সেলুলয়েড I ফাগুন হাওয়ায়
পরিচালক : তৌকীর আহমেদ
প্রযোজনা : ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি.
চিত্রগ্রাহক : এনামুল হক সোহেল
অভিনয় : যশপাল শর্মা, নুসরাত ইমরোজ তিশা, সিয়াম আহমেদ, আবুল হায়াত, শহীদুল আলম সাচ্চু, ফজলুর রহমান বাবু
সংগীত : পিন্টু ঘোষ, রোকন ইমন
মুক্তি : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
দৈর্ঘ্য : ১৩৬ মিনিট
ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নিয়ে সাহিত্য রচিত হলেও উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। যদিও জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭০ সালে নির্মিত এই কাহিনিচিত্রে তিনি বায়ান্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগে বাঙালির স্বাধিকার চেতনার গল্প তুলে এনেছেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটি আর নির্মিত হয়নি। এ ছাড়া শহীদুল আলম খোকনের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বাঙলা’ এবং বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র ভাষা আন্দোলনের সিনেমার ইতিহাস। এই ধারায় তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
মফস্বল শহরের গল্পে পরিচালক এই সিনেমায় ভাষা আন্দোলনের কাহিনি রূপায়ণ করেছেন। তবে তা নিছক মাতৃভাষার দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষার সংগ্রামে উজ্জীবিত বৃহত্তর প্রেক্ষাপট। তাই টিটো রহমানের ছোটগল্প ‘বউ কথা কও’-এর কাহিনি অবলম্বনে তৌকীর আহমেদ চিত্রনাট্য রচনায় স্বকীয়তা বজায় রেখেন।
সিনেমায় জমশেদ খান একজন উর্দুভাষী পাকিস্তানি পুলিশ অফিসার। পাক শোষক গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে রূপায়িত হয়েছে চরিত্রটি; যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সহ্য করতে পারে না। মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিগ্রস্ত, তার হাতে মানুষ এবং পশুপাখি কোনোটিই নিরাপদ নয়। শাস্তিস্বরূপ তার পোস্টিং হয়েছে খুলনার চন্দ্রপুর নামে এক মফস্বল শহরে। লঞ্চে করে সে ঢাকা থেকে খুলনায় যাচ্ছিল। তাতে উঠেছে একই গন্তব্যের যাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসির ও ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রী দীপ্তি। যাত্রীদের একজন বাউল বাংলা গান গাইছে দেখে তার গায়ে হাত তোলে জমশেদ। তখনই এ ঘটনার প্রতিবাদ করে নাসির ও দীপ্তি। এভাবেই শুরু হয় তাদের দ্বৈরথ এবং তা অব্যাহত থাকে চন্দ্রপুরেও। সেখানে এলাকার লোকজনের জন্য জমশেদ একাই ত্রাস রূপে হাজির হয়। এ দেশের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যেন আজন্মের শত্রুতা। বাংলাকে হিন্দুয়ানি ভাষা দাবি করে গ্রাম থেকে তা মুছে ফেলার উদ্যোগ নেয় সে। সব বাংলা সাইনবোর্ড উর্দুতে লেখা হয়, মাওলানা ডেকে সাধারণ মানুষকে উর্দু শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। অপরদিকে এলাকার নাট্যদল শোষণের প্রতিবাদ হিসেবে নীলদর্পণ মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নেয়। সেই নাট্যদলেই নাসির ও দীপ্তির নতুন করে নিজেদের জানার সুযোগ ঘটে।
মূল গল্পের অল্পই গ্রহণ করা হয়েছে চিত্রনাট্যে। মাত্র একটি চরিত্রকেই তৌকীর গ্রহণ করেছেন, সেটি উর্দুভাষী পুলিশ অফিসার জমশেদ। গল্পে তার নাম আজীজ। এখানে তার চরিত্র গল্পের চাইতে জাঁদরেল, দেখতেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতো। কাজেই চিত্রনাট্য অনেকটা তৌকীর আহমেদের মৌলিকই। তবে ঐতিহাসিক পটভূমিকে ফুটিয়ে তুলতে সংলাপ কিছু জায়গায় বেশ নাটকীয়।
মূল চরিত্র জমশেদের ভূমিকায় ‘লাগান’-খ্যাত বলিউডের নামজাদা অভিনেতা যশপাল শর্মার দুর্দান্ত অভিনয়। নাসির ও দীপ্তির চরিত্রে সিয়াম আহমেদ এবং তিশা দুজনই সাবলীল অভিনয়ের চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য চরিত্রে রূপ দান করেছেন আবুল হায়াত, ফজলুর রহমান বাবু, ফারুক আহমেদ, সাজু খাদেম, শহীদুল আলম সাচ্চুর মতো কলাকুশলীরা।
সাধারণ গল্প। কিন্তু তৌকীর আহমেদের পরিচালনা, চিত্রগ্রহণ, পোশাক-পরিকল্পনা, আবহসংগীত ব্যবহারে নিরীক্ষা এবং সর্বোপরি কলাকুশলীদের কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়শৈলীর রূপায়ণ ঘটানোর ফলে এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ভিন্নতা যোগ করেছে। এই সিনেমার সূত্রে যশপাল শর্মা তৌকীরকে বাংলাদেশের ‘মাজিদ মাজিদী’ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন।
‘ফাগুন হাওয়ায়’ চলচ্চিত্রে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলের ব্যাপক ব্যবহারের পাশাপাশি প্রকৃতিকে ধারণ করা হয়েছে একই ফ্রেমে, তা অনেকটা সিম্বলিক। অবশ্য, এ ধরনের সিনেমাটোগ্রাফি তার অন্য সিনেমা, বিশেষত অজ্ঞাতনামা এবং হালদায়ও বেশ দৃষ্টি-আকর্ষক। ঐতিহাসিক সিনেমা নির্মাণ সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং, ব্যয়বহুলও। সেট ডিজাইন, কস্টিউম, আর্ট ডিরেকশন- সবকিছুতেই ছিল সময়কে ধরার প্রয়াস। সেদিক থেকে তৌকীরের দক্ষতা প্রশংসনীয়। আবহসংগীত এই চলচ্চিত্রের পরিপ্রেক্ষিত ও কালের অনুরণন তুলে আনতে সফল- এমন বলা যাবে না। তবে তা শ্রুতিকে প্রশান্তি দেয়।
ফাগুন হাওয়ায় বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচর ও সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। সে জন্য আমাদের আবেগ এই কাহিনিচিত্রের সঙ্গে জড়িত। তবে সিনেমার শিল্প ও নির্মাণশৈলী বিবেচনায় এটিকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য কাজই বলতে হয়।
প্রিয়ঙ্কর অর্ঘ
কুইজ
১ মূল গল্পের জমশেদের নাম কী?
ক. রাকেশ
খ. আজীজ
গ. আবুল কাশেম
ঘ. ফজলুল হক
২ সিনেমার গল্প গড়ে উঠেছে কোন শহরে?
ক. ঢাকা
খ. খুলনা
গ. চন্দ্রপুর
ঘ. মাধবপুর
৩ ভারতের কোন অভিনেতা এতে অভিনয় করেন?
ক. যশপাল শর্মা
খ. ঋত্বিক চক্রবর্তী
গ. ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়
ঘ. পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
গত পর্বের বিজয়ী
১. আরমান, শেওড়াপাড়া, ঢাকা। ২. সুপর্ণা বিশ্বাস, এন এস রোড, কুষ্টিয়া। ৩. সুহানা পারভীন, মালিবাগ, ঢাকা।