রূপরসদ I চুলযত্নের নতুন উপায়
ত্বকের পরিচর্যায় ব্যবহৃত উপাদান কাজে লাগে চুলের যত্নে। শুধু তা-ই নয়, স্ক্যাল্পের সুরক্ষায়ও তা কার্যকর। লিখেছেন শিরীন অন্যা
বন্ধুর পার্সের লিপস্টিক অথবা কমপ্যাক্ট পাউডার ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা প্রায় সব মেয়ের আছে। এটি সৌন্দর্যসামগ্রী ব্যবহারকারীদের মধ্যেই ঘটে এমন নয়; ধার নেওয়ার প্রবণতা বিউটি ইন্ডাস্ট্রিরই অংশ। নইলে কি আর সৌন্দর্যবিশেষজ্ঞরা ত্বকের যত্নের উপাদানগুলো চুলের পরিচর্যায় কাজে লাগানোর কথা ভাবতে পারতেন?
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কিংবা ক্যাটাগরির প্রডাক্টের মধ্যে মূল উপাদানগুলো ধার করে ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৭ সালের দিকে প্রথম কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রিতে এটি শুরু হয়। যেসব উপাদান শুধু ক্রিম তৈরিতেই ব্যবহৃত হতো, সেগুলোর ব্যবহার শুরু হয় কমপ্যাক্ট পাউডারে। স্কিন পিউরিফাইয়িংয়ের দুটি মূল উপাদান ক্লে আর চারকোল- ব্যবহৃত হতে শুরু করে দাঁত ঝকঝকে কিংবা মাড়ি শক্ত করার উপাদান হিসেবে। সম্প্রতি ত্বক পরিচর্যার কিছু উপাদান যে চুলের যত্নেও বেশ কার্যকর, তারই প্রমাণ পান বিশেষজ্ঞরা।
মুখত্বক প্রোটিনযুক্ত জীবিত কোষের ভান্ডার। ত্বকের কোনো ক্ষতি হলে স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়ায় ত্বক নিজেই তা নিরাময়ের ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে চুল হলো মরাকোষ, মূলত যে অংশটা বিভিন্ন স্টাইলে রাঙিয়ে তোলা হয়। তাহলে কোন উপায়ে এর যত্নের উপাদানগুলো এক হতে পারে! চুলের মূল অংশ থাকে স্ক্যাল্পের নিচে। গঠন এক না হলেও এটি ত্বকেরই অংশ। স্ক্যাল্পের কোষগুলো জলদি হেয়ার ফলিকলের প্রজনন ঘটায় এবং হেয়ার ফাইবার অর্থাৎ চুল মাথার ত্বক বা গোড়া থেকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। কাজেই কোনোমতে একবার গোড়া থেকে গজিয়ে গেলেই চুলের বাইরের অংশ হয়ে যায় নিষ্প্রাণ। এ জন্যই বিশেষজ্ঞরা সব সময় চুলের গোড়া থেকে যত্ন নেওয়ার কথা বলে থাকেন। এখানেই ত্বক পরিচর্যার উপাদানগুলো কাজে লাগে।
হিলিং হাইড্রেশন
আগেই বলা হয়েছে, স্ক্যাল্প ত্বকের একটি প্রসারিত অংশ। স্বাভাবিক ত্বকের মতো একই ধরনের লিপিড আর হিউম্যাকটেন্ট রয়েছে স্ক্যাল্পে, উভয়েই শুষ্কতা কিংবা চুলকানির প্রবণতা তৈরি করে। তাই স্ক্যাল্পও ত্বকের মতো ডিহাইড্রেশনে ভোগে। বিশেষ করে যখন স্ক্যাল্পের কিউটিকলগুলো তাপ, কেমিক্যাল কিংবা পানির অস্বাস্থ্যকর উপাদানের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। হায়ালুরনিক অ্যাসিড এবং সিরামাইডের মতো পদার্থ ত্বকে আগে থেকেই বিদ্যমান। এসব উপাদান ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। অসংখ্য ক্রিম কিংবা সেরামে এই দুটির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যেগুলো ত্বককোষের কার্যকলাপ বাড়িয়ে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে, সে কারণে উপাদান দুটি স্ক্যাল্পের সুস্থতায়ও ভূমিকা রাখে। তবে চুলের জন্য লিভ-অন প্রডাক্টগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকর। এই দুটি উপাদান একদিকে চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে, অন্যদিকে অতিরিক্ত তাপে ঢাল হয়ে চুলকে রক্ষা করে। যেখানে অন্যান্য প্রডাক্ট শুধু চুল নরম কিংবা মসৃণ করার পন্থা খুঁজতে থাকে, সেখানে এই উপাদানগুলো ভেতর থেকে পুষ্টি জোগায়, স্ক্যাল্পের কিউটিকল শক্ত আর মজবুত রাখে। এগুলো ছাড়াও নারকেল তেল কিংবা প্যান্থেনলও স্ক্যাল্পে সুস্থতা আনে।
হেয়ার অ্যান্টিএজিং
বংশগত বৈশিষ্ট্য কিংবা সামগ্রিক শারীরিক গঠন ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে চুলের বয়স বেড়ে যাওয়া। বিশেষত মেনোপজের শুরুতেই স্ক্যাল্পের ফলিকলগুলো সংকুচিত হতে থাকে, ফলে চুল পাতলা হয়ে যায়। এমনকি ভঙ্গুরতা বাড়ে আর পিগমেন্ট উৎপাদন বন্ধ হয়ে চুল পাকতে শুরু করে। ইউভি রশ্মি, যা ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়ার কারণ, চুলের পুষ্টি আর রঙেও তা প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে স্ক্যাল্পের কোষের সঞ্চালন কমে যাওয়ায় অতিরিক্ত তেল জমার প্রবণতা তৈরি হয়। এসবই চুলের বুড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ। কোলাজেন এবং ইলাস্টিন প্রোটিন এ ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক। এগুলো আটকে থেকে স্ক্যাল্পের প্লাম্পিং আর চুলের মসৃণতা নিশ্চিত করে। পেপটাইডস বুড়িয়ে যাওয়া চুলের জন্য বেশ উপকারী, যা ত্বকে কোলাজেনের উৎপত্তি প্রসারে সহায়ক। ঠিক যেমনটা ত্বকের ক্ষেত্রে পেপটাইডস বলিরেখা কিংবা চামড়া ঝুলে যাওয়া প্রতিরোধ করে। ডার্মাটোলজিস্টদের মতে, দুর্বল স্কিন সার্কুলেশন আর স্ক্যাল্পের কারণে পাতলা হয়ে আসা চুলের জন্য পেপটাইডস মহৌষধ। এটির পাশাপাশি তারা বিভিন্ন এসেনশিয়াল অয়েল যেমন ল্যাভেন্ডার, অরেঞ্জ কিংবা লেমন পিল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। কারণ, এগুলো স্ক্যাল্পের মাইক্রো সার্কুলেশন বাড়িয়ে চুলের গোড়ায় এবং বাল্বে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
কমব্যাটিং পলিউশন
প্রতিদিনই ত্বকের মতো চুলও পানি কিংবা বাতাসে থাকা বিভিন্ন ধরনের দূষিত উপাদানের সম্মুখীন হয়। ধূলিকণা, ধোঁয়া, নিকেল, সিসা, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মতো উপাদানসহ সব ধরনের দূষণ মাথার ত্বকে ও চুলে জমতে থাকে। এতে উল্লেখযোগ্য প্রদাহ, শুষ্কতা, নিস্তেজতা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমনকি চুল পড়ার কারণও হয়ে দাঁড়ায়। ধূমপান ও জারণ চাপের কারণে বয়সের আগেই পেকে যেতে শুরু করে। শুধু দূষিত মৌল ছাড়াও অতিরিক্ত কেমিক্যাল কিংবা তাপমাত্রার প্রয়োগও চুলের পক্ষে এক প্রকার দূষণই বলা চলে। চ্যালেটিং এজেন্টযুক্ত শ্যাম্পু স্ক্যাল্পে জমে থাকা সব দূষিত পদার্থ বের করে নিয়ে আসবে। পরিমিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত লিন-ইন প্রডাক্ট যেমন- ভিটামিন, টি এক্সট্রাক্ট কিংবা রেজভারেট্রল ইত্যাদি চুলে কিংবা চুলের ত্বক এবং দূষিত কণাগুলোর মাঝে একটা বাধা সৃষ্টি করে, যা স্ক্যাল্পে দূষণ আটকে থাকার সুযোগই দেয় না। অর্থাৎ সুন্দর চুলের মূলমন্ত্র হলো স্ক্যাল্প সুস্থ রাখা। মাথার ত্বকের যত্ন না নিয়ে শুধু ওপরে ওপরে যত প্রডাক্টই ব্যবহার করা হোক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদে আসলে ওই সব উপাদানই কাজে আসে, যেগুলো চুলে এবং মাথার ত্বকে ভেতর থেকে পুষ্টি জোগায় এবং বিপজ্জনক সব উপাদানের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।
মডেল: প্রেজুয়াল
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দিন