি হয় পদটি। লাড্ডুতেও তুষ্ট তিনি। শ্রী হনুমানের প্রিয় ডাল ও গুড়। শনিদেব আগ্রহ তিল বীজ, ডাল ও সরিষার তেলে। তবে গুড়ের তৈরি তিলের লাড্ডুর প্রতিও তার ঝোঁক আছে। এসব নৈবেদ্য দিলে শনির আক্রোশ থেকে ভক্তরা রেহাই পান।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে লক্ষ্মীর আরাধনা করলে পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। তবে সে জন্য তার মন জয় করা চাই। দুর্গার মতোই লক্ষ্মীর পছন্দ ক্ষীর। সঙ্গে ভাতের যেকোনো পদ। যেন অলক্ষ্মী প্রবেশ না করে, সে উদ্দেশ্যে একটি লেবু ও সাতটি মরিচ ঘরে ঝুলিয়ে রাখার চল মানেন গৃহস্থেরা। পাশাপাশি লক্ষ্মীর আগমনের আশায় মিষ্টি ভোগ দেয় মুম্বাইয়ের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সরস্বতীর পছন্দের খাবার খিচুড়ি। বিদ্যাপীঠগুলোতে এ দেবীর আরাধনার দিনে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় পদটি। এতে পরীক্ষার ফল ভালো হয়, কর্মক্ষেত্রে উন্নতি আসে। এদিকে কালীর পছন্দের খাবার ক্ষীর। সঙ্গে ভাতের যেকোনো পদ। বিষ্ণুর পছন্দ চানা ডাল, কলা ও মনেক্কা।
দেবদেবীরা যে কেবল খেয়েই যান, তা কিন্তু নয়। অন্যকে রেঁধে খাইয়ে তুষ্ট করার প্রবণতাও আছে তাদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে সীতা অন্যতম। তিনি খুব ভালো রাঁধুনি ছিলেন। অন্যকে রেঁধে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। ব্রাহ্মণেরা খেতেন খুবই অল্প। এতে সীতার মন ভরত না। তাই তিনি একদিন রামকে এমন একজন ব্রাহ্মণ নিয়ে আসতে বললেন, যিনি যথেষ্ট খেতে পারবেন। রাম অগস্ত মুনিকে নিয়ে এলেন। এবার সীতা অনেকগুলো পদ তৈরি করে তার সামনে পরিবেশন করলেন। কিন্তু অগস্ত বললেন, ‘এটুকুতে আমার পেট ভরবে না, তুমি আরও রান্না করো’। সীতা একের পর এক পদ রান্না করেই চলেছেন, কিন্তু মুনির পেট আর ভরে না। এমনকি সীতাদেবী গণেশ ও তার দুই পত্নী রীতি ও সিদ্ধিকে রান্নার কাজে লাগালেন। পদের পর পদ রান্না হতে লাগল। তাতেও মুনির পেট ভরল না। ১৭ দিন পর্যন্ত তিনি খেয়েই চললেন। ১৮ দিনে তিনি রামের অনুরোধে অর্ধপেট অবস্থায় খাওয়া থামিয়েছিলেন।
দেবদেবীর খাওয়াদাওয়া নিয়ে আরও অনেক কথা প্রচলিত আছে। বেদেও ক্ষুধা প্রসঙ্গে আছে বিস্তারিত কথা। সে যা-ই হোক, উৎসব মানেই তো বাহারি সব খাবার- তা দেবদেবীরাই খান কিংবা ভক্তরা।
ছবি: সংগ্রহ