ফিচার I সম্ভাবনার চতুষ্টয়
চার তরুণের গল্প। মিউজিকের নানা পরিসরে তাদের প্রসিদ্ধি। লিরিক, ভোকাল থেকে মিক্সিং অ্যান্ড মাস্টারিং- সবকিছুতেই। ইনস্ট্রুমেন্টেও মাতিয়ে দেওয়ার মতো। তাদের সঙ্গে আড্ডার পর জাহেরা শিরীনের শ্রুতলিখন
রুশলান শাবীব মোরশেদ
পরিচয় দিতে পছন্দ করেন ব্লুজ মিউজিশিয়ান হিসেবে। এই ফর্মের গিটার প্লেয়িংয়ে তার মুনশিয়ানা সম্প্রতি তরুণ শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসিত। শুধু তা-ই নয়, নিজে গান লেখেন। গায়কিতেও রয়েছে নিজস্বতা। ২০০৭-এ গিটার বাজানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় রুসলানের মিউজিক্যাল জার্নি। প্রথম দিকে শেখেন ক্রাল ব্যান্ডের গিটারিস্ট সাদী মুক্তাফির কাছে। বিভিন্ন জনপ্রিয় গানও তখন কাভার করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে গান লেখায় আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গড়ে তোলেন দুটি ব্যান্ড। ব্ল্যাঙ্ক পেজেস এবং অরফ্রেড। দুটোই ইন্ডি রক ধাঁচের। তারপর আরেকটি ব্যান্ড গড়ার কাজ করেন তিনি। তৈরি হয় রুসলানের ড্রিম ব্যান্ড ‘জুকবক্স মাফিয়া’। ব্লুজ রক ব্যান্ড ছিল সেটি। পরবর্তীকালে পড়াশোনা আর ব্যক্তিগত কারণে তিনটি ব্যান্ডই ছেড়ে দিতে হয় তাকে। তবে গানের চর্চা চলছিল। পাশাপাশি গান কাভার করা, লেখা আর গিটার প্লেয়িংয়ের প্র্যাকটিস। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সে সময়। সহপাঠীদের কাছে তো বটেই, শিক্ষকদের মাঝেও। শুধু গানের জন্য একটা একাডেমিক কোর্সে ভালো গ্রেড পেয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। একদিন জো বোনামাসার ‘স্টপ’ গানটি শুনে ব্লুজের প্রতি আগ্রহ আরেকটু বাড়ে রুসলানের। এরপর নিয়মিত ব্লুজ আর্টিস্টদের গান শুনে ঝোঁক প্রবল হতে থাকে। তাই নিজেই শিখে নেন ব্লুজের বেসিক প্রোগ্রেশন ট্রিকগুলো। তা আরও শাণিয়ে নিতেই ছুটে যান ফিডব্যাকের গিটারিস্ট লাবু রহমানের কাছে। গিটার প্লেয়িংয়ে তাকেই গুরু মানেন তরুণ এ মিউজিশিয়ান। পরবর্তীকালে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকে পড়েন। তাই ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মিউজিকে সময়টা কমই দেওয়া হয়েছিল রুসলানের। কিন্তু এর মধ্যেও তিনি ফর্ম করেন ব্যান্ড ‘অড ম্যান আউট’। আগের ব্যান্ড জুকবক্স মাফিয়ার মেম্বারদেরকে সঙ্গে নিয়েই। ২০১৭-তে এরিক ক্লেপটনের ওল্ড লাভ গানের একটা লাইভ ভার্সন শুনতে শুনতে রুসলান সিদ্ধান্ত নেন- ব্লুজ মিউজিক নিয়ে কাজ করতেই হবে। কিনে নেন ফেন্ডার স্ট্র্যাট আর ১২ ওয়াট অরেঞ্জ প্র্যাকটিস অ্যাম্প। চাকরিটাও ছেড়ে দেন। শুরু হয় প্রতিদিন নিয়মিত প্র্যাকটিস। নতুন মিউজিক তৈরির কাজ। পুরো জার্নিতে পরিবারকে, বিশেষ করে বাবা মনজুর মোরশেদকে সব সময় পাশে পেয়েছেন রুসলান। গিটার প্লেয়িংয়ের ক্ষেত্রে তার অনুপ্রেরণা বি বি কিং, রবার্ট জনসন, হাওলিং উলফ, মাডি ওয়াটারস, স্টিভ রে, এরিক ক্লেপটন, জন মেয়ার, লাবু রহমানসহ অনেক মিউজিশিয়ান। গান লেখার প্রেরণা পান বব ডিলান, মার্ক নফলার, নোয়েল গেলাগার, কেলি জোনস, জনি ক্যাশ, বিলি জোয়েল প্রমুখের কাজে। এ ছাড়া দেশের লাকী আখান্দ্, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, অর্ণব, জন কবীরের গানও তাকে প্রভাবিত করেছে। নিজের কোর ফিলিং কাজে লাগিয়েই গান লেখেন তিনি। আর ব্লুজ বাজানোর মন্ত্র একটাই, ‘টু জাস্ট কিপ অ্যাট ইট’। ২০১৯-এ তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে থার্ড স্পেসে করা তার নিয়মিত শো ‘রুসলান’স অ্যাকুইস্টিক নাইট। করোনা-পরবর্তী সময়ে রেগুলার পারফর্ম করতে চান। সম্প্রতি গুছিয়ে নিয়েছেন নিজস্ব মিউজিক স্টুডিও ‘স্টুডিও ২৬’-এর কাজ। এখন ব্যস্ত আছেন নিজের করা দ্য উলফ, অ্যালাইভ/মার্ডার, টেক মি হোম, গভীর রাত্রি, ফাঙ্কড আপ ব্লু, মুনলাইট স্পার্কের মতো গানগুলোকে গুছিয়ে রিলিজ করার পরিকল্পনায়। মানুষ তাকে মনে রাখুক তার লেখা গানের জন্য, চিনুক দেশের সেরা ব্লুজ মিউজিশিয়ান হিসেবে- এটিই তার চাওয়া।
তিলক আদনান
শুরুটা স্কুল ব্যান্ডের ভোকাল আর লিরিসিস্ট হিসেবে। ছোটবেলা থেকে নিজের অনুভূতিগুলো গান দিয়ে প্রকাশ করার ব্যাপারটা খুব আকর্ষণ করত তিলককে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পেয়ে যান সমমনা দুই বন্ধু রুসলান আর শাফকাতকে। গড়ে ওঠে ব্যান্ড অরফ্রেড। প্রথমে ফান প্রজেক্ট থাকলেও কাজ করতে করতে সিরিয়াসনেস বাড়তে শুরু করে ব্যান্ড মেম্বারদের মধ্যে। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করার প্রবল ইচ্ছা থেকেই পরিণত হতে থাকে মিউজিক। মিলতে শুরু করে নতুন কাজ। বাড়ে জনপ্রিয়তা। মাঝে অরফ্রেডের লাইনআপও পরিবর্তিত হয় বেশ কয়েকবার। তিলকের মতে, এই ব্যান্ডটাই তাকে মিউজিকের গুরুত্ব বোঝাতে সাহায্য করেছে। ২০০০ সালের শেষের দিকে ঢাকার আন্ডারগ্রাউন্ড রক এবং মেটাল ব্যান্ডগুলো দারুণ প্রভাবিত করে এই তরুণ মিউজিশিয়ানের কাজকে। দেশের মিউজিকে যারাই নতুন কিছু করেছেন, তাদের প্রতি বরাবরই আকৃষ্ট হয়েছেন তিলক। এ ছাড়া ওয়েস্টার্ন ইনফ্লুয়েন্সের তালিকায় আছে জ্যাক জনসন, দ্য অ্যাকর্ন, বন ইভার-এর মতো বিখ্যাত সব নাম। লেখার পাশাপাশি গানের বেসিক স্ট্রাকচার কম্পোজ করেন তিলক। গাইতেও পারেন বেশ। তবে গানের কথা নিয়ে নিরীক্ষাই তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ। দিনের পর দিন, কখনো মাসও গড়িয়ে যায়, গান লেখা শেষ করতে। তবে মনের না বলা অনেক কথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশের এর থেকে ভালো উপায় আর হয় না বলেই মনে করেন তিনি। মিউজিকের মাধ্যমে নতুন নতুন মানুষকে যে জানা যায়, তা-ও খুব উপভোগ্য মনে হয়। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ব্যান্ডের সঙ্গে কোলাবোরেট করেছেন তিনি। এর মধ্যে পেটি নেভার গ্রিউ ব্যান্ডের সিগন্যাল গানটা তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ; যা তিলকের লেখা, গাওয়াও। এ ছাড়া লিখেছেন এবং কো প্রোডিউস করেছেন মিউজিশিয়ান রাকাত জামির মিউজিক্যাল প্রজেক্ট এম্বারস ইন স্নো-এর প্রথম ইপি। এখন তিলক নিজের ব্যান্ড অরফ্রেডের জন্য গান লেখা নিয়ে ব্যস্ত, তৈরি করেছেন ইপি। তিন বছর ধরে অ্যালবাম বের করার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া দুজন মিউজিশিয়ানের আলাদা দুটো প্রজেক্টের সঙ্গে কোলাবোরেট করতে যাচ্ছেন শিগগিরই।
মহুয়া মৌলী
আবৃত্তি, গান, নাচ, ছবি আঁকা- সৃজনশীল সব কাজে ছোটবেলা থেকেই দারুণ আগ্রহ মহুয়ার। ২০১৫-তে বন্ধুর সঙ্গে একটা গান কাভার করে সাউন্ডক্লাউডে আপলোড করেন তিনি। প্রথম গানেই বাজিমাত। তখন থেকে শুরু। গানে গলা দেওয়ার পাশাপাশি লেখাতেও সমান সপ্রতিভ মহুয়া। ভোকালিস্ট হিসেবে আইডল মানেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড উইনার এমি ওয়াইনহাউজকে। এ ছাড়া তালিকায় আছেন ডেমিয়েন রাইস, জেফ বাকলি, সুফিয়ান স্টিভিনসের মতো মিউজিশিয়ানরাও। এখন পর্যন্ত বাংলায় গান না লেখা হলেও মহুয়ার কাজকে অনুপ্রাণিত করেন অর্ণব আর ব্যান্ড জলের গানও। ছোটবেলা থেকেই মঞ্চে পরিবেশনা করে আসা মহুয়া স্টেজ পারফরম্যান্স খুব উপভোগ করেন। শ্রোতাদের সামনে গান গাওয়া, তাদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনে বরাবরই আনন্দ খুঁজে পান এই মিউজিশিয়ান। লাইভ শোর পাশাপাশি ইতিমধ্যেই মহুয়া তার ব্যান্ড দ্য পেট প্রজেক্ট নিয়ে রেডিও স্বাধীনে পারফর্ম করেছেন। এ বছরই রিলিজ হয় তাদের প্রথম সিঙ্গেল ‘সায়মা’। যা লেখার পাশাপাশি গেয়েছেনও মহুয়া। তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গানটি। এখন সংগীতচর্চা নিয়েই ব্যস্ত আছেন। ভবিষ্যতে নিজের একটা অ্যালবাম করার পরিকল্পনা আছে। যারা একটু ভিন্নধর্মী মিউজিক নিয়ে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চান।
আদিত্য আরজু সিয়াম
ফিল্মমেকার হয়ে ওঠার ফ্যাসিনেশন থেকে প্রোগ্রামিং আর অডিও অ্যারেঞ্জিং শেখা সিয়ামের। বিভিন্ন ধরনের অডিও স্যাম্পল আর লুপ নিয়ে কাজও করতে শুরু করেন। ফ্রুটি লুপস্ স্টুডিওতে ২০১৬-তে বানানো প্রথম অডিও ট্র্যাকটি তার আগ্রহের বাঁক বদলে দেয়। ২০১৭-এর মাঝামাঝিতে সুযোগ মেলে ফ্রি মিউজিক ওয়ার্কশপ করার। মিউজিক আর অডিও প্রোডাকশন সম্পর্কে আরও জানা এবং এই সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের মধ্যে পরিচিত হওয়াই ছিল এতে অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য। সেখানে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন সৌম্য সাহা। তার হাত ধরেই তিনি শেখেন এবেলটন লাইভ, যা এখন অব্দি সিয়াম ব্যবহার করছেন প্রাইমারি প্রোডাকশন সফটওয়্যার হিসেবে। ওয়ার্কশপটি তার অনেক ধরনের কনফিউশন দূর করে দিয়েছিল। কাজ শুরুর আইডিয়াটা মিলেছিল সেখান থেকেই। সিয়াম কাজ করেন মিউজিকের পোস্ট প্রোডাকশন পার্টে, অডিও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এ ছাড়া মিউজিক এবং সাউন্ডস্কেপ কম্পোজিশনেও তিনি দক্ষ। তবে নতুন নতুন সাউন্ড ডিজাইন করাই তার বেশি পছন্দ। মিউজিক্যাল আইডিয়াগুলো নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট এবং এক্সপ্লোর করেন নিয়মিত। এভাবেই প্রতিদিন আরও পরিণত হচ্ছে তার কাজ। মিউজিশিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে কোলাবোরেট করতে পছন্দ করেন। এখন ব্যস্ত আছেন ঘূর্ণি লিসনিং সেশনের নতুন লাইভ সেট তৈরির কাজে। এ ছাড়া কাজ করছেন আরও দুই তরুণ মিউজিশিয়ান শাদওয়ান আর মুনহামান্নার সঙ্গে। নিজের অ্যালবামের মিউজিক কম্পোজ ছাড়াও অনেক আর্টিস্টের গান রেকর্ডিং, মিক্সিং এবং মাস্টারিংয়ের কাজও চলছে সমানতালে। প্রচুর পড়াশোনা করতে চান, মিউজিক নিয়ে জানতে চান আরও। ভবিষ্যতে নিজের ড্রিম লাইভ সেট তৈরির স্বপ্ন দেখেন সদ্য ২১-এ পা দেওয়া এ মিউজিশিয়ান।
ছবি: মো. রাকিবুল হাসান
কৃতজ্ঞতা: স্টুডিও ২৬