ফিচার I ময়শ্চার স্যান্ডউইচ
ত্বক আর্দ্র রাখার নতুন এক উপায়। আটটি ধাপে পরিচর্যার কৌশল। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
স্কিনকেয়ার ট্রেন্ডে বরাবরই নতুন কিছু যোগ হচ্ছে। সব ধারা বেশি সময়ের জন্য টিকে থাকে না। কিন্তু স্কিনকেয়ার দুনিয়ার নতুন বাজওয়ার্ড ‘ময়শ্চার স্যান্ডউইচ’ মনে হচ্ছে অনেক দিন থেকে যাবে। কারণ, এটি অতিরিক্ত শুষ্ক ত্বকের আলটিমেট সলিউশন। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার সবখানে এই বিউটি রুটিনের প্রশংসায় ভাসছেন স্কিন ইনফ্লুয়েন্সাররা।
বেশির ভাগ স্কিনকেয়ার ট্রেন্ডের মতো ‘ময়শ্চার স্যান্ডউইচ’ টার্মটি এসেছে জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট রেডিট থেকে। তিন বছর আগে এটি সম্পর্কে প্রথম শোনা যায়। তখন কোনো কারণে খুব বেশি সাড়া ফেলেনি। এ বছরের শুরুতে আবার স্কিনকেয়ার রাডারে ময়শ্চার স্যান্ডউইচ নামটি বারবার দেখা যেতে থাকে। এর জন্য অবশ্য ধন্যবাদ জানাতে হবে জিউ (উরবীঁ) স্কিনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও শার্লট পালেরমিনোকে। সম্প্রতি এই স্কিন ইনফ্লুয়েন্সার তার ইনস্টাগ্রাম রিলের মাধ্যমে মুখ ও ঠোঁটের প্রডাক্টগুলো দিয়ে লেয়ার তৈরি করে স্কিন ড্যাম্পেনিংয়ের সুফল সম্পর্কে হাইলাইট করেন। ময়শ্চার স্যান্ডউইচ আসলে সব হাইড্রেটিং প্রডাক্ট দিয়ে ত্বকে লেয়ার তৈরি করে আর্দ্রতা ধরে রাখার পদ্ধতি। এখানে পাতলা ওয়াটার-বেসড প্রডাক্ট দিয়ে শুরু করে শেষ হয় একটা ভারী ঘন ময়শ্চার লেয়ারের মাধ্যমে। এতে ত্বকে পানি দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকা পড়ে। ফলে অতি শুষ্ক ত্বক আর্দ্র এবং উজ্জ্বল হবে।
টু মেক আ স্যান্ডউইচ!
শার্লট তার ইনস্টাগ্রামে ময়শ্চার স্যান্ডউইচের যে পদ্ধতি দেখিয়েছিলেন, তা খুব সিম্পল। ট্যাপ ওয়াটার-সেরাম-ময়শ্চারাইজার-ওক্লুসিভ। আর ঠোঁটের জন্য ট্যাপ ওয়াটার-ময়শ্চারাইজার-লিপ বাম। ইতিমধ্যে স্কিনকেয়ার এক্সপার্টরা ময়শ্চার স্যান্ডউইচ করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি বের করেছেন, যাতে রয়েছে অনেকগুলো ধাপ।
স্টেপ ওয়ান: ময়শ্চার
স্যান্ডউইচের প্রতিটি ধাপে আর্দ্রতা নিশ্চিত করতে হবে। সেটা শুরু ক্লিনজারের মাধ্যমে। যেকোনো ত্বকচর্চার প্রথম ধাপ হলো ভালোভাবে মুখ পরিষ্কার করা। ময়শ্চার স্যান্ডউইচ শুষ্ক ত্বকের জন্য, কাজেই উপযোগী ক্লিনজার বেছে নিতে হবে, যা ত্বকের ধুলাবালি পরিষ্কার করার পরও সেখানে একটা ময়শ্চার লেয়ার রেখে যাবে। এ ধরনের ত্বকের জন্য সবচেয়ে ভালো হাইপোঅ্যালারজেনিক, ফ্র্যাগন্যান্স ফ্রি, নন-অ্যালকোহলিক এবং নন-ফোমিং ফর্মুলার ক্লিনজার। সালফেট, সোডিয়াম লরিল সালফেট, স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, গ্লাইকোলিক অ্যাসিড, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়ালস (যেমন ট্রাইক্লোসান), প্যারাবেনের মতো উপাদানগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। এগুলো ত্বককে আরও বেশি শুষ্ক করে দেয়। এমন ক্লিনজার বাছাই করতে হবে, যা ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স করবে। ত্বকের ওপরে ‘অ্যাসিড ম্যান্টেল’ নামের একটি পাতলা প্রতিরক্ষা স্তর রয়েছে। যাতে থাকে সিবাম, যা ঘামের ল্যাকটিক অ্যাসিড, অ্যামিনো অ্যাসিডের সঙ্গে মিশে পিএইচ তৈরি করে। এর মাত্রা ৫.৫ (সামান্য অ্যাসিডিক)। একটি আদর্শ ক্লিনজার সব সময় ত্বকে এই পিএইচের মাত্রা ঠিক রাখবে। ত্বক আর্দ্র করে এমন প্রাকৃতিক উপাদানযুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার জরুরি। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো শিয়া বাটার, ওটমিল, অ্যালোভেরা। এ ছাড়া অতিরিক্ত শুষ্ক ত্বকে হায়ালুরনিক অ্যাসিড, গ্লিসারিন, সেরামাইড, নিয়াসিনামাইড আছে এমন ক্লিনজার বাছাই করা দরকার।
স্টেপ টু: টোনার
এ ধাপে টোনার দিয়ে ত্বক টোনআপ করতে হবে। ত্বকে পানি লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে এটি দিতে হয়। টোনার ত্বকের পিএইচ বজায় রাখে এবং রক্তসঞ্চালন বাড়ায়। ফলে পরবর্তীকালে ত্বকে যে প্রডাক্ট মাখানো হবে, তা সহজে গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। শুষ্ক ত্বকের জন্য অবশ্যই অ্যাসট্রিনজেন্টস, অ্যালকোহল মুক্ত টোনার বাছাই করা দরকার। কারণ, এটি ত্বককে ডিহাইড্রেট করে। এ ধরনের ত্বকের জন্য দরকার ওয়াটার-বেসড টোনার, যাতে আছে হায়ালুরনিক অ্যাসিড, গ্লিসারিন, সেরামাইড (প্ল্যান্ট-বেসড) ভিটামিন ই। ক্লিনজারের মতো এড়িয়ে চলতে হবে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, গ্লাইকোলিক অ্যাসিডের মতো উপাদান। কারণ, এগুলো শুষ্ক ত্বকের জন্য খুব জরুরি। চাইলেই ঘরে বানানো টোনার মাখানো যায়। গোলাপজল, শসার রস, অ্যালোভেরা, চাল ধোয়া পানি, বেদানার রস ইত্যাদি ত্বক টোনিং করতে অনেক বেশি কার্যকর। মিস্ট বোতল বা তুলার প্যাডের সাহায্যে মাখাতে হবে। এর পর পাঁচ থেকে সাত মিনিটের ভেতর মুখে আর কিছু মাখানো যাবে না।
স্টেপ থ্রি: এসেন্স
এর প্রধান কাজ ত্বক আর্দ্র করে ভেতর থেকে উজ্জ্বলতা দেওয়া। এটি ওয়াটার-বেসড এবং খুব হালকা ধাঁচের হয়ে থাকে। ত্বককে রিজেনারেট এবং স্কিনকেয়ার রুটিনের পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত করে। এসেন্সের প্রধান উপাদান হিসেবে বেছে নিতে হবে হায়ালুরনিক অ্যাসিড। তবে এর চেয়েও ভালো পলিগ্লুটামিক অ্যাসিড। এটি হায়ালুরনিক অ্যাসিডের চেয়ে ত্বকে চার গুণ বেশি আর্দ্রতা দেয়। এসেন্স ব্যবহারের পরপরই পরবর্তী স্কিনকেয়ার প্রডাক্ট মাখাতে হবে। এসেন্স ব্যবহার প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে পারফেক্ট ময়শ্চার স্যান্ডউইচ তৈরি করতে চাইলে এ ধাপ স্কিপ করা যাবে না।
স্টেপ ফোর: হাইড্রেটিং মিস্ট
ত্বককে খুব দ্রুত হাইড্রেট করতে ফেস মিস্ট ব্যবহৃত হয়। এটি ওয়াটার-বেসড স্কিনকেয়ার প্রডাক্ট। অনেকে টোনারের সঙ্গে মিস্টকে গুলিয়ে ফেলে। দুটি মোটেও এক জিনিস নয়। এদের মিল শুধু ঘনত্বে। টোনার বেশ সময় নিয়ে ত্বকে পুষ্টি জুগিয়ে ত্বক আর্দ্র করে এবং পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখে। আর এই একই কাজ করে ইনস্ট্যান্টলি। প্ল্যান্ট-বেসড ফেস মিস্ট শুধু শুষ্ক নয়, সব ত্বকের জন্যই ভালো। তাই ময়শ্চার স্যান্ডউইচে এ ধাপটি না করলেই নয়।
স্টেপ ফাইভ: সেরাম
সেরাম অনেকটা ত্বকের মেডিসিন। ত্বকে কোনো সমস্যা থাকলে ট্রিটমেন্টের জন্য অবশ্যই সেরাম ব্যবহার করতে হবে। ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্কতাও একধরনের গুরুতর অবস্থা। তাই এ ধাপ এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শুষ্ক ত্বকের জন্য হাইড্রেটিং সেরাম মাস্ট। আর এটি হতে হবে প্ল্যান্ট-বেসড অ্যাকটিভ উপাদান সমৃদ্ধ। তৃষ্ণার্ত শুষ্ক ত্বকে বেছে নিতে হয় আরগান অয়েল, গ্লিসারিন, হায়ালুরনিক অ্যাসিড, অ্যালোভেরা, রোজহিপ অয়েল, সেরামাইড, গোলাপজল, জোজোবা, ভিটামিন ই আছে এমন সেরাম।
স্টেপ সিক্স: ফেস মিস্ট
এক্সট্রা হাইড্রেশনের জন্য এ ধাপে আবার ফেস মিস্ট মাখাতে হবে।
স্টেপ সেভেন: ময়শ্চারাইজার
ময়শ্চার স্যান্ডউইচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ময়শ্চারাইজার বা হাইড্রেটর। অতিরিক্ত শুষ্ক ত্বকের জন্য ভারী ওয়াটার-বেসড ক্রিম বা জেল মাখাতে হবে। এর প্রধান উপাদান হিসেবে বেছে নিতে হয় হায়ালুরনিক অ্যাসিড, ডাইমেথিকোন, গ্লিসারিন, প্রপিলিন গ্লাইকোল, সরবিটল, প্রোটিনস বা ইউরিয়া। এসব উপাদান ত্বক আর্দ্র করে। আর ময়শ্চারাইজারে ল্যানোলিন, মিনারেল অয়েল বা পেট্রোলিয়াম—এ তিনটি উপাদান অথবা এর কাছাকাছি কিছু থাকতে হবে। কারণ, এগুলো ত্বকের ময়শ্চার ধরে রাখতে সহায়তা করে।
স্টেপ এইট: ফেশিয়াল অয়েল
একদম শেষ ধাপ হচ্ছে ভারী ফেশিয়াল অয়েল বা বাটার মাখানো। এতে ময়শ্চার পুরোপুরি লক হয়। এখানে নিজের পছন্দমতো অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন কোকোনাট অয়েল, আমন্ড অয়েল, জোজোবা অয়েল, আরগান অয়েল, অলিভ অয়েল। এ ছাড়া ব্যবহার করা যেতে পারে শিয়া বাটার, কোকো বাটার বা ম্যাংগো বাটার। এ বাটারগুলো ননস্টিক। একদম খুব সহজে ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে ময়শ্চার লক করে দেয়। বাড়তি পুষ্টির জন্য অয়েল বা বাটারের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা গ্লিসারিন এবং ভিটামিন ই অয়েল মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
সতর্কতা
ময়শ্চার স্যান্ডউইচের সময় কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এ স্কিনকেয়ার রুটিনের জন্য নন-কমেডোজেনিক প্রডাক্ট বেছে নিতে হবে। এ ধরনের প্রডাক্ট ত্বকের পোর বা লোমকূপ ব্লক বা ক্লগ করে না। রেটিনল এবং এক্সফোলিয়েটিং কেমিক্যাল ব্যবহার করা যাবে না। ত্বকে ময়শ্চার লক করতে গিয়ে আবার ‘স্লাগিং’ করা যাবে না। কারণ, ভ্যাসলিন ত্বকের সিবাম, ডেড স্কিন এবং ব্যাকটেরিয়া আটকে ফেলে, ত্বকে ব্রণের মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
মডেল: সূর্য
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: তানভীর খান