ফিচার I লাভস্পট
প্রেমের অনুভূতি প্রকাশের স্থানও আছে। বিভিন্ন শহরে। বসন্ত উদযাপনই সেগুলোর প্রধান আকর্ষণ। প্রিয়জনকে নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো- তোমার
মনের মন্দিরে।
রবীন্দ্রনাথ এই গান লিখে গেছেন সেই কবে। বেলা গড়িয়েছে, তবু প্রেমিক হৃদয়ের এই আকুলতা রয়ে গেছে অকৃত্রিম। সময়চক্রে ভালোবাসার স্থান, কাল ও পাত্র পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রেম নিবেদনের সৌন্দর্য এখনো অটুট। যুগলেরা তাদের অনুভূতিকে প্রকাশের জন্য ছুটে যায় বিভিন্ন স্থানে। বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এমন কিছু দর্শনীয় জায়গা। যেগুলো প্রেমের নিদর্শনের জন্যই বহুল পরিচিত ও সমাদৃত। লাভস্পট নামেই সেগুলোর প্রসিদ্ধি। প্যারিস, ভেনিস, সুইজারল্যান্ড তো এ জন্যই বিখ্যাত। এ ছাড়া পৃথিবীতে এমন অনেক জায়গা আছে, যেগুলো জনসাধারণের চোখে এখনো সেভাবে পড়েনি। আবার এমন কিছু স্থানের খোঁজ পাওয়া যায়, যেগুলোকে প্রেমের তীর্থ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কেউ কেউ সেখানে পালন করে নানা ব্রত।
সিঙ্গাপুর
বাণিজ্যিক শহর হিসেবেই পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণ ঘটেছে এখানে। বিভিন্ন জাতি, ধর্মের মিলনে সংস্কৃতির নানা উপাদান মিলেমিশে গেছে এ দেশে। তাই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। দিনরাত আলোর রোশনাই বিমোহিত করে আগত পর্যটকদের। তবে খাওয়াদাওয়া ও শপিং বাদ দিয়েও প্রেমিক যুগলদের কাছে অন্য রকম আকর্ষণীয় স্থান হলো এ দেশের ক্লার্ক কোয়ে। সিঙ্গাপুর নদীর পাশে অবস্থিত স্পটটির মাঝখানে বিশাল হার্ট আকৃতির একটি স্থাপনা চোখে পড়বে। সেই হার্ট শেপের গ্রিলে লাগানো আছে অসংখ্য তালা। প্রেমিক যুগলেরা প্রেমকে দীর্ঘায়িত করার মনোবাসনা নিয়ে এখানে তালা লাগিয়ে চাবি ফেলে দেয় সিঙ্গাপুর নদীতে। তারা বিশ্বাস করে, এতে ভালোবাসা চিরজীবী হবে।
এ ছাড়া আরেকটি স্থানের সন্ধান পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরে। ফিলিপ স্ট্রিটে অবস্থিত ইউ লিওর দেবতার মন্দির ইউ হি চিং। চায়নিজ দম্পতিরা বিশ্বাস করে, দেবতার হাতে থাকা লাল সুতার একটি অংশ ছিঁড়ে পুরুষ ও নারীÑ দুজনের হাতের ছোট আঙুলে শক্ত করে বেঁধে রাখলে ভালোবাসার সম্পর্ক অটুট থাকবে চিরদিন।
প্যারিস, ফ্রান্স
দেশটিকে বলা হয় ভালোবাসার শহর। প্যারিসের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রেমের রঙ। এখানকার সিন নদীর লাভ লক ব্রিজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত। প্রেমিক যুগলেরাই নন, ব্রিজ পরিদর্শনে প্রতিদিন কয়েক হাজার দর্শনার্থী ভিড় জমান। পেছনেই রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত আইফেল টাওয়ার। লাভ লক ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে দর্শকেরা হারিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে। চারদিকে মনোহর পরিবেশ আর হাজার হাজার প্রেমিকের লাগানো তালার দিকে তাকিয়ে মনে হতে পারে অপার্থিব কিছু হয়তো আছে এখানে।
ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড শপিং মলে রয়েছে প্রেমের মন্দির। এখানকার ত্রিমূর্তি মন্দির স্থানীয়দের প্রিয়। তারা বিশ্বাস করে, এখানে দেবতারা প্রেমিকের সঙ্গীকে আশীর্বাদ করবেন। সেখানে প্রতিনিয়তই যুগলেরা হাজির হয় লাল গোলাপ, লাল সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি, ধূপকাঠি হাতে। তারা মন্দিরের বেদিতে লেখা প্রার্থনাটি পড়ে এবং বিশ্বাস করে, এর মধ্য দিয়েই লাভ করা যাবে অপার্থিব সুখ।
দ্য শার্ড, লন্ডন
প্যারিসের চেয়ে ১০ গুণ বড় শহর। সুসজ্জিত দালানকোঠা, দর্শনীয় স্থান, পার্ক, শপিং মলÑ কী নেই এখানে? লন্ডনের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং দ্য শার্ড। ডেটিংয়ের জন্য উপভোগ্য ও সুন্দর স্থান এর ছাদ। প্রায় নির্জন এই জায়গায় সঙ্গিনী নিয়ে উপভোগ করা যায় রাতের ঝলমলে শহর।
ক্লিফস অব মোহের, আয়ারল্যান্ড
দেশটির দক্ষিণ প্রান্তে আছে ক্লিফস অব মোহের। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ কিমি উঁচুতে অবস্থিত। আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। এখানকার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখতে পাওয়া ভার। এই সমুদ্রের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রিয়জনের হাত সারা জীবন ধরে রাখার আবেগ ও কল্পনায় ভেসে যাওয়া যায়!
দ্য প্যাপ অব গ্লেনকো, স্কটল্যান্ড
কোনটা বেশি কঠিন? আমি তোমাকে ভালোবাসি-এটা বলা? নাকি পাহাড়ে চড়া? দুটোই করতে চাইলে উঠতে হবে গ্লেনকোর চূড়ায়। এটি স্কটল্যান্ডের তো বটেই, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর উপত্যকাগুলোর একটি। ৫ ঘণ্টা টানা ট্র্যাকিংয়ের পর পেছনে ছবির মতন সুন্দর গ্রাম রেখে প্রিয়তমাকে নিয়ে চলে যাওয়া যায় এখানে।
অরেঞ্জ ট্রি গার্ডেন, এভারটন হিল, রোম, ইতালি
রোমে কাউকে প্রপোজ করা মানে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনা। কেননা সঙ্গিনীর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ শোনার চেয়ে বেশি শুনতে হবে ‘আমাকে ছবি তুলতে দাও তো!’ কষ্ট করে এত দূরে এসে নিশ্চয়ই এটি শুনতে চাইবে না কেউ। তাই চলে যাওয়া যেতে পারে বিখ্যাত কমলা বাগানে। পিকনিক স্পট এবং আংটি বদলের জন্য এমন ভালো জায়গা দুর্লভ।
লেক অব লাভ, বুর্জেস
লেকসাইড পিকনিকের জন্য উপযুক্ত জায়গা ‘লেক অব লাভ’। এর চারপাশ চূড়ার মতো বিল্ডিং এবং সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা। লেকের এমন নামকরণের পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। লোকমুখে শোনা যায়, অনেক দিন আগে মীনা নামের স্থানীয় এক মেয়ে বিরোধী আদিবাসী দলের এক ছেলেকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু বংশের বিরোধিতা তাদের এক হতে দেয়নি। তাই ভগ্ন হৃদয় নিয়ে মেয়েটি এই লেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। প্রচলিত আছে, যদি কেউ লেকটি ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে ওপারে গিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে চুম্বন করে আসে, তাহলে তারা সারা জীবন একসঙ্গে থাকবে।
নর্দান লাইটস, আইসল্যান্ড
দেশটির নর্দান লাইটসের নিচের জায়গাটি প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। তবে এখানে আসার সময় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল। কেননা, তখন আকাশ একদম মেঘমুক্ত থাকে। আর মেঘ যত কম হবে, তত বেশি আলোর খেলা দেখা যাবে। প্রিয় মানুষের হাত ধরে এই আলোর মায়া দেখা অনাবিল আনন্দের!
ইমেরোভিগলি, সান্তোরিনি, গ্রিস
সূর্যাস্তের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় গ্রিসের সান্তোরিনিতে। মাত্র ৪৭০টি বাড়ি রয়েছে এই এলাকায়। শ্বেতশুভ্র ভবনগুলোকে দেখলে মনে হবে এই শহর প্রকৃতির অংশ। সব সময়ই এখানে শান্ত-শীতল পরিবেশ বিরাজ করে। সঙ্গীকে নিয়ে একান্তে কিছু সময় কাটানোর জন্য একদম সঠিক জায়গা এই নীল গম্বুজের শহর। সাদা আর নীলের ছোঁয়ায় মনের গতি মন্থর হয়ে যায়। অস্থিরতার এই যুগে প্রেমের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর কোথায় মিলবে?
হাগে, দক্ষিণ কোরিয়া
বসন্তে স্থানটি চেরিফুলে ছেয়ে যায়। চেরি আর মৃদুমন্দ বাতাস চারদিক আচ্ছন্ন করে রাখে। মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া বসন্ত-উৎসবের আমেজ চলতে থাকে দক্ষিণ কোরিয়ার এই শহরে। হাগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো দুপাশে সারি সারি চেরি বেষ্টিত চেরি ব্লসম রোড, যা ওয়েডিং রোড হিসেবেও বিখ্যাত। কথিত আছে, এই সড়কে প্রিয়জনের হাত ধরে হেঁটে বেড়ালে তা প্রণয় থেকে পরিণয়ে রূপ নেয় এবং তারা অত্যন্ত সুখেই জীবন অতিবাহিত করে।
I সাবরিনা মুন্নী
ছবি: ইন্টারনেট