কভারস্টোরি I বিবাহ পসরার নিউ নরমাল
করোনাজনিত সামাজিক স্থবিরতার কাল পেরিয়ে জীবন সেজে উঠছে নতুন করে। বিয়ের মৌসুমেও তার স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছুই কি আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে? বিয়েকে কেন্দ্র করে বিচিত্রমুখী যে বাণিজ্য তাতে কি দেখা যাচ্ছে আগের রমরমা? এসব প্রশ্নের জবাব লিপিবদ্ধ করেছেন সারাহ্ দীনা, ফাহমিদা শিকদার, গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত ও সালেহীন রানা
১.
করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের সব দেশের মতো আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। আয়ের ওপরে যেহেতু ব্যয় নির্ভরশীল, তাই বেকারত্ব, বেতনের অংশ কেটে নেওয়া, চাকরি হারানোর আশঙ্কা— প্রতিটি খাতের ওপরে ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। দেশের বিয়ের পোশাকের বাজারও এর বাইরে নয়।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ে সম্পন্ন হয় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে।
অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, সামাজিক অবস্থান, রুচি এবং চাহিদার ওপরে নির্ভর করে বলা যেতে পারে, বিয়ের বাজারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কয়েকটি ভাগ রয়েছে। দেশের বাইরে শপিংয়ে আগ্রহী এমন পরিবার রয়েছে। অনেকে দেশের ডিজাইনার ওয়্যারকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অনেক ক্রেতা খুচরা পণ্য কিনে থাকে লোকাল শপিং মল থেকে। দেশে থেকে অন্য দেশের আমদানি করা পণ্য কিনতে চায়, এমন ক্রেতাও কম নয়। মিশ্র ভাবনার ক্রেতা নিয়ে আমাদের দেশের বিয়ের পোশাকের বাজার গড়ে উঠেছে।
ফ্যাশনবিষয়ক সংবাদের বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক প্রথম আলো (ফিচার, অনলাইন) এর ডেপুটি এডিটর শেখ সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ বিয়ের পোশাকের কেনাকাটার ক্ষেত্রে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে শপিং করে থাকেন, এমন একটি দল এখানে রয়েছে। আবার এ দেশে বসেই বাইরের দেশের পোশাক কিনে নেন এমন দেখা যায়। এর বাইরে রয়েছে আমাদের দেশের ডিজাইনার, তাঁতিদের তৈরি পোশাক কেনে এমন পরিবার। অর্থাৎ এক ভাগ বিয়ের ফ্যাশনে দেশীয় কাপড়ে কেনাকাটা সম্পন্ন করে। আমাদের দেশের নিজস্ব বুনন পদ্ধতি রয়েছে, আরও আছে নিজস্ব নকশায় তৈরি জামদানি; যা লাক্সারি প্রোডাক্ট হিসেবে বিবেচ্য। বেশির ভাগ বিয়ের আয়োজনে শপিংয়ের ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা সময় রেখে তবেই তারিখ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এই সময়ের মধ্যে ডিজাইনারের পরামর্শ নিয়ে নিজের পছন্দের নকশাতেও জামদানি বুনে নেওয়া সম্ভব। আমাদের দেশের ফ্যাশন ডিজাইনাররাও বেশ পারদর্শী বিয়ের পোশাক তৈরিতে। তাদের ওপরে নির্ভর করে দেশেই শপিং সম্ভব।’
টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির বাংলাদেশি শাড়ি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বহু বছর ধরে। এর স্বত্বাধিকারী মুনিরা এমদাদ বলেন, ‘বিয়ের আয়োজনের আকার সীমিত হয়েছে, ছোট হয়েছে কেনাকাটার লিস্ট। তারপরেও করোনাকাল এবং এবারের বিয়ের বাজারে মিরপুর কাতানের চাহিদা দেখা যাচ্ছে। দামের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম চাহিদা দেখতে পাচ্ছি। ক্রেতা নিজের সামর্থ্য ও চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কেননা বেশ কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে এই শাড়ির। জামদানির চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম অনুভূত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বিয়ের আয়োজনের পরিসর কমে আসাকে মনে করছি।’
বিশিষ্ট ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক বলেন, করোনাকাল থেকে বিয়ের পরিসর ছোট হতে শুরু হয়েছে। আয়োজন সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে শপিংয়ের প্রভাব পড়েছে। যেমন অনেকে শেরওয়ানি না কিনে পাঞ্জাবিতেই শপিং শেষ করেছেন। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। আমাদের দেশের হিসাব অনুযায়ী সামনেই বিয়ের সিজন। এখন বিয়ের পোশাকের বেশ চাহিদা দেখতে পাচ্ছি। তবে আমাদের দেশের মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বায়নের যুগে আমরা বাস করছি। এখন মুক্তবাজারের সময়। দেশের বাইরের পোশাক যেমন দেশে আসছে, তেমনি দেশ থেকেও পাশের দেশে যাচ্ছে আমাদের শাড়ি। বিয়ে একটি পারিবারিক বন্ধনের উৎসব। বিয়ের পোশাক নিয়ে স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখা যায় উৎসবে। একসময় আমাদের দেশের মানুষের বিয়ের স্বপ্ন মানেই ছিল লাল রঙের শাড়ি পরিহিত কনে। বিয়ের কনের সাজের কথা ভাবলেই চোখে ভেসে উঠত নজরুলের গীতিমালার লাইন ‘লাল টুকটুকে বৌ যায় গো, লাল ন’টের ক্ষেতে যে তার আলতা পায়ের চিহ্ন এঁকে নালতা শাকের গাঁয় গো।’
দেশের মানুষ পরিচিত হয়েছে বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে। সেখানকার আয়োজনকে আকর্ষণীয় মনে করে সেখান থেকে ধারণ করেছে বেশ কিছু বিষয়। সেগুলোর মধ্যে পোশাক একটি। ঘাঘরা-চোলি, সারারা, ঘারারা বর্তমানে জনপ্রিয় পোশাক হিসেবে নন্দিত। পোশাক প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু পরিবর্তন। এখানে লেহেঙ্গার সঙ্গে একটি ওড়না ব্যবহৃত হচ্ছে তুলনামূলকভাবে বেশি, যেখানে ভারতে আমরা দেখতে পাচ্ছি দুটি ওড়নাকে শাড়ির আঁচলের মতো করে স্টাইলিং করতে; যা কনেকে শালীন একটি লুক এনে দেয়। আমাদের দেশে একটি ওড়নার ব্যবহারের স্টাইলিং জনপ্রিয়। এখনকার মূল্যবোধের সঙ্গে এখানে একটি পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি। বিয়ের শালীন কমনীয় সৌন্দর্য এখানে কিছুটা ম্লান বলেই আমার মনে হয়।’
বরের পোশাকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শেরওয়ানির চাহিদা বেশ। আমার কাছে যারা আসেন, তাদের দেশি ফ্যাব্রিকে শেরওয়ানি বানাতে উৎসাহিত করি। আমাদের দেশের জামদানি লেয়ার করে প্রচুর শেরওয়ানি এবং শেরওয়ানি কাট পাঞ্জাবি তৈরি করেছি। এর বাইরে অরগ্যাঞ্জা, পিওর এন্ডি, ধুপিয়ান, মিরপুর কাতান ব্যবহারে দারুণ সুন্দর শেরওয়ানি তৈরি করা সম্ভব। এর সঙ্গে একটি শালকে পেয়ার করে দিতে পছন্দ করি। এ ক্ষেত্রে টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবহার করে বর্ডার দিয়ে শাল তৈরি করে থাকি। এসবের বাইরে পাগড়ি তৈরি করে নিতে আসেন অনেকে। পাগড়িতে ভারী অলংকরণ করে থাকি।’
আমাদের দেশে উৎপাদিত শাড়ি সম্পর্কে এই ডিজাইনার বলেন, ‘দেশে সাধারণ মানুষের সংখ্যা বেশি এবং তারা কেনাকাটার ক্ষেত্রে মিরপুর কাতানকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে বিয়ের ফ্যাশনে বলিউডি চলচ্চিত্রের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। লক্ষ করেছি, দেশের বেশ কিছু অভিজাত শপিং মলে দেশের শাড়িকে ভারত থেকে আমদানি করা শাড়ি বলে চড়া দামে বিক্রি করা হয়ে থাকে। এ নিয়ে সরাসরি দোকানিকে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। একটা সময় পর্যন্ত বিয়ের কনের স্যুটকেসে একটি জামদানি ছিল রীতির অংশ। সে ধারা আগের মতো দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের নিত্যদিনের শাড়ি এখন আনুষ্ঠানিক পোশাকে পরিণত হয়েছে।’
এখন ডিজাইনার ব্রাইডাল ওয়্যারের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। ফ্যাশন ডিজাইনার সারা করিম দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছেন এ নিয়ে। করোনাকাল এবং এর পরবর্তী সময়ের বিয়ের বাজারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার প্রভাবে বিয়ের পরিসর খানিকটা ছোট হয়ে এসেছে। গেল বছর অন্য দেশে যাতায়াত সেভাবে সম্ভব না থাকায় অনেকেই দেশের ডিজাইনারদের কাজ কেমন, সে বিষয়ে জানার আগ্রহ দেখিয়েছে। বেড়েছে চাহিদা। নিজ দেশ যে পিছিয়ে নেই, সে তথ্য এখন ক্রেতাদের কাছে বেশ স্পষ্ট। গুণগত দিকে আন্তর্জাতিক মানের পোশাক ক্রেতারা এখন নিজ দেশেই পেতে পারে, এটা তারা জেনেছে। ক্রেতার চাহিদাতেও এসেছে পরিবর্তন। কোনো বাধাতে আটকে নেই। রং, প্যাটার্ন, অলংকরণ— সব ক্ষেত্রেই ক্রেতা এখন নিজের রুচির প্রকাশ চায়। কালো রংকে একসময় বিয়ের মতো শুভ অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার রীতি ছিল। এই প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছে আমাদের দেশের ক্রেতারা। তারা এখন নিজের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আবার আমি বেশ কয়েকজন ক্রেতার জন্য জামদানিকে মূল হিসেবে ব্যবহার করে পোশাক তৈরি করে দিয়েছি। দেশের এই সম্পদের ব্যবহারকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে বিয়ের পোশাক ক্রেতারা। ক্রেতার আগ্রহ বুঝে, আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডের সঙ্গে মিল রেখে পোশাক তৈরি করার মতো দক্ষতা এ দেশের ব্রাইডাল ওয়্যার ডিজাইনারদের আছে, বিষয়টি ইতিমধ্যে প্রমাণিত। দেশের বাজার প্রসারণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা ডিজাইনারদের সাহায্য করবে।’
ক্রেতাপ্রিয়তা পেয়েছে দেশি ডিজাইনার ব্র্যান্ড হাউস অব আহমেদ। এর স্বত্বাধিকারী তানজিলা এলমা বলেন, লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্রেতাদের সরব উপস্থিতি। অল্প সময়ের নোটিশে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করছে অনেকে। তাদের জন্য এক্সপ্রেস সার্ভিসের ব্যবস্থা রেখেছি। ডিজাইনার ওয়্যারের জন্য ক্রেতারা সাধারণত বাজেট আলাদা করে রাখে। আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকে কোন ব্র্যান্ডের পোশাক বর-কনে পরবে। নতুনত্ব হিসেবে দেখেছি, কনেদের আগ্রহ বেড়েছে ভারী পাড়ের ওড়নাতে।
সিগনেচার ব্র্যান্ডগুলোর পোশাক বেশ সুনাম অর্জন করছে। এমনই তিনজন ডিজাইনার জানিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা। ফ্যাশন ডিজাইনার রুখসানা এসরার রুনি বলেন, ‘মহামারির প্রভাব কাটিয়ে বিয়ের পোশাকের কেনাকাটা বেড়েছে। তবে আগের থেকে মিনিমাল অলংকরণ চাচ্ছে ক্রেতারা। এর কারণ, বিয়ের আয়োজনের পরিসর নিজের বাসা কিংবা ছোট হলে কাছের আত্মীয়দের নিয়ে উৎসব সেরে ফেলার ইচ্ছা।
ব্রাইডাল ডিজাইনার ব্র্যান্ড সাফিয়ার স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার সাফিয়া সাথী বলেন, ‘বিয়ের কনেদের মাঝে গাউন এবং লেহেঙ্গার চাহিদা বেশ দেখতে পাচ্ছি। লং টেইল এখন জনপ্রিয়। সেটা গাউন ও লেহেঙ্গা— দুই ক্ষেত্রেই। পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি বাজেটে কিছুটা সংকোচন হচ্ছে। আগ্রহী ক্রেতাদের দেশি ফ্যাব্রিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে ইতিবাচক ফিডব্যাক পেয়েছি। মিরপুর কাতান ব্যবহারে লেহেঙ্গা তৈরিতে আগ্রহ বেড়েছে।’
ডিজাইনার ব্র্যান্ড বাটারফ্লাই বাই সাগুফতার স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার সাগুফতা ওসমান বলেন, ‘ডিজাইনার ব্র্যান্ডের কাছে ক্লায়েন্ট যখন আসে, তখন বিশেষ পোশাকের আশা নিয়ে আসে। তাদের চাওয়া থাকে অনন্য নকশার একটি পোশাক। করোনা-পরবর্তী সময়েও আমরা এই একই রকম মনোভাবের ক্রেতা পাচ্ছি। দুটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিয়ের আয়োজন এখন সীমিত হওয়ার কারণে অর্ডারের পরিমাণ কিছুটা কমছে এবং পোশাকের নকশার বিষয়ে দেখতে পেয়েছি বাজেটের দিকে ক্রেতা কিছুটা মনোযোগী হচ্ছে। চাহিদা এবং সাধ্যের সংমিশ্রণে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’
বিয়ের বাজারের একটি অংশ বিদেশি শাড়ির ওপরে নির্ভরশীল। করোনাকালের শুরু থেকে বর্তমান অবধি সে অংশের ক্রেতাদের চাহিদা সম্পর্কে জানিয়েছেন চৌরঙ্গীর স্বত্বাধিকারী ঈশিতা পায়েল। তিনি বলেন, ‘মহামারিতে মানুষ ঘরের বাইরে বের হয়েছে কম। সামাজিক দূরত্ব মেনে শপিং এবং লকডাউনের কারণে অনেকেই অনলাইনে কেনাকাটা সেরেছে। ক্রেতা পেয়েছি নিয়মিত। বাজেটের সংকোচন দেখেছি কিছুটা। মধ্যম রেঞ্জের দামের শাড়ির ক্রেতা চাহিদা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।’
বিয়ের ফ্যাশন বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যমতে করোনাকালের প্রভাবে এই আয়োজনের আকার সংকুচিত হয়েছে। বাজেটে সীমাবদ্ধতা বেড়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে ক্রেতা লাগাম টানছে শপিংয়ে। এর সঙ্গে থাকে রুচি এবং মানসিকতা। দেখা যাচ্ছে, দেশের বুনন কৌশলে তৈরি মিরপুর কাতানের চাহিদা বেশ বেড়েছে। নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে উপস্থাপনের চাহিদা থেকে ডিজাইনার ওয়ারের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ক্রেতার। সেখানে এখন যোগ হয়েছে নির্ভরতা। দেশের বাইরের পোশাকের প্রতি আগ্রহ রয়েছে কিছু ক্রেতার। বিনোদন মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবেই এমনটি ঘটেছে।
তবে বিয়ের গয়নার ক্ষেত্রে চিত্রটি ভিন্ন। দেশের শীর্ষস্থানীয় জুয়েলারি ব্র্যান্ড জড়োয়া হাউজ। প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য, ‘গহনার বাজারে তেমন কোনো বড় পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। কিছুটা কম কেনাকাটা হচ্ছে। তবে বাজেটে কাটছাঁটের পরিমাণ খুব বেশি নয়। বিয়ের গহনার ক্ষেত্রে ক্রেতার চাহিদায় কিছুটা নতুনত্ব দেখা যাচ্ছে। সলিড গোল্ড জুয়েলারির সঙ্গে বিভিন্ন রকম অনুষঙ্গ, যেমন হরেক রকমের পাথর, হীরা ইত্যাদি যোগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন ক্রেতারা। আনকাট ডায়মন্ডের চাহিদা বেশ ঊর্ধ্বমুখী।’
ব্রাইডাল জুয়েলারির জন্য প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান আমিশে। সেখানকার বক্তব্যও একই। “প্যানডেমিকের কারণে আমাদের বিক্রির হার কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সবাই আবার বাইরে বের হচ্ছে, যার কারণে আমিশের বিক্রির হার আবার বাড়ছে। সুতরাং আমরা আশা করছি, পোস্টপ্যানডেমিকে আমাদের বিক্রির হার ভবিষ্যতে আরও বাড়তির দিকেই যাবে। ক্রেতারা মূলত নানা ধরনের অনুষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ডিজাইনের গয়না চেয়ে থাকেন। বিয়ের মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। এ জন্য বর্তমানে একটু ভারী গহনা এবং বাহারি ডিজাইনের চাহিদা বেশি।”
২.
আমাদের দেশের বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে ব্রাইডাল মেকওভার অনেক বড় একটা ভূমিকা পালন করে। প্রতিটা স্যালনে ফেসিয়াল, হেয়ার কাটিং, মেনিকিউর, পেডিকিউরের মতো ছোট ছোট কিছু সার্ভিস আছে। এই সেবা দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের খুব বেশি আয় কিন্তু হয় না। তবে সপ্তাহ শেষে বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার— এই দিনগুলো আলাদাভাবে বরাদ্দ থাকে বিয়ের কনেদের জন্য। কিন্তু অতিমারিতে রাতারাতি সেই চিত্র পাল্টে গিয়েছিল। লকডাউনের কড়াকড়ির জন্য অনেকটা পাকাপোক্তভাবেই বদলে যায় গোটা ব্রাইডাল মেকওভার ইন্ডাস্ট্রি।
এই পরিবর্তনের কারণে বিউটি ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিটা অন্য ব্যবসার তুলনায় কিছুটা বেশিই হয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিউটি এক্সপার্ট কানিজ আলমাস খান। বলছেন, ‘মাত্র দুই ঘণ্টা ব্রাইডাল মেকআপ করলে দেখা যায় আমাদের সারা দিনের খরচের কিছুটা মোটামুটি উঠে আসে। প্যানডেমিকের একটা সময় বিয়ের বড় ধরনের অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেদিক থেকে আমাদের ব্যবসার এই ব্রাইডাল মেকওভার অংশটি একদম বন্ধই ছিল। এরপর লকডাউন শিথিল হলেও পরিস্থিতির কারণে খুব অল্প মানুষ নিয়ে ঘরোয়াভাবে বিয়ের প্রোগ্রামগুলো হয়েছে। আমাদের সার্ভিস সেন্টার যখন খোলা শুরু করেছে, তখন ব্রাইডাল মেকআপ করতে যারা এসেছে, তারা কেউই পুরোপুরি ব্রাইডাল লুক নিতে চায়নি। কেবল ছবি তোলা হবে দেখে অল্প সাজত বা কোনো গর্জাস পার্টি মেকআপ করত। একটা সম্পূর্ণ ব্রাইডাল মেকআপ ও পার্টি মেকআপে কিন্তু প্রাইসিংয়ে বেশ পার্থক্য আছে। এভাবে আমাদের ইনকাম কমেছে। অনেকে আবার বাসায় ফ্রিল্যান্স মেকআপ আর্টিস্টদের দিয়ে সেজে নিচ্ছেন। যারা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, তাদের জন্য এই প্রবণতা বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার আগে দেখা যেত, বিয়ের সময় কনে থেকে শুরু করে তার আত্মীয়স্বজন সবাই আসত একসঙ্গে সাজার জন্য। এখন তা একেবারেই বন্ধ হয়।’
লকডাউনে অবশ্য বেকার বসে থাকতে বাধ্য হন অনেক ফ্রিল্যান্স মেকআপ আর্টিস্টও। এই অবস্থা শিথিল হলে ব্রাইডাল মেকওভারের জন্য কনেরা আসতে শুরু করে। কিন্তু ঘরোয়া অনুষ্ঠানের জন্য হালকা মেকআপের প্রাধান্য থাকায় আর্টিস্টদের আয় ছিল পড়তির দিকে। এ নিয়ে কথা বলেন গ্ল্যামারস বিউটি বাই সানজিদার কর্ণধার ফ্রিল্যান্স মেকআপ আর্টিস্ট সানজিদা খন্দকার। নিজের এই হোম স্টুডিওতে তিনি কনে সাজিয়ে থাকেন। বললেন, ‘লকডাউনের শুরুতে হাতে কোনো ক্লায়েন্ট ছিল না। এরপর যখন লকডাউন শিথিল হলো, তখন সবাই সাজের জন্য সবচেয়ে কম খরচের আকদ প্যাকেজটা বেছে নিতে শুরু করল। অথচ কোভিডের আগে এই প্যাকেজের তেমন চাহিদাই ছিল না। বিয়ের সাজে প্রথম পছন্দ ছিল এক্সক্লুসিভ ব্রাইডাল মেকওভার প্যাকেজ, যার খরচ ছিল অনেক।’ আর বাসায় গিয়ে কনে সাজাতেন যেসব আর্টিস্ট, লকডাউনে সংগত কারণেই তাদেরও ডাক পড়ত কম।
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। লকডাউনে মেকআপ আর্টিস্টদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, এখন সেটা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ এসেছে। আমাদের দেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসগুলোকে বিয়ের সিজন হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু লকডাউন উঠে যাওয়ার পর এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই মোটামুটি বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। আবার লকডাউন শুরু হয়ে যায় যদি— এই ভয়ে বিয়ের আয়োজনটা সবাই দ্রুতই সেরে ফেলতে চাইছেন। আর তাতে সৌন্দর্যচর্চা কেন্দ্রগুলোয় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন কনেরা। ফলে কোভিডের আগের তুলনায় এখানে এখন দ্বিগুণ ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে গিয়ে আগাগোড়াই বদলে গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের আসনবিন্যাস থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই।
সৌন্দর্যচর্চা শিল্প পুরোটাই স্পর্শনির্ভর, আর করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম স্পর্শ। তাই মেকআপ আর্টিস্ট, হেয়ারস্টাইলিস্ট ও অন্যান্য সেবাকর্মীকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কোভিডকালীন ভিড় এড়াতে অনেক পার্লারেই কনে একাই শুধু ভেতরে যেতে পারছেন। কোথাও কোথাও অবশ্য কনের সঙ্গে একজন সঙ্গী ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। আর ঢোকার আগে অবশ্যই সবাইকে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। বদলে গেছে পার্লারের ভেতরের চিত্রও। আগের মতো এখন আর একসঙ্গে অনেক কনেকে পাশাপাশি বসিয়ে সাজানো হচ্ছে না। প্রতি দুজনের মাঝে এক-দুই চেয়ার ফাঁকা রাখা হচ্ছেই। সেবাকর্মীরা মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস আর মাথায় ক্যাপ পরে কাজ করছেন। কনে সাজানোর প্রডাক্ট ও টুলসগুলো প্রতিবার ব্যবহারের পরই অ্যালকোহল বা বিশেষ মেশিনের সাহায্যে স্যানিটাইজ করে নেওয়া হচ্ছে। অনেক পার্লারেই সেবাকর্মীদের ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা হয়েছে। সবার আগে কাজটি করেছে পারসোনা। এর আগে তারা কর্মীদের দুটি দলে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়। প্রতিটি দল পনেরো দিনের শিফটে কাজ করেছে।
এখন পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলেও বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো কিন্তু খুব একটা জাঁকজমক করে হচ্ছে না। এখানে স্বাস্থ্যের বিষয়টা যেমন জড়িত, তেমন আর্থিক দিকটাও ভাবা হচ্ছে। কারণ, অতিমারি মানুষকে টাকাপয়সার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন করেছে, কমেছে বিয়ের খরচ। তাই ব্রাইডাল লুকের পেছনে বেশি খরচ করার চেয়ে কনেদের মধ্যে হয় সাধারণ পার্টি মেকআপ, না হয় হালকা আর ন্যাচারাল কোনো মেকআপ বেছে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আর এভাবেই ব্রাইডাল মেকওভার ট্রেন্ডে এসেছে অনেক পরিবর্তন। ‘স্প্লেন্ডার বাই আনিকা বুশরা’ মেকআপ স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী আনিকা বুশরা বলছেন নতুন সব ট্রেন্ডের কথা, ‘সবাই এখন স্মার্ট ব্রাইডাল লুকের কথা চিন্তা করছে। যেমন আউটফিট গর্জাস হলে, মেকআপটা খুব হালকা হয় বা চোখের সাজ বেশি বোল্ড হলে, লিপস্টিক হালকা রঙের হচ্ছে। লুকের ক্ষেত্রে জুয়েলারির কথাও ভাবা হচ্ছে। আবার কিছু কনে ভারী মেকআপ করছে কিন্তু সেটার ভেতরও একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখছে। যেমন চোখটাকে স্মোকি করলে লিপস্টিকটা হালকা রাখতেই হবে। এখন ব্রাইডাল মেকআপে ‘মনোক্রোমাটিক লুক’ বলে একটা নতুন ট্রেন্ড এসেছে, যেটা কনেদের ভেতর বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এখানে চোখের সাজের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মনোক্রোমাটিক লুকে ওয়েডিং অ্যাটায়ার যে রঙের হয়, সেই রঙের আইশ্যাডো ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে প্যাস্টেল রঙের গেটআপের সঙ্গে প্যাস্টেল রঙের আইশ্যাডো। গাঢ় রঙের পোশাকের সঙ্গে গাঢ় রঙের চোখ অনেক সময় ভালো না-ও লাগতে পারে। তবে এটা অনেকটাই নির্ভর করে মেকআপ আর্টিস্টদের কালার চয়েসের ওপর বা মনোক্রোমাটিক লুক হলেও সে কীভাবে করছে তার ওপর। যেমন ইলেকট্রিক ব্লু রংটার কথাই ধরা যাক। এইটা খুব শকিং একটা কালার। পুরো চোখের সাজ এই রঙের হলে কনেকে মোটেও ভালো দেখাবে না। চোখে গোল্ডেন আইশ্যাডো লাগিয়ে এর সঙ্গে ডিপ ব্লু কালারের আইলাইনার বা স্মোকি করে এই রঙের কাজল লাগানো যেতে পারে। কালারড আইলাইনার এবারের মেকওভার ট্রেন্ডে আর একটি নতুন সংযোজন।’
ব্রাইডাল হেয়ারস্টাইল সম্পর্কে জানা গেল ব্রাইডাল মেকওভার এক্সপার্ট জাহিদ খানের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘হেয়ারস্টাইলের ক্ষেত্রে সবার আগে কনের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এর বাইরে কারও যদি আলাদা কোনো পছন্দ না থাকে, তখন আমরা একদম পরিপাটি করে চুল সাজিয়ে দিয়ে থাকি। খোঁপা, বেণি বা ছেড়ে দেওয়া থাকলে বা ফুলের ব্যবহার হলেও চুলের সাজের ক্ষেত্রে গোছালো রাখাটাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’
৩.
বাঙালি বিয়ের অনুষ্ঠানে খাবারের যোগ প্রাচীনকাল থেকেই। বিয়েবাড়িতে গেলে দেখা যায় বাহারি খাবারের পসরা। বাসাবাড়িতে ছোট অনুষ্ঠানের দায়িত্ব গৃহিণীদের ওপর থাকলেও বড় বড় আয়োজনে রান্নার দায়িত্ব বর্তায় বাবুর্চির ওপর। কখনো তা যায় ক্যাটারিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁধে।
করোনাকালে শহরে বিয়ের অনুষ্ঠানের আড়ম্বর চোখে পড়েনি তেমন একটা। তবে বিয়ে হয়েছে। মানে, বিবাহ হলেও আয়োজন সংকুচিত। মহামারিকালের এই অনুষ্ঠান সংকোচনে প্রায় চার হাজার কমিউনিটি সেন্টারকে অলস থাকতে হয়েছে। জানা গেছে, এতে প্রায় শতকোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। তবে নিউনরমালে ধীরে ধীরে বাড়ছে অনুষ্ঠান। তাতে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার মালিকদের। দীর্ঘদিনের লকডাউনে ক্যাটারিং সার্ভিস ব্যবসায়ও ব্যাপক ধস নেমেছিল। বিপাকে পড়েছিলেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। সব ধরনের বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিপুল কর্মসংস্থানের এই খাত। করোনা পরিস্থিতির আগে ও বর্তমানে কী ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা জানাতে এই ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়।
ভোজনরসিক মানুষের কাছে পরিচিত নাম ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি। ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু হয় এর। ফখরুদ্দিন বাবুর্চি তার রান্নার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন ভোজনরসিক মানুষের মন। বিয়ের আয়োজনে ফখরুদ্দিন ক্যাটারিংয়ের কদর বেড়েছে তিন দশক ধরে। ব্যবসার হালচাল জানতে কথা হয় ফখরুদ্দিনের বেশ কজন বাবুর্চির সঙ্গে। সবার মুখে একই কথা। জানালেন, তাদের ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বেশির ভাগ অনুষ্ঠান যেহেতু ঢাকাকেন্দ্রিক, তাই করোনার প্রভাবটা একটু বেশিই পড়েছিল। ঢাকাবাসী করোনায় বেশি সতর্কতা অবলম্বন করেছে। ফলে ঘরোয়া আয়োজনে অনুষ্ঠানগুলো সমাপ্ত হয়েছে। ২০১৯ সালে যত অনুষ্ঠানে তারা রান্না করতেন, এখন তা অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরেও যে আগের অবস্থা ফিরে এসেছে, বিষয়টা এমন নয়। মানুষের এখন অর্থনৈতিক মন্দা কাটেনি।
২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে প্রিমিয়ার ক্যাটারিং সার্ভিস। করপোরেট অনুষ্ঠান, সভা-সম্মেলন, বিয়ে, পিকনিক, জন্মদিনসহ যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য খাবার সরবরাহ করছে অর্ডারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে। একসঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের খাবার আয়োজন করতে সক্ষম প্রতিষ্ঠানটি। তাদের রয়েছে নিজস্ব কিচেন ও বাবুর্চি। যারা প্রতিদিনই সার্ভিস দিচ্ছে নানান প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান জাহিদ হোসেন মারুফ। ফোনালাপে তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে প্রতি মাসে ৫-১০টা বড় অনুষ্ঠান কভার করা লাগত। বর্তমানে যা এসে দাঁড়িয়েছে একটাতে; সর্বোচ্চ দুটি। এ ছাড়া প্রতিদিনই ছোট-মাঝারি অনুষ্ঠান থাকত, তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে আগের তুলনায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। অতীতে প্রতিদিন ১২টা অনুষ্ঠান থাকলে তা এখন ২-৩টা হয়ে গেছে।’ তিনি জানান, ঢাকা শহরে ছোট-বড় ৮০০ ক্যাটারিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিগত দেড় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেকের বেশি। করোনার পরিস্থিতিতে টিকতে পারেনি তারা। তার মতে, ক্যাটারিং সার্ভিস ব্যবসা আগের অবস্থানে ফিরে যেতে প্রায় দুই বছর সময় প্রয়োজন।
দুই দশক ধরে বাবুর্চি পেশার সঙ্গে যুক্ত জাকির হোসেন। জাকির ক্যাটারিং সার্ভিস নামে পরিচিত মানুষের কাছে। ঢাকার শান্তিবাগে নিজস্ব দোকান রয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যবসাটা অনেকটা পার্শ্ববর্তী এলাকাকেন্দ্রিক। শান্তিবাগ, রাজারবাগ, মালিবাগ, খিলগাঁও, বাসাবো, মতিঝিল— এসব এলাকায় আমাদের চাহিদা ছিল খানিকটা বেশি। করোনা পরিস্থিতিতে তুলনামূলকভাবে আমাদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। আমরা মাসে ১০-১২টা বিয়ের অনুষ্ঠানে রান্নার দায়িত্বে থাকতাম, যা এখন হয়ে গেছে মাসে ৩-৪টা। সর্বোচ্চ ৫টা। অতীতের তুলনায় আমাদের কর্মচারীর সংখ্যা কমে গেছে। যেহেতু আমাদের কাজ নেই, তাই কর্মচারীর প্রয়োজন পড়ে না তেমন একটা। আগে প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানের কাজ থাকত। এখন এমনও সপ্তাহ যায়, কোনো কাজ থাকে না। তবে ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। আশা করি তখন এই লোকসান পোষানো সম্ভব হবে।’
৪.
করোনার কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিয়ের আয়োজন সংকুচিত হয়ে এসেছে। গত বছর লকডাউনের মধ্যে ঘরোয়াভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ে আসায় বিয়েতে সীমিত ব্যয়ের যে ধারা তৈরি হয়েছিল, তা অপসৃত হওয়ার পথে। ফলে এই মৌসুমে বিয়ের ধুম পড়েছে বলা যায়। তবে খরচের বাহুল্য আগের মতো লাগছে না। এই পরিবর্তনের প্রভাব করোনা-পরবর্তী বিয়ের বাজারে পড়ছে।
পরিবারগুলো বিয়ের খরচের ব্যাপারে সংযত। কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে বিয়ের অনুষ্ঠান যতটা জাঁকজমকপূর্ণ ছিল, এখন ততটা থাকছে না। এর কারণ, করোনাকালে পরিবার যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তা সামলানো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আয় কমে যাওয়ার চাপ ইত্যাদি।
পুরান ঢাকার এক কাপড় ব্যবসায়ী। তার ছোট মেয়ের বিয়ে। তিন বছর আগে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সেনাকুঞ্জে। এবার ছোট মেয়ের বিয়ের আয়োজন করছেন গেন্ডারিয়ার সূত্রাপুর কমিউনিটি সেন্টারে।
এর কারণ অতিমারিতে টানা এক বছর ব্যবসা বন্ধ ছিল। অর্থনৈতিক এই অবস্থায় সীমিত আকারে ছোট মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করছেন। বরযাত্রীসহ ২০০ মানুষের আপ্যায়ন। হলুদের আয়োজনও করছেন না। শুধু পুরান ঢাকার এই ব্যবসায়ী নন, সারা দেশে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়ে হচ্ছে সাধারণভাবে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে অতিমারিপরবর্তী বাজারের ওপর।
এলিফ্যান্ট রোডে রয়েছে বিয়ে ও গায়েহলুদের সামগ্রীর বেশি কিছু দোকান। সেখানে দেখা গেল, আগের মতো ক্রেতার ভিড় নেই। আগে দেখা যেত, এ ধরনের একটি দোকানে দু-তিনজন কর্মচারী কাজ করত, এখন ম্যানেজারই সব করছেন।
বিয়ের শপিং করছেন নূরজাহান বেগম। তার সঙ্গে কথা হয় এলিফ্যান্ট রোডে। বিয়ের শাড়ি কসমেটিকস আরও আনুষঙ্গিক জিনিস মেয়ের বাড়িতে পাঠানোর জন্য ডালা কিনতে এসেছেন। নূরজাহান বেগম জানালেন, ভাইয়ের বউয়ের জন্য বিয়ের শাড়ি কিনেছেন একটা, আর একটা কাতান শাড়ি, সঙ্গে হলুদের শাড়ি। জুতাসহ টুকটাক কসমেটিকসও। এই হলো তাদের বিয়ের শপিং। তার ভাই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি জানালেন, তারা কোনো হলুদের অনুষ্ঠান করছেন না।
শাহবাগে ফুলের দোকানগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেল। আগে এই মৌসুমে গাড়ি সাজানোর ধুম পড়ে যেত। এখন দোকানিদেরই বক্তব্য, দিনে একটা—দুটোর বেশি গাড়ি এখানে আসে না সাজানোর জন্য। ডাকও পড়ে না তেমন।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পরও কিছু ব্যতিক্রম বাদে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো ঘরোয়াভাবে হচ্ছে। কোনো কোনো কমিউনিটি সেন্টার করোনা-পরবর্তী বিয়ের অনুষ্ঠান বুকিং পেলেও বেশির ভাগই খালি পড়ে আছে। লোকসানে রয়েছেন ঢাকাসহ সারা দেশের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটরের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ডেকোরেটর সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘সারা দেশে দু-তিন হাজার ডেকোরেটর ব্যবসায়ী আছেন। একসময় এদের বড় আকারের ব্যবসা ছিল। ১৪ মাস ধরে কোনো কাজ নেই। এখন সবকিছু খুললেও ওভাবে ব্যবসা শুরু হয়নি। আগে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য কমিউনিটি সেন্টার বুকিং থাকত। তাদের সঙ্গে আমাদের একটা যোগাযোগ থাকত।
বেশ কয়েকটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার আগে এই সময়টাতে বিয়ের অনুষ্ঠানের চাপ অনেক থাকত। কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পরও হাতে কাজ নেই তাদের। আউটবক্স ইভেন্টের স্বত্বাধিকারী সম্পদ হোসেন জানান, তিন মাস ধরে বিয়ের যেসব অনুষ্ঠান হয়েছে, তাদের তেমন কাজ নেই। এখন আর বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো জাঁকজমকভাবে হচ্ছে না, নিজস্বভাবে আয়োজিত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। শখ থাকলেও সাধ্য নেই। মধ্যবিত্তদের তো নেই। উচ্চবিত্তরাও অনেকে তাদের বিয়ের বাজেট কমিয়ে ফেলছে। আগে ফটোগ্রাফিও ভিডিওগ্রাফির জন্য, আলাদা হলুদ বিয়ের স্টেজের বরাদ্দ থাকত, এমনকি ঘরে আলপনার জন্যও একটা বাজেট থাকত, এসব এখন কমে গেছে। হলুদের অনুষ্ঠানে বাইরের শিল্পী দিয়ে কনসার্ট তো ভাবাই যায় না। তিনি আরও বলেন, আমার পরিচিত কয়েকটা বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে যেগুলোতে রেন্ট-এ-কার, হলুদের অনুষ্ঠান, ভিডিওগ্রাফি— কিছুই ছিল না।
মোহাম্মদপুরের শওকত ক্যাটারিংয়ের কর্মচারী সালাম মিয়া জানালেন, গত দেড় মাসে মাত্র চারটি বিয়ের খাবারের অর্ডার পেয়েছি; তা-ও খাবারে মেনু আর পরিমাণ ছিল কম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেকে খাবারের আইটেমও কমিয়ে দিয়েছেন।
বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ কার্ড। পুরানা পল্টনে আইডিয়াল এবং আজাদ প্রডাক্ট ঘুরে দেখা গেছে, বিয়ের কার্ডের জন্য তেমন ভিড় নেই। আইডিয়ালের বিক্রয়কর্মী জামাল জানান, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে দোকানে তেমন বিক্রি নেই। চারটা মাত্র বিয়ের কার্ড ছাপিয়েছি। একই চিত্র আজাদ প্রডাক্টেরও। আজাদ প্রডাক্টের বিক্রয়কর্মী জনি জানালেন, মানুষের হাতে এখন টাকা নেই। সবকিছু এখন ফোন আর ম্যাসেজেই সেরে নেওয়া যায়। কার্ড ছাপিয়ে অযথা খরচ করবে কেন?
বিয়ে ঘিরে একটা বড় ধরনের অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু করোনা-পরবর্তী বিয়ের আয়োজনে ঘটা করে খরচ করতে অনীহা অনেকেরই। বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছু তো আছেই, এর প্রভাব পড়েছে দেনমোহরেও। গত দেড় বছরে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে বিয়ের দেনমোহরও ধার্য করেছে কম। এমনটি জানালেন পল্টন মোড়ের কাজি অফিসের আবুল কাশেম। তিনি বললেন, গত দেড় বছরে যে কটা বিয়ে পড়িয়েছি, সেগুলোর দেনমোহর ছিল গড়ে এক থেকে দুই লাখ টাকা। এটি মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বাস্তবতা।
এ তো গেল বিয়ের আয়োজনের একটি সামগ্রিক চিত্র। বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথিরাও আছেন দুশ্চিন্তায়। এর কারণ, সবাইকেই এখন হিসাব করে চলতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট বা সীমিত আয়ে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্তদের। সেখানে বিয়ের দাওয়াত মানেই অতিরিক্ত ঝামেলা বলে মনে করছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, নিরুপায় হয়ে কিছু বিয়েতে যেতেই হবে। সবকিছু মিলিয়ে করোনা-পরবর্তী এবারের বিয়ের আয়োজনগুলো বেশির ভাগ সাদামাটাভাবেই হবে।
মডেল ও অভিনেত্রী তানজিয়া জামান মিথিলা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কিয়ারা
জুয়েলারি: জড়োয়া হাউজ
ছবি: জিয়া উদ্দীন