কুন্তলকাহন I স্ক্যাল্প পেইন
মাথার ত্বকে ব্যথা হতে পারে নানা কারণে। কিন্তু এর বিচিত্র দাওয়াইও রয়েছে
স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর চুল পেতে সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার বিকল্প নেই। এর অভাবে দেখা দিতে পারে খুশকি, উকুন, চুল পড়ার মতো সমস্যা। সেই সঙ্গে ব্যথাও হতে পারে! আঁচড়ানো বা চুল বাঁধার সময় এমনটি হতে পারে। সমস্যাটি একটু বিভ্রান্তিকর। কারণ, ব্যথাটি চুল থেকে আসছে মনে হলেও এর উৎপত্তি স্ক্যাল্পে। মাথার ত্বকের রক্তনালি থেকে ইনফ্ল্যামেশন চুলের ফলিকলে আসার ফলে সাধারণত এই ব্যথা হয়। এ ছাড়া আরও কিছু কারণে এ সমস্যা হতে পারে।
কালপ্রিট
ভালোভাবে চুল পরিষ্কার না করা মাথার ত্বকে ব্যথা হওয়ার প্রধান কারণ। অনেকেই প্রতিদিন পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলেন ঠিকই, কিন্তু শ্যাম্পু লাগান না। এতে স্ক্যাল্পে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন তেল চুলের উপরিভাগে জমতে থাকে। ফলে সহজেই ময়লা আটকে যায়। এ থেকে ইস্ট ইনফেকশন শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে খুশকি, অ্যাকনে, সোরাইসিস, একজিমা, ফলিকুলিটিসের মতো ইনফ্ল্যামেশনজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে।
অপরিষ্কার চুলের জন্য মাথার ত্বকে চুলকানি হয়। এতে ত্বকে সাইটোকাইন নামের একধরনের প্রোটিন নিঃসৃত হয়, যা চুলকানি বাড়িয়ে দেয়। ফলে মাথার ত্বকে রক্তপ্রবাহ অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করে।
সে জন্য অপরিষ্কার এবং অতিরিক্ত পরিষ্কার চুল- উভয়ই দায়ী। ওভার ওয়াশিংয়ের জন্য স্ক্যাল্পের পিএইচ ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যায়। এতে আর্দ্রতা কমে গিয়ে ত্বক শুষ্ক হয়ে ওঠে। দেখা দেয় ফ্লেকিং। এর থেকে সেবোরোয়িক ডার্মাটাইটিসের মতো ইনফ্ল্যামেশনজনিত সমস্যা হতে পারে। এটি মাথার ত্বকে ব্যথা হওয়ার আরেকটি কারণ।
কিছু হেয়ারস্টাইলিংয়ের জন্যও ব্যথা হতে পারে। খুব শক্ত করে পনিটেইল, বান বা ব্রেইড করলে চুলের ফলিকল ড্যামেজ হয়ে থাকে। এতে মাথার ত্বকে ব্যথা হয়।
এ ছাড়া হেয়ার প্রডাক্টে থাকা কোনো রাসায়নিক উপাদানের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশনের কারণেও ব্যথা হতে পারে। এ জন্য অনেক সময় চুল সঠিকভাবে পরিষ্কার করার পরও ব্যথা হয়ে থাকে। অনেকে গোসলের সময় শ্যাম্পু ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে ড্রাই শ্যাম্পু বেছে নেয়। এতেও মাথার ত্বকে ব্যথা হতে পারে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়। অনেকে ড্রাই শ্যাম্পু মাথার ত্বকে লাগিয়ে থাকেন। এ সময় ঘাম ও ড্রাই শ্যাম্পু মিশে ব্যাকটেরিয়া উৎপাদন ত্বরান্বিত করে। এর ফলে হতে পারে ইনফ্ল্যামেশন, চুলকানি ও ব্যথা। আবার হেয়ার ডাইং, ব্লিচিং, রিবন্ডিং করার সময় বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। এগুলো চুলের গোড়ায় আটকে থেকে ইনফ্ল্যামেশন সৃষ্টি করতে পারে। চুলে উকুনের উপদ্রব হলেও মাথার ত্বকে ব্যথা হয়।
করণীয়
স্ক্যাল্পে ব্যথা হওয়ার আসল কারণ খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে। টানা কয়েক দিন চুল না ধোয়ার জন্য ব্যথা হয়ে থাকলে ভালোভাবে শ্যাম্পু দিয়ে পরিষ্কার করা দরকার। মাথার ত্বকের ইনফ্ল্যামেশন এড়ানোর জন্য নিয়মমাফিক শ্যাম্পু দিতে হবে। ত্বক অতিরিক্ত তৈলাক্ত হলে প্রায় প্রতিদিন প্রাকৃতিক উপাদানসমৃদ্ধ বা সালফার, জিঙ্ক কিংবা টারের মতো অয়েল রিডিউসিং এজেন্ট দেওয়া শ্যাম্পু ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়। বেবি শ্যাম্পুও কাজে দেবে।
বেশি শুষ্ক ত্বকের জন্য দুদিন পরপর চুল পরিষ্কার করলে চলবে। এ ক্ষেত্রে ভালো তেল, গ্লিসারিন, সিলিকন, মাইল্ড ক্লিনজিং এজেন্টসমৃদ্ধ শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে চুলের ও ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকে। পিএইচ ব্যালান্সও নষ্ট হয় না।
ঘন ঘন হেয়ার ট্রিটমেন্ট বন্ধ করতে হবে। হেয়ার ডাইং বা ব্লিচিং করার সময় সতর্কতার সঙ্গে কালার প্রডাক্ট বাছাই করা দরকার। সবচেয়ে ভালো হয় কোনো ডার্মাটোলজিস্ট বা হেয়ারস্টাইলিস্টের পরামর্শ নিয়ে প্রডাক্ট কেনা। মাথার ত্বকের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন এড়াতে সাবধানতার সঙ্গে লেবেল পড়ে এ ধরনের পণ্য কেনা শ্রেয়।
অ্যালকোহল, সালফেট, প্যারাবেন আছে এমন কোনো হেয়ার প্রডাক্ট বা শ্যাম্পু কেনা ঠিক হবে না। এই উপাদানগুলো চুলের ক্ষতি করে।
ড্রাই শ্যাম্পু সপ্তাহে এক দিনের বেশি ব্যবহার না করাই ভালো। তবে অবশ্যই সেটি সঠিক নিয়মে লাগাতে হবে। কোনোমতেই মাথার ত্বক বা চুলের গোড়ায় এটি লাগানো যাবে না।
মাথার ত্বকে ব্যথা হয়ে থাকলে চুল না বেঁধে ছেড়ে রাখাই ভালো। বাঁধলেও খুব টাইট করে নয়। এই অবস্থায় উপযুক্ত হেয়ারস্টাইল হচ্ছে লাইট ব্রেইড, লো পনিটেইল। বড় ব্যারেট হেয়ার ক্লিপ দিয়েও চুল আটকিয়ে রাখা যায়। ইলাস্টিক বা মেটাল হেয়ার ব্যান্ড এড়িয়ে স্ক্রাঞ্চি বা রিবন বেছে নেওয়া ভালো। ব্যথা প্রতিরোধের জন্য সব সময় টাইট হেয়ারস্টাইল থেকে দূরে থাকতে হবে।
চুল আঁচড়ানোর সময়ও সতর্ক থাকতে হবে। সব সময় নরম ব্রিসলের হেয়ার ব্রাশ বা মোটা দাঁতের ফাঁকা চিরুনি দিয়ে ধীরে ধীরে আঁচড়াতে হবে।
মাথার ত্বকে ব্যথা যদি ইনফেকশন বা ইনফ্ল্যামেশনজনিত সমস্যা যেমন সোরাইসিস, একজিমা, সেবোরোয়িক ডার্মাটাইটিস হয়ে থাকে, তাহলে ডার্মাটোলজিস্টদের পরামর্শ নিয়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে।
ঘরোয়া টোটকা
ঘরে বসে প্রাকৃতিক উপায়েও মাথার ত্বকের যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
স্ক্যাল্প সুস্থ রাখতে এসেনশিয়াল অয়েল ভালো কাজ করে। রোজমেরি বা ল্যাভেন্ডার এসেনশিয়াল অয়েল মাথার ত্বকে ইনফ্ল্যামেশন কমাতে অনেক কার্যকর। কয়েক ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল দুই টেবিল চামচ সুইট আমন্ড অয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে মাথার তালুতে লাগিয়ে হালকা ম্যাসাজ করতে হবে। তারপর পনেরো মিনিট অপেক্ষা করে মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়।
টিট্রি অয়েল যেকোনো ধরনের ইনফ্ল্যামেশন, ব্যাকটেরিয়া বা ইস্টজনিত ইনফেকশন প্রতিকারে বেশ কার্যকর। মাত্র কয়েক ফোঁটা টিট্রি অয়েল দুই টেবিল চামচ জোজোবা অয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে লাগাতে হবে। টিট্রি অয়েলে আছে ‘টারপিনস’ যা প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি উপাদান। সপ্তাহে দু-তিনবার এই অয়েল ব্যবহার করলে মাথার তালুর সমস্যার সমাধান হবে।
ফ্লেকিংয়ের জন্য ব্যথা হয়ে থাকলে ওটমিল ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে রয়েছে উচ্চমানের লিপিড এবং পানি শোষণকারী উপাদান, যা মাথার ত্বককে আর্দ্রতা দেয় ও ফ্লেকিং প্রতিরোধ করে। চুল পরিষ্কার করতে ওটমিল শ্যাম্পু বা সাবান লাগানো যায়। এ ছাড়া সপ্তাহে দুই দিন শুধু পানি দিয়ে ওটমিল মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।
লেবুর রসে রয়েছে অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি প্রোপার্টি। পাশাপাশি এটি চুলের পিএইচ ব্যালান্স ঠিক রাখে। লেবুর রস ক্যারিয়ার অয়েল, শ্যাম্পু, কন্ডিশনারের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া শুধু লেবুর রস তুলার বলের সাহায্যে মাথার ত্বকে ঘষে পনেরো মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে।
খুশকি বা উকুনের জন্য ব্যথা হলে অনায়াসে ব্যবহার করা যায় নিমপাতা বাটা বা নিম অয়েল।
ফাহমিদা শিকদার
মডেল: সূর্য
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ফারাবী তমাল