ফিচার I বৃক্ষপূজা
ধর্মের সঙ্গে গাছের সম্পৃক্তি ইতিহাস-পূর্ব কাল থেকেই। বুনো মানুষের সর্বপ্রাণবাদের ধারণাই বৃক্ষকে করেছে পূজিত। প্রথাটি এখনো রয়ে গেছে।
জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ
ধর্মজুড়ে বৃক্ষপূজার ছড়াছড়ি। উৎপত্তিলগ্ন থেকেই। সারা বিশ্বে। জার্মানির পুরোনো প্রথায়ও মেলে বৃক্ষপূজার ফিরিস্তি। সে দেশে গাছকে ধর্মীয়ভাবে এত গুরুত্ব দেওয়া হতো যে কেউ বৃক্ষের বাকল তুললেও জুটত মৃত্যুদন্ড। অপরাধীর নাভি তুলে ক্ষতিগ্রস্ত গাছের আহত স্থানে এঁটে দিতেন বিচারকেরা। তারপর গাছটি কেন্দ্রে রেখে আসামিকে ঘোরানো হতো। এতে তার অন্ত্র বেরিয়ে পেঁচিয়ে যেত কান্ডের সঙ্গে। হতো মৃত্যু।
লিথুয়ানরা বসতির কাছে ‘ওক’ গাছের বাগান করে। সেই কুঞ্জবনের একটি ডাল ভাঙাও মহাপাপ বলে গণ্য। ভাবা হয়, গাছের কোনো ক্ষতি করলে বাগানমালিকের পরিবারের সদস্যদের কারও না কারও মৃত্যু অবধারিত। ওকপূজার প্রচলন আছে জার্মান ওয়েল্ট গোত্রেও। প্রতি জুলাই মাসের ২ তারিখে তারা এই বৃক্ষ গাঁয়ের মধ্যখানে পুঁতে পূজা করে। নিজেদের গবাদিপশুগুলোকে পূজিত ওকগাছের চারপাশে ঘোরায়। তাদের ধারণা, এতে প্রাণীগুলোর প্রজননক্ষমতা বাড়বে। গবাদির সুরক্ষার্থে পূজিত হয় নাশপাতিগাছও। ককেশাসীয়দের মধ্যে। তারা বন থেকে নাশপাতির ডাল কেটে ঘরে এনে খুব যত্নআত্তি করে। গবাদিমঙ্গল ছাড়াও বৃষ্টি নামানো, বর্ষণবন্ধ, প্রসববেদনা কমানো ইত্যাদি স্বার্থেও বৃক্ষপূজা হয়। কিছুকাল আগে মিয়ানমারের ‘মন’ গ্রামের প্রান্তে একটি তেঁতুলগাছ ছিল। আদিবাসীরা বৃষ্টির কামনায় সেটির কান্ডে রুটি, নারকেল ও মুরগি নৈবেদ্য দিত।
উত্তর মিসৌরির আদিবাসীরা শিমুলগাছের অর্চনা করে। তাদের বিশ্বাস, এই বৃক্ষের কাছে খুব কেঁদেকেটে কিছু চাইলে তা পাওয়া যাবে। পূর্ব আফ্রিকায় ওয়ানিশ গোত্রে চলে নারকেলগাছের পূজা। সেখানে এই বৃক্ষ কাটা মাতৃহত্যার সমতুল্য। রাশিয়ার কিছু আদি গোত্রে বার্চগাছ পূজার চল আছে। সে দেশে ‘হুইটসানডে’ উৎসবের আগের বৃহস্পতিবার গ্রামবাসী বনে গিয়ে একটি বার্চগাছ কাটে। তারপর সেটিকে মেয়েদের পোশাকে সজ্জিত করে। অতঃপর তা বয়ে আনে গাঁয়ে। কোনো এক গ্রামপ্রধান কিংবা বিশেষ ব্যক্তির বাড়ির উঠানে স্থাপন করা হয় গাছটি। সেটিকে কেন্দ্র করে চলে দুদিনব্যাপী ধর্মীয় উৎসব। তৃতীয় দিনে গাছটিকে খর¯্রােতা নদীতে বিসর্জন দেয় তারা। কিছু অঞ্চলে বন থেকে গ্রামের ভেতর সেই বিশেষ বার্চবৃক্ষটি বহন করে আনা হয় বলদের মাধ্যমে। মানে, গরু সেখানে তরুদেবতার বাহক হয়ে ওঠে। রোমে ডুমুরগাছের পূজার চল ছিল।
ধর্মে বৃক্ষপূজার উপস্থিতি বিস্তৃতভাবে ছিল প্রায় দু শ বছর আগেও। কালের আবর্তে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ঘটেছে। সভ্যতায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তাই উল্লিখিত বৃক্ষপূজা এখন আগের অবস্থায় নেই। গাছ অর্চনা কমেছে বটে, কিন্তু বিলীন হয়ে যায়নি।
অরণ্যে ঘেরা আদিম ও প্রাচীন পৃথিবীতে বৃক্ষই ছিল মানুষের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। আদিম সমাজে ধর্মের উৎপত্তির আগে সর্বপ্রাণবাদের উদ্ভব ঘটেছিল। এই মতবাদের সরল তর্জমা- সবকিছুতেই প্রাণ আছে। পাথরে, পানিতে, আকাশে, বনে- সবেতেই আত্মা রয়েছে। তাই বুনো মানুষ ভাবত, গাছেরও আত্মা আছে। আরও বিশ্বাস করত, নিজেদের মৃত পূর্বপুরুষের আত্মা বৃক্ষে বাসা বাঁধে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার দিয়েরি গোত্রের বিশ্বাস, পূর্বপুরুষেরা মারা গিয়ে গাছে পরিণত হয়। ফিলিপিনের বিভিন্ন দ্বীপের আদিবাসীর ধারণা, তাদের মৃতদের আত্মা বৃক্ষে ভর করে। তরুবাসী এসব আত্মার যত্ন না নিলে পেতে হবে কঠিন শাস্তি। সামান্য অবহেলাতেই সেগুলো রাগান্বিত হয়ে উঠবে। করবে জীবিতদের অনিষ্ট। বাতাসের তোড়ে পাতায় যখন শন-শন শব্দ হয়, তখন বৃক্ষপূজারিরা মনে করে, আত্মা কথা বলছে। তখন তারা ওই গাছের নিচে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করে। বৃক্ষ-আত্মাকে বিরক্ত করার জন্য করজোড়ে ক্ষমা চায়। ইগোরোটিস আদিবাসীদের মৃত পূর্বপুরুষের বসবাসের জন্য প্রতিটি গ্রামেই একটি করে আবাসিক গাছ থাকে। যেখানে ওই গ্রামের মৃতদের আত্মা বাস করে। কোরিয়ান কিছু আদিবাসী বিশ্বাস করে, যারা মহামারি, দুর্ঘটনা কিংবা প্রসবকালে মারা যায়, তাদের আত্মা গাছে ভর করে। তখন তারা সেই বৃক্ষের নিচে বেদি তৈরি করে ওসব আত্মার উদ্দেশে পিঠা, দো-চোয়ানি ও শূকরের মাংস নৈবেদ্য দেয়। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ সিয়াউতে অধিবাসীরা বৃক্ষারোহী আত্মাকে সন্তুষ্ট করতে মোরগ-মুরগি, ভেড়া, ছাগল উৎসর্গ করে। নাইস আদিবাসীদের ধারণা, গাছ মরে গেলে পিশাচে পরিণত হয়। সেই প্রেতাত্মা যে গাছে বসবে, সেটির দফারফা হয়ে যাবে। যে ঘরে প্রবেশ করবে, সেখানে শিশু মরবে। বৃক্ষ কেটে ফেললেও গাছবাসী আত্মাদের থেকে মুক্তি মেলে না। সেলেবেসের তোরাদজা গোত্র বিশ্বাস করে, গাছ কেটে যে তক্তা বানানো হয়, সেটির ফাঁকে-ফোকরে আত্মা লুকিয়ে থাকে। সেটিকে তাড়াতে তারা খাসি, শূকর কিংবা বলদ বলি দেয়। তারপর পশুর রক্ত দিয়ে তক্তাগুলো ধুয়ে নিলে আত্মা পালায়। আদিকালে পশুর বদলে মানুষ বলির রক্ত দিয়েই সেই আত্মা তাড়াত তোনাপুরা জাতি।
আদিম বৃক্ষপূজারিরা মনে করত, মৃতদের আত্মা সব সময়ই গাছে চড়ে থাকে না। নিজ মর্জিমাফিক তা বৃক্ষ থেকে নামে, ঘুরে বেড়ায়, মন চাইলে জীবিত কারও ক্ষতি করে ফের গাছে গিয়ে ওঠে। বেশি খেপে গেলে এসব ভ্রাম্যমাণ আত্মা জীবিত ব্যক্তিদের রোগাক্রান্ত করে মারে। আদিম জনগোষ্ঠী আরও ভাবত, গাছ কাটলে বৃক্ষবাসীর আত্মা বাস্তুচ্যুত হয়। ওসব রিফিউজি প্রেতাত্মা রোগবালাই দিয়ে মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেয়। যেমন মধ্য আফ্রিকার বাসোগা গোত্রের ধারণা, গাছ কাটলে সেই আত্মা ওদের গোত্রপ্রধান কিংবা পরিবারের কারও ক্ষতি করবেই করবে। তাই কোনো বৃক্ষ কাটার আগে তারা ওঝার মাধ্যমে আত্মার উদ্দেশে মুরগি কিংবা ছাগল বলি দেয়। অস্ট্রেলিয়ার কিছু আদিবাসী কর্তনের আগে বৃক্ষের কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। স্লেভ কোস্টের আদিবাসীদের বিশ্বাস, বিশেষ কিছু তুলাগাছে ‘বুন্টিন’ নামের এক দেবতা বাস করে। তার শান্তি নিশ্চিত করতে বৃক্ষটিকে তারা তালপাতা দিয়ে ঘিরে রাখে। সেই গাছের নিচে মুরগি ও পাম তেল উৎসর্গ করে অর্চকরা। কোনো কোনো গোত্রের বৃক্ষপূজারিরা মাঝেমধ্যে গাছে মই পেতে দেয়। নয়তো গাছ থেকে দেবতা বা আত্মা নেমে আসবে কীভাবে! পাঞ্জাবের কাঙ্গড়া অঞ্চলে একটি সিডার গাছ ছিল। সেটির গোড়ায় প্রাচীনকালে ফি বছর একটি করে বালিকা উৎসর্গ করা হতো। পরে গাছটি কেটে ফেলা হয়।
এবার সাম্প্রতিক বিশ্বের বৃক্ষপূজার সংক্ষিপ্ত বয়ান হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের গবেষক তাপস পাল পূজিত বৃক্ষের ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছেন। যেটির ভিত্তিতে ২০১২ সালে গণমাধ্যমে কিছু রিপোর্ট হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুন্দরবন থেকে গড়বেতা, জঙ্গলমহল থেকে ডুয়ার্স পর্যন্ত ভারতীয় লোকেরা মোট ১ হাজার ৭৯১টি গাছকে পূজা করে। পূজিত গাছের মধ্যে কয়েকটি হলো শেওড়া, তেঁতুল, পাকুড়, বট, নিম ইত্যাদি। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব গাছকে পূজা করা এবং ধর্মীয় গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে বিশেষ কয়েকটি হচ্ছে আমলকী, পিপল, বন্যান, আম, খেজদি, বিলভা, অশোক, কলা, পেয়টে, ইয়ু, পুদিনা ও ডালিম। ২০১৬ সালে একটি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভাটপাড়া গ্রামের ওঁরাও আদিবাসীদের মধ্যে কারামবৃক্ষ পূজার চল আছে। এই গাছকে তারা নিজেদের রক্ষা ও পালনকর্তা হিসেবে মানে। এ ছাড়া বর্তমানে মিসলটো উদ্ভিদকে ক্রিসমাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ভাবা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তুলসীগাছের আধ্যাত্মিক মূল্য আছে এবং রাস্তাফারি ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে গাঁজাগাছ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ছবি: ইন্টারনেট