ফিচার I সোশ্যাল মিডিয়ায় গাছগাছালি
উদ্ভিদের বিকিকিনিতে সামাজিক গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে নির্ভরযোগ্য একটি প্ল্যাটফর্ম। বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং পেজ বৃক্ষশোভিত হয়ে নিসর্গপ্রেমীদের নজর কাড়ছে
হুট করেই বাড়িতে বেড়েছে গাছের গুরুত্ব, তা নগরায়ণের জন্য হোক, অন্দরসজ্জায় অনুষঙ্গ বা মিলেনিয়াল কিংবা ওয়াই জেনারেশনের শখের জন্যই হোক না কেন। ঘরদোর সবুজ হয়ে চলেছে। অভিজ্ঞদের মতে, গৃহসজ্জায় গাছ আর তার আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের বিকিকিনির নেপথ্যে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব। এমন কয়েকটি এফ-কমার্স শপের গল্প এবারে।
নগ
উদ্যোক্তা আরিফ ইসলাম জানালেন, ছেলেবেলা থেকে প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক জিনিসের প্রতি আকর্ষণই তাকে ‘নগ’-এর উদ্যোক্তা বানিয়েছে। মাঝে বছর চারেক বিভিন্ন রিসোর্টে পেশাগত কাজের ভেতরেই গাছ ও ল্যান্ডস্কেপিংয়ের ব্যাপারগুলো খেয়াল করতেন। স্বাধীনভাবে সবকিছু করার জন্য ২০১৮ সালে এই উদ্যোগের দিকে পা বাড়ালেন- বন্ধুর বাড়ির ছাদে দুই বন্ধু মিলে বাঁশ-কাঠের ঘর গড়লেন। দেখলেন বাঁশ-কাঠ দিয়ে আরও অনেক কিছুই করা সম্ভব। তখন থেকেই আরও গাছপালা বাড়িয়ে কাঠ এবং বাঁশের উপকরণ দিয়ে নানা জিনিস বানানোর প্রয়াস, শুরু এই প্রতিষ্ঠানেরও। নাগ মানে প্রকৃতি, গাছপালা, বৃক্ষ, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি।
নগ মূলত যেকোনো ছোট-বড় ল্যান্ডস্কেপিংয়ের কাজ করে। অ্যাকুয়াস্কেপিং- জলপ্রপাত, পুকুর, জলজ গাছপালাসমেত অ্যাকুরিয়াম- সবই করেন তারা। রয়েছে কাঠ আর বাঁশের প্ল্যান্টার, হ্যাঙ্গার, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। অন্দরসজ্জার গাছ তো রয়েছেই। এর মধ্যে সূর্যালোক কম লাগে এমন গাছই তারা বেশি রাখেন, যেমন- অর্কিড, হয়া, সাকুলেন্ট ইত্যাদি। নগের সার্ভিস অনলাইন, অফলাইন দুভাবেই নেওয়া যায়। অনলাইন সার্ভিসে বড় কোনো সমস্যা এখন পর্যন্ত দেখা দেয়নি, তবে এ ধরনের পরিস্থিতি যদি হয় তাহলে রিফান্ড ও পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। দেশজুড়েই সেবা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এফ-কমার্স: https://www.facebook.com/nogbd
শতদল
খানিকটা এক্সোটিক গাছপালার জন্য শতদল পরিচিত নাম। এর মানে পদ্মফুল। উদ্যোক্তাদের একজন মাহনুর মাহজাবিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাঁচজন বন্ধুর সম্মিলিত উদ্যোগে দাঁড়িয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। পড়াশোনার পাশাপাশি তারা প্রত্যেকেই নিজেদের ঘরবাড়ি গাছগাছালিতে ভরিয়ে ফেলতে সফল হয়েছেন! লকডাউনেই শতদলের পথচলা শুরু, বয়স আট মাস। শতদলকে মূলত আর দশটা পেজ থেকে আলাদা করেছে প্রতিটি গাছের বিস্তারিত বিবরণসহ চমৎকার সব ছবি। যেখানে অধিকাংশ অনলাইন প্ল্যান্ট সেলাররা গাছকে কেবল পণ্য হিসেবেই বিক্রি করেন, নামধাম জানার কষ্টে যেতে চান না, সেখানে শতদল গাছের প্রচলিত ইংরেজি নাম, বৈজ্ঞানিক নাম, যত্ন, কতটুকু আলো ও পানির প্রয়োজন, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে রাখেন ছবির সঙ্গেই। এসবের তালিকায় রয়েছে অর্কিড, সাকুলেন্ট, জলজ গাছ, এয়ার প্ল্যান্ট, ক্যাকটাস এবং ইনডোর গাছপালা। ইদানীং যোগ হচ্ছে আউটডোর প্ল্যান্টও।
মাহনুর জানালেন, তারা গাছ সংগ্রহ করেন সরাসরি আমদানিকারকদের কাছ থেকেই। এ কারণে অনেকে শখের গাছের খোঁজ করেন এখানে। সততা আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা থেকেই তারা এটা শুরু করেন।
দেশজুড়ে গ্রাহকের কাছে নিরাপদে গাছ পৌঁছে দেয় শতদল।
এফ-কমার্স: https://www.facebook.com/ sutollotus
ইজি ডোর
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ধীরে ধীরে সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যাবে- বিশেষজ্ঞদের এমন ভবিষ্যদ্বাণী থেকেই ইজি ডোরের বীজ অঙ্কুরিত, জানালেন তানভীর আহমেদ সজল। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য প্রত্যেক মানুষ যেন পরিবেশ ও সমাজের প্রতি যত্নশীল হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ইজি ডোর অপচনশীল বা পরিবেশের ক্ষতি করে এমন প্লাস্টিক, পেপার, ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে বিনিময়ে গাছ দেওয়া শুরু করে। পরে এটিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগানদাতা হিসেবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
ঘরের ছাদ বা বারান্দা, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- সব জায়গায় সৌন্দর্যবর্ধন ও কৃষির জন্য গাছ আর গাছসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সবকিছুই ইজি ডোর থেকে সংগ্রহ করা যায়। নগদ টাকা কিংবা অপচনশীল বর্জ্যরে বিনিময়ে। সেখানে বর্জ্যগুলোকে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। ইজি ডোরের মাধ্যমে একদিকে যেমন পরিবেশের প্রতি মানুষ যত্নবান হচ্ছে, তেমনি আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন নাগরিকেরা। প্রতিষ্ঠানটির গাছের তালিকা বেশ দীর্ঘ- দেড় হাজারের বেশি বনজ, ফলদ, ঔষধি আর ইনডোর প্ল্যান্ট রয়েছে। অর্ডার অনুযায়ী পুরো বাংলাদেশেই সাশ্রয়ী মূল্যে গাছ সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এখন খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করলেও স্বপ্ন রয়েছে, একদিন সমগ্র দেশেই ইজি ডোর কাজ করবে।
এফ-কমার্স: https://www.facebook.com/EasyDoorWasteManagement
শখের মালী
কোভিড প্যানডেমিকের ভেতরেই শুরু। চট্টগ্রামে। সেখানকার নার্সারিগুলোয় ট্রেন্ডি গাছের অপ্রতুলতা আর করোনা পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী মানুষের কথা ভেবেই সস্তায় গাছ আর বাগানের উপকরণ পৌঁছে দিতে শখের মালীর যাত্রা শুরু। চার বন্ধু মিলে।
উদ্যোক্তাদের একজন আজরা জামাল জানালেন, শখের মালী নামটাই এসেছে শখ হিসেবে বাগান করাকে উৎসাহিত করতে। সে জন্য বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গাছ উপহার দেওয়ার ধারণাকেও তারা প্রমোট করে আসছে। এখান থেকে যে যা-ই কিনুক না কেন, সঙ্গে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় গাছ। ইট-কাঠের অন্দরেও যেন এক টুকরো সবুজ থাকে, সে জন্য ইনডোর প্ল্যান্টের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয় তারা। পাওয়া যায় গাছ লালন-পালনের টিপসও। মাধ্যম অনলাইন হলেও অল্প সময়েই তাদের প্রচুর বৃক্ষবন্ধু তৈরি হয়েছে পুরো দেশে। তাই শুধু চট্টগ্রাম নয়, কুরিয়ারের মাধ্যমে সারা দেশেই সরবরাহ করা হচ্ছে বাগানের সব ধরনের উপকরণ। তবে সে ক্ষেত্রে সময়টা একটু বেশিই লেগে যায়, এটাই সমস্যা। চট্টগ্রামে হোম ডেলিভারি সম্ভব হলেও এর বাইরের শহরগুলোতে কুরিয়ার অফিস থেকে গাছ সংগ্রহ করে নিতে হয় গ্রাহককে।
আজরা জামাল মনে করেন, ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে নার্সারির উন্নতির জায়গা রয়েছে অনেক, ইনডোর প্ল্যান্টগুলোর টিস্যু কালচার করানো প্রয়োজন।
এফ-কমার্স: https://www.facebook.com/shokhermali
অন্দরে নন্দন
ইট-পাথরের ঢাকা শহরে ঘরের মধ্যেই সবুজকে নিয়ে আসা এবং আরও সৌন্দর্যময় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব নানান সামগ্রীর মেলবন্ধনের নাম হলো ‘অন্দরে নন্দন’। শখের বশেই গাছ ও নানান ঝুড়ি সংগ্রহ করে বাসা সাজাতেন কাজী সামিরা পিনাশ। ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা গ্রুপে পোস্ট করতেন। জানালেন, ‘আমার গাছের যত্ন আর ঝুড়িগুলোর প্রতি সবার আগ্রহ দেখে নিজেরও উৎসাহ এসে গেল; শখকে কাজ বানিয়ে ফেললাম।’
‘এত পড়াশোনা করে গাছ-মাটি নিয়ে কাজ করো!’- এ ধরনের কথা গায়ে না লাগানোর মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে তাকে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল উৎস খুঁজে বের করা। ফ্যাক্টরি থেকে ফ্যাক্টরি ঘুরেছেন, কিন্তু এই সেক্টরটা শতভাগ রপ্তানিনির্ভর হওয়ায় কারও থেকেই তেমন সহযোগিতা পাননি। কেউবা রাজি হলেও অনেক বড় বিনিয়োগ আশা করেন, যা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু দমে না গিয়ে গ্রামে কারিগর খুঁজতে থাকেন। শেষমেশ জুলাইয়ে নিজের বাসার কিছু ছবি দিয়ে অন্দরে নন্দন-এর যাত্রা শুরু করেন। তিনি বলেন, প্রথম অর্ডারের টাকায় কারিগরের মজুরি দিয়েছিলাম। সে হিসেবে শূন্য বিনিয়োগে শুরু করা উদ্যোগটির ছয় মাস হতে চলল। প্রথমে গাছের সঙ্গে হোগলাপাতার তৈরি প্ল্যান্টার দিয়ে কাজ করলেও এখন পাট, ছন, সুপারি পাতা, কচুরিপানা, বাঁশ, বেত- সবকিছুই যোগ হয়েছে।
প্রথমে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও এখন বেশ আত্মবিশ্বাসী সামিরা পিনাশ। অল্প কিছুদিনেই অন্দরে নন্দন গাছ, সেগুলোর পরিবেশবান্ধব প্ল্যান্টার আর সেবা দিয়ে অনেকের আস্থাভাজন হতে পেরেছেন। সামিরার মতে, ‘এখন দায়িত্বটাও একটু বেশি, ইচ্ছে আছে পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে অন্দরে নন্দনকে সবার কাছে পরিচিত করার।’
এফ কমার্স: https://www.facebook.com/ondorenondon
আল মারুফ রাসেল
কৃতজ্ঞতা: জারিন রিশা ও আলফিজ শাহরিন
ছবি: নগ, শতদল, ইজি ডোর, শখের মালী ও অন্দরে নন্দন