skip to Main Content

আলাপন I পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস, সহনশীলতা এবং সেক্রিফাইস থাকতে হবে : শাবনাজ-নাঈম

শাবনাজ-নাঈম নব্বই দশকের জনপ্রিয় জুটি। বাংলা চলচ্চিত্রে তাদের পরেই শুরু হয় নতুনদের জয়যাত্রা। এই জুটির অভিনীত প্রায় প্রতিটি সিনেমাই সাড়া জাগিয়েছে। গত ৫ অক্টোবর তারা পার করেছেন যৌথ জীবনের ২৭ বছর। পর্দা থেকে সরে গেলেও সুখী দম্পতি হিসেবে দর্শকদের কাছে তারা সুপরিচিত। দম্পতির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালেহীন রানা

ক্যানভাস: কেমন আছেন?
নাঈম: ভালো আছি। সুস্থ আছি। বেঁচে আছি।
শাবনাজ: আলহামদুলিল্লাহ। করোনার মধ্যেও সুস্থ আছি— এটাই অনেক বেশি পাওয়া।
ক্যানভাস: ৫ অক্টোবর বিয়ের ২৭ বছর পার করলেন। আপনাদের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাই।
নাঈম: অবশ্যই সুখের। ২৭ বছরে আমার বড় উপহার দুই মেয়ে। আমি একজন বাবা। একজন স্বামী। এটা অনেক বড় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমি উপভোগ করে আসছি। আমার নিজের সংসার। আমার স্বপ্নগুলো চাষ করি সুখের এই বাগানে।
শাবনাজ: টক ঝাল মিষ্টি— এই তিন মিলিয়ে অনুভূতি। আসলে কখন যে এতগুলো বছর পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। আমার তো মনে হয়, এই তো সেদিন বিয়ে করেছি। কিন্তু মেয়ে দুটিকে যখন সামনে দেখি, মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। এতগুলো বছর পার করে দিলাম।
ক্যানভাস: দুজন দুজনকে কী উপহার দিতে পছন্দ করেন?
শাবনাজ: নাঈম মিষ্টি করে রাগ ভাঙাতে পারে। এটাই আমার কাছে সেরা উপহার। ও স্বামী হিসেবে খুব যত্নবান। এদিক দিয়ে আর দশজন স্ত্রী থেকে আমি ভাগ্যবতী।
নাঈম: আমি খেতে পছন্দ করি। প্রায় সময় আমাকে চমকে দিয়ে নতুন নতুন খাবার তৈরি করে শাবনাজ।
ক্যানভাস: আপনাদের দুই মেয়ে সম্পর্কে জানতে চাই।
নাঈম: বড় মেয়ে নামিরা নাঈম কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। এনভায়রনমেন্ট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজিতে গ্র্যাজুয়েশন করছে নামিরা। ছোট মেয়ে মাহদিয়া নাঈম এ লেভেল সমমানের পরীক্ষা দিয়েছে আগা খান একাডেমি থেকে।
শাবনাজ: আমার দুই মেয়ে দুই রকম। একজনের আগ্রহ খেলাধুলায়, আরেকজনের গানে। দুজনই খুব চঞ্চল।
ক্যানভাস: মেয়েরা বাবা-মায়ের তারকাখ্যাতি কতটুকু উপভোগ করে?
নাঈম: আমি তারকা নই। কখনো তাদের বুঝতে দিইনি। ওরা যখন বাইরে যায়, তখন আমাদের সঙ্গে অনেকে ছবি তোলে। এটা দেখে তারাও প্রথম দিকে অবাক হতো। আমি মেয়ে দুটিকে সাধারণ দশজন মানুষের মতোই বড় করেছি।
শাবনাজ: সিনেমার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তাদের কাছে বাবা-মা নায়ক-নায়িকা নয়, সাধারণ বাবা-মায়ের মতো।
ক্যানভাস: এখনো শাবনাজ-নাঈম জুটি নিয়ে চর্চা হয়। প্রশ্ন ওঠে এখনকার জুটিদের জনপ্রিয়তা নিয়ে। কীভাবে কালজয়ী জুটি হয়ে উঠেছিলেন শাবনাজ-নাঈম?
নাঈম: জুটি মানেই শাবনাজ-নাঈম বললে ভুল হবে। আমাদের আগেও জুটি ছিলেন শ্রদ্ধেয় শাবানা-আলমগীর, রাজ্জাক-কবরী।
শাবনাজ: জুটি তৈরির পেছনে কেমিস্ট্রিটা ঠিক আছে কি না, দেখতে হবে। নায়ক-নায়িকার বোঝাপড়াটা ঠিক আছে কি না, নায়কের ডায়ালগের জবাবটা কী দিচ্ছেন নায়িকা, সংলাপ না থাকলে এক্সপ্রেশনটা কী দিচ্ছেন— এগুলোর কেমিস্ট্রি থেকেই জুটি তৈরি হয়। সেই কেমিস্ট্রি যদি সুন্দর হয়, দর্শকদের কাছে ভালো লাগে, দর্শকই নায়ক-নায়িকাকে জুটিতে পরিণত করে ফেলেন।’
ক্যানভাস: আপনাদের জুটির অভিনীত ছবিগুলোর নাম জানতে চাই।
শাবনাজ-নাঈম: ১৯৯১ সালের ৪ অক্টোবর মুক্তি পায় এহতেশামের ‘চাঁদনী’ ছবিটি। ‘জিদ’, ‘লাভ’, ‘চোখে চোখে’, ‘অনুতপ্ত’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সোনিয়া’, ‘টাকার অহংকার’, ‘সাক্ষাৎ’ ও ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’।
ক্যানভাস: সংসারের বন্ধন এত মজবুত হলো কীভাবে?
শাবনাজ: একেকটা বয়সে একেক রকম করে কেটেছে আমাদের। কখনো খুব ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, কোনো কোনো সময় গেছে অনেক আনন্দে। দুজনে মিলে বাইরে ঘোরাঘুরি করেছি, আনন্দ করেছি। বাচ্চা হওয়ার পরের জীবন আরেক রকম। বহু রাত আমরা না ঘুমিয়ে একসঙ্গে কাটিয়েছি। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস হারাইনি। আস্থা রেখেছি।
নাঈম: শাবনাজ একজন আদর্শ স্ত্রী। সে জানে, আমার মন কিসে ভালো থাকে। আমি কী বলতে চাই। সে আগেই বুঝে ফেলে। আমি মনে কষ্ট পাই এমন কোনো আচরণ তার মধ্যে নেই। একটি সংসার মজবুতের জন্য এর চেয়ে বড় ভিত আর কী হতে পারে।
ক্যানভাস: মান-অভিমান কে ভাঙায় আগে?
নাঈম : আমি রাগ করি কম। আমি সব সময় শান্তি চাই। আমাদের মান-অভিমানের সময়সীমা মাত্র ৩০ মিনিট।
শাবনাজ: মেয়েরা তো একটুতেই রেগে যায়। এখনো আমার রাগ হলে নাঈম ‘সরি’ বলে। আমি খুবই কম ‘সরি’ বলি। এটা নিয়ে আমার মেয়েরাও বলে, ‘মা, তোমার দোষ থাকলেও তুমি একদমই সরি বলো না।’ যখন নাঈম ও মেয়েরা মিলে ধরে, তখন আমি বাধ্য হয়ে ‘সরি’ বলি। আমি রাগ করলেও নাঈম আগে এসে কথা বলে। সে চায় না, বাসার ভেতর কোনো রাগারাগি থাকুক। রাগ করলে এখনো সে আমাকে ময়না বলে রাগ ভাঙায়।’ ‘বিষের বাঁশি’ ছবিতে আমার চরিত্রের নাম ছিল ময়না। সেই থেকে আজও ময়না বলেই ডাকে।
ক্যানভাস: বর্তমানে কীভাবে সময় কাটছে আপনাদের?
নাঈম: টাঙ্গাইলে আমার বড় কৃষি খামার আছে। ডেইরি ফার্ম আছে। এগুলো দেখাশোনা করতে হয়। পরিবারকে সময় দিতে হচ্ছে। আমি গ্রামে একটি ক্রিকেট ক্লাব করেছি। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছি।
শাবনাজ: বাসায় টুকটাক কাজ করি। অবসরে বই পড়ি। রান্নাবান্না করি। সময়টা ভালোই কেটে যায়। টিভি দেখি। নতুন নতুন ছবি দেখি।
ক্যানভাস: বিয়ের গল্পটা কেমন ছিল?
শাবনাজ: ‘সিলেটে আমরা একটি ছবির শুটিং করছিলাম। শট দেওয়ার পর সুন্দর একটি জায়গায় বসে আছি। এমন সময় নাঈম আমাকে প্রপোজ করে। কথা শুনে আমি অনেক লজ্জা পাই। সিনেমায় আমরা অনেকবার এমন কথা বলেছি। তবে বাস্তবে বিষয়টি একেবারেই আলাদা মনে হয়েছে। অবশ্য আমি এর আগে থেকেই ওকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এরপর আমার পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। এরই মধ্যে আমাদের পরিবারের কাছে নাঈম অনেক ভালো ছেলে হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গিয়েছিল।
নাঈম: আমিও বহু সিনেমায় শাবনাজকে এমন প্রেমের কথা বলেছি। তবে বাস্তবের বিষয়টা একেবারেই আলাদা। আমি শাবনাজের মুখ দেখেই বুঝে গেলাম, সে আমাকে ভালোবাসে। তারপর আমরা দুজনই পরিবারের সঙ্গে কথা বলে, সবার সম্মতি নিয়েই বিয়ে করি। বিয়ে করার পর সবার দোয়ায় সুখে-শান্তিতে সংসার করছি।
ক্যানভাস: কয়েক বছর ধরে শোবিজে তারকাদের মধ্যে ঘন ঘন বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনায় দর্শকেরা বিব্রত ও বিরক্ত। এ প্রসঙ্গে আপনাদের মত কী?
নাঈম : তারকাদের নিজস্ব জীবন আছে। আমরা সবাই কাজ করে জীবন চালাই। তবে আমাদের কাজের ধরনটা ভিন্ন। আমরা যেহেতু সমাজের ভালোমন্দ দিকগুলো দর্শকদের সামনে তুলে ধরি। তাই তারা আমাদের আদর্শ ভাবে। আমাদেরও উচিত তাদের সামনে নিজেদের সেভাবে উপস্থাপন করা। বিয়েটা কোনো ঠুনকো খেলা নয় যে, ভালো লাগল না, ছেড়ে দিলাম। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে, বিয়ে শুধু দুজনের মধ্যে হয় না। দুটি পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীরাও এর সঙ্গে জড়িত থাকে। বিবাহবিচ্ছেদ সবার ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। দুজনে বারবার আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বিবাহবন্ধনকে আরও শক্তিশালী করা যায়।
শাবনাজ: একটা সময় মনের মিল না-ই হতে পারে, বিরক্তও লাগতে পারে। তাতে কী আসে যায়। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একটু সহনশীল হলেই কিন্তু বিয়েটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব। বিবাহবিচ্ছেদের মধ্যে ভালো কিছু নেই। কারণ, আরেকজন যে আসবে, সে-ও যে ভালো হবে, কোনো গ্যারান্টি নেই। বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস, সহনশীলতা এবং সেক্রিফাইস মন থাকতে হবে। আর এই বিষয়গুলো শিল্পীদের দাম্পত্য জীবনে হোক কিংবা সাধারণ দর্শকদের— যে কারও মধ্যেই থাকতে হবে। তাহলেই দাম্পত্য জীবন সুন্দর হবে।

ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top