ফিচার I প্রাণিভাষা
মানুষের বাইরে আর সব প্রাণীরও রয়েছে ভাষা। তবে ভাব প্রকাশের চেয়ে জীবনপ্রবাহের তাগিদই এর মূল চালিকাশক্তি
প্রাণীর পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের প্রক্রিয়া যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনই জটিল। মূলত খাদ্যপ্রাপ্তি, যৌন আহ্বান এবং নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে বন্য প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। এ কাজে জন্তু, খেচর ও কীটেরা শরীরের রং, শব্দ উৎপাদন এবং অঙ্গভঙ্গির আশ্রয় নেয়। এসব ক্রিয়াকলাপকেই সাধারণ অর্থে প্রাণীদের ভাষা বলা যেতে পারে। তবে মানুষ বাদে কোনো প্রাণীরই পূর্ণাঙ্গ ভাষা নেই।
প্রাণিজগৎ এত বিস্তৃত যে সব প্রজাতির ভাবপ্রদানের বর্ণনা একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে কিছু চেনা প্রাণীর ভাষা নিয়ে আলাপ হতে পারে। যেমন কুকুর। খাবার দেখলে প্রাণীটি লেজ নাড়াতে থাকে। যার মানে ‘আমাকে খাবার দাও’। এই লেজের সঞ্চালনকেই কুকুরের ভাষা বলা যেতে পারে। প্রাণীটির ভাষা নিয়ে হাঙ্গেরিতে গবেষণাও হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, কুকুরেরা খুশি হলে ডান দিকে এবং দুঃখ পেলে বাম দিকে লেজ নাড়ে।
বানরদের ভাষা তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের। প্রাণীটির যোগাযোগব্যবস্থায় শব্দ, উচ্চারণ এমনকি উপভাষাগত বৈচিত্র্যের হদিস মিলেছে। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানীরা মানুষের উপভাষার মতোই বানরের ডাকে অঞ্চলভিত্তিক পার্থক্য পেয়েছেন। এই প্রাণীরা স্থান বদল করলে ওদের ডাকের ভঙ্গিও পরিবর্তিত হয়। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য প্রাণীর থেকে পাওয়া বার্তাও বুঝতে পারে বানর। এই সক্ষমতা উল্লুকদেরও আছে। গবেষণা চলেছে শিম্পাঞ্জিদের ওপরেও। প্রাণীটি পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য যেসব অঙ্গভঙ্গি করে, বিজ্ঞানীরা সেগুলোর মানে উদ্ধার করেছেন। ভাব প্রকাশের জন্য এরা মোট ৬৬ প্রকার ভঙ্গি করতে পারে। যেগুলোর মাধ্যমে প্রাণীটি ১৯ ধরনের বার্তা প্রেরণ করে। তবে উগান্ডার শিম্পাঞ্জিরা পাঁচ হাজার অর্থপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করতে সক্ষম।
ভাষার ব্যবহার দেখা যায় কোয়ালাদের মধ্যেও। পুরুষ প্রাণীটি যৌনমিলনকালে হাপরের মতো শব্দ তৈরি করতে থাকে। এটা বিশেষ বার্তা বহন করে। যার মানে, ‘আমি অন্যান্য পুরুষ কোয়ালার থেকে শক্তিশালী। সুতরাং এই নারী কোয়ালা থেকে সবাই দূরে থাকো’। হাপরের মতো শব্দ করেই পুরুষগুলো নারী কোয়ালাকে আকৃষ্ট করে। হাতিরাও পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন ধরনের শব্দগত সংকেত দেয়।
জলচর প্রাণীদের মধ্যেও ভাষার ব্যবহার ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন গবেষক অভিমত দিয়েছেন, ঠান্ডা পানির মাছেরা যেসব শব্দের মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করে, সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে। এক অঞ্চলের মাছেদের শব্দার্থ অন্য অঞ্চলের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। কড মাছের মধ্যে এমন শাব্দিক অর্থের তারতম্য ব্যাপকভাবে মেলে। এই প্রাণী শব্দ তৈরি করে মূলত বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করতে। তিমিরাও এভাবে যোগাযোগ করে। এ জলজ প্রাণীর সৃষ্ট শব্দ পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়। বিশেষ তরঙ্গের মাধ্যমে তিমিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। একই ধরনের ভাষা দেখা যায় ডলফিনদের মধ্যে। তবে শুধু শব্দ তৈরির মাধ্যমেই যে জলজ প্রাণীরা ভাব বিনিময় করে, তা নয়। স্কুইডের ভাষা ভিন্ন। এরা শরীরে রঙিন আলো জ্বেলে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করে। কিছুকাল আগে ভারতের বিজ্ঞানীরা এক প্রজাতির নৃত্যপটু ব্যাঙ খুঁজে পেয়েছিলেন। তারা এই উভচরের নাম দেন ‘ড্যান্সিং ফ্রগ’। নাচই ব্যাঙটির ভাষা। নৃত্যের সঙ্গে এরা এক প্রকার শব্দ করে সঙ্গিনীকে যৌন আহ্বান জানায়।
প্রাণিজগতের ভাষা-বৈচিত্র্যের মধ্যে কীটপতঙ্গের ভাব বিনিময় পদ্ধতি বেশ সূক্ষ্ম; বিশেষ করে মৌমাছি। নাচের মাধ্যমে এরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নৃত্যই এর ভাষা। মধু কোথায়, কত দূরে আছে- এসব বার্তার আদান-প্রদান হয় নাচের মাধ্যমেই। কোনো একটি মৌমাছি ফুল বাগানের সন্ধান পেলে প্রথমে চাকে ফিরে আসে। সেখানে এরা বেশ জ্যামিতিক একটি নাচ নাচে। তা দেখেই দর্শক মৌমাছিরা বুঝে যায় যে মধু কোথায় এবং কত দূরে আছে। এ উদ্দেশ্যে খাবারের খোঁজ পাওয়া মৌমাছিটি চাকে এসে বাংলা ৪-এর মতো ঘুরতে থাকে। তারপর ৪-এর লুপের অংশ দিয়ে একটি সরলরেখা বরাবর হাঁটে। রেখাটি যেদিকে নির্দেশ করে, সেদিকেই মধু আছে। কত দূরে আছে তা বোঝার জন্য রেখাটি ধরে মৌমাছিটি নাচতে থাকে। নৃত্যের সময় যত দীর্ঘ হবে, মধুপ্রাপ্তির স্থানের দূরত্ব ততই বেশি হয়। সাধারণত এক কিলোমিটার দূরত্ব বোঝাতে মৌমাছিটি এক সেকেন্ড ধরে নাচে।
পিঁপড়াদের ভাষাও জটিল। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এদের সহায়তা করে ফেরোমন নামের একধরনের রাসায়ানিক; যা প্রাণীটির শরীরে মজুত থাকে। পিঁপড়ার মাথার অ্যান্টেনা এই উপাদান চিহ্নিত করতে পারে। এক প্রজাতির ফেরোমন আরেক প্রজাতির পিঁপড়ার সঙ্গে মেলে না। উপাদানটি খাদ্য খোঁজার কাজে ব্যবহৃত হয়। মূলত এই ফেরোমন দিয়েই রচিত হয় পিঁপড়ার ভাষা। খাবারের খোঁজে বেরোবার পর একটি পিঁপড়া শরীরের শেষ প্রান্ত থেকে সামান্য ফেরোমন ফেলতে ফেলতে এগোয়। ফলে একটি রেখা তৈরি হয়। খাদ্য না পেলে সেই লাইন ধরেই গর্তে বা ঢিবিতে ফেরে। কিন্তু তা পেলে আগের রেখার মাঝে মাঝে আবারও ফেরোমন ফেলে ফিরে আসে। খাদ্য নিয়ে আসা প্রাণীটির রসদ অন্যদের পছন্দ হলে পিঁপড়ারা সেই রাসায়নিক রেখা ধরে বেরিয়ে পড়ে। খাবারের কাছে পৌঁছে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেরোমন রেখা বাতাসে উবে যায়; খাবার সংগ্রহও শেষ হয়। আরেক ধরনের ফেরোমন পিঁপড়াদের মধ্যে আক্রমণাত্মক ভাব ফুটিয়ে তোলে। ক্ষুদে প্রাণীটি রাসায়নিকটির নিঃসরণ ঘটায় এবং নিজেদের অ্যান্টেনা ও সম্মুখ পদজোড় দিয়ে সহকর্মীকে স্পর্শ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলে। তারপরই শুরু হয় তুমুল লড়াই।
জোনাকিদের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হলো আলো। মূলত যৌন-আকাঙ্ক্ষায় সাড়া পেতে এই পোকাগুলো আলো জ্বালে ও নেভায়। ভাষা আছে উইপোকারও। বিপদে পড়লে পোকাটি শরীর দিয়ে মাটিতে আঘাত করে। ফলে অন্যান্য উই সাবধান হয়ে যায়। এটিই এই পোকার ভাষা।
পিকক স্পাইডার সঙ্গিনীকে আকৃষ্ট করতে নাচে। তা ছাড়া এদের পেটে দুটি রঙিন অংশ আছে। বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গি করে এরা নিজের পেটের রং সঙ্গিনীকে দেখায়। কিছু মাকড়সা সুরেলা শব্দ তৈরির মাধ্যমে ভাব বিনিময় করে। যেমন গ্লাডিকোসা গুলোসা প্রজাতিগুলো। গাছের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে এরা একধরনের সুরেলা শব্দ তৈরি করে স্ত্রী মাকড়সাকে আহ্বান জানায়। সেই শব্দকম্পনের মাধ্যমে এক পাতা থেকে অন্য পাতায় সঞ্চারিত হয়ে সঙ্গিনীর কাছে পৌঁছায়।
কিছু কিছু পাখি তো মানুষের মতো কথা বলে। তা ছাড়া পাখিদের নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের ভাষা রয়েছে। আফ্রিকায় অ্যালেক্স নামের এক প্রজাতির তোতা মেলে। কথিত আছে, সেই প্রজাতির এক তোতার মৃত্যুর আগের রাতে পাখিটির মালিক সেটিকে বলেছিল, ‘আমি তোকে ভালোবাসি’। উত্তরে তোতাটি বলেছিল, ‘আমিও’।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট