রসনাবিলাস I গুলশানে ফরাসি দাপট
ঢাকায় ফরাসি খাবারের নতুন ঠিকানা ডেলিফ্রান্স। ফ্রান্সের সেরা শস্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভিভেসিয়ার উদ্যোগ। কেমন এখানকার খাবার, কেমন পরিবেশ? লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে কি ফরাসিদের রুটি তৈরির কারখানা ছিল কোনো কালে? কে জানে, হয়তো ছিল! কারণ, নাক উঁচু ফরাসিদের নিজেদের নিয়ে জাত্যভিমান কম ছিল বলে খবর পাওয়া যায় না। তবে ঢাকায় নতুন ফরাসি খাবারের উপনিবেশের খবরে অপেক্ষা না করেই টিম ক্যানভাস হাজির গুলশান অ্যাভিনিউয়ে।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতেই স্বাগত জানায় দুই ফরাসি কিষানি। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই আলোর রোশনাই। হাতের বামে আরাম করে বসার জন্য সোফা টেবিল রাখা। ডানে আরও কিছু চেয়ার টেবিল, সব কটাতেই চারজন করে বসার ব্যবস্থা। একবারে ডানে কাউন্টারে থরে থরে সাজানো সব খাবার। কাউন্টারের পেছনে রাজ্যের ব্যস্ততা। অবশ্য কাউন্টারের ওপাশেও আরও কিছু চেয়ার টেবিল রাখা, দুজনের বসার ব্যবস্থা সেখানে। আপাতত টিম ক্যানভাস সেখানে গিয়ে ধাতস্থ হতেই চলে এলেন আথুলা ইয়াপা, চিফ এক্সিকিউটিভ, অপারেশনস। কাফে আলুঁযে বা আমেরিকানোর কাপে চুমুক দিতে দিতেই প্রাথমিক আলাপ চলল ডেলিফ্রান্স বাংলাদেশ নিয়ে। শীতের দুপুরের নরম আলোয় তখন ঝকমকিয়ে উঠেছে ডেলিফ্রান্সের অন্দর।
ডেলিফ্রান্স ১৯৭৮ সাল থেকে বুলোঞ্জে (বেকারি), ভিয়েনোসারি, পাতিসেরি (পেস্ট্রি) আর স্যাভোরি পণ্য সরবরাহ করে আসছে খাদ্যসেবা প্রদানকারী, খাদ্য প্রস্তুতকারী আর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে—১০০টির বেশি দেশে। ফ্রান্সের সেরা শস্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভিভেসিয়া ছয়টি ধাপ পেরিয়ে তাদের উদ্যোগ ডেলিফ্রান্সের খাদ্যরসিকদের সেরা খাবারগুলো সরবরাহ নিশ্চিত করে বলে জানালেন আথুলা ইয়াপা।
কথা চলতে চলতেই এসে হাজির হলেন ডেলিফ্রান্স বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবিদ মনসুর। ততক্ষণে আমরা কফি আর কোঁয়াসোঁর ফরাসি কায়দার যুগলবন্দিতে মুগ্ধ। টেবিলে অপেক্ষায় রয়েছে দুটো অল ডে ব্রেকফাস্ট—বেকন অমলেট, হ্যাশ ব্রাউন অ্যান্ড সসেজ উইথ কোঁয়াসোঁ আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট। খেতে খেতেই কথা চলল এই ডেলিফ্রান্স নামের উদ্যোগ নিয়ে। করোনার বাড়াবাড়িতে প্রায় এক বছর পিছিয়ে গেছে এই বেকারি-ক্যাফের উদ্বোধন। এই মহামারির কারণে এখানকার যেসব বেকার বা রুটি প্রস্তুতকারীরা রয়েছেন, তারা ফ্রান্সে গিয়ে ট্রেনিং যেমন নিতে পারেননি, ঠিক তেমনি ফ্রান্সের ভিভেসিয়ার লোকেরাও ঢাকায় এসে সবকিছু সেভাবে তদারক করতে পারেননি। তবে তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে সেটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, অনলাইনেই চলেছে ট্রেনিং আর অন্যান্য কাজ। তবে শিগগির ফ্রান্সের থেকে ভিভেসিয়ার লোকেদের আসার কথা রয়েছে বলে জানালেন আবিদ মনসুর। চ্যালেঞ্জ কেবল এখানেই ছিল না, ছিল আন্তর্জাতিক চেইন হিসেবে বিশাল জায়গার চাহিদাও। অবশ্য সেটা মেটানো হয়েছে বেকারি সেকশন পুরো আলাদা করে রামপুরায় স্থাপন করে। প্রতিদিন দুবার করে ফ্রেশ সব বেকারি আইটেমগুলো আনা হয়। কথায় কথায় আবিদ এটাও জানালেন, পৃথিবীর ১০০টির বেশি থাকা ডেলিফ্রান্সের কেবল বাংলাদেশ আর মালয়েশিয়া শাখাই সবকিছু একেবারে স্ক্র্যাচ থেকে তৈরি করে। যেখানে অন্য দেশগুলো ফ্রোজেন খাবারই ব্যবহারে অভ্যস্ত।
তাদের পুরো মেনু ভাগ করা হয়েছে অল ডে ব্রেকফাস্ট, স্ন্যাকস, স্যালাডস, স্যান্ডউইচেস অ্যান্ড র্যাপস, হট ডিশেস অ্যান্ড পাস্তা, ভিয়েনোসেরি অ্যান্ড ড্যানিশ আর রিটেইল ব্রেডস দিয়ে। অন্যদিকে ডেজার্টস আর কেকস-এর তালিকাও দীর্ঘ। সবচেয়ে দীর্ঘ তাদের বেভারেজের তালিকা। এর মধ্যে যে সবই ফরাসি তরিকার, তা বলা যাবে না। কারণ, ডেলিফ্রান্স যেখানেই গেছে, সেখানকার লোকাল ফ্লেভারটাকেও আপন করতে চেয়েছে, ফলে নানা ধরনের ফিউশন তৈরি হয়েছে সেখান থেকেও। আর ফ্রেঞ্চ কালিনারি ইন্ডাস্ট্রি যতই অভিজাত হোক না কেন, তা অনেকটা ল্যুভ মিউজিয়ামের মতোই এখানে-সেখানে থেকে ধার করা জিনিসে ভরা।
কথার মাঝেই হানি আর ক্রিম দিয়ে চেখে দেখছিলাম ফ্রেঞ্চ টোস্ট। বাটারের গন্ধ আরও খোলতাই করেছে এর স্বাদ। জানা গেল, এই বাটার আর রুটি তৈরির ময়দাও আসে ফ্রান্স থেকে। এরপর পালা বেকন অমলেট, হ্যাশ ব্রাউন অ্যান্ড সসেজ উইথ কোঁয়াসোঁ। যদিও মেনুতে ছিল স্ক্রাম্বল্ড এগ, সেটা বদলে বেকন অমলেট দেওয়া হয়েছিল। বেকন অমলেটের স্বাদ অসাধারণ। কারণ, পোড়া তেলে অমলেট খাওয়া আমাদের জিহ্বায় মাখন বেশ শান্তির পরশ দেয়। হ্যাশ ব্রাউন চলনসই। আর কোঁয়াসোঁ অসাধারণ। সত্যি বলতে, ভিয়েনা থেকে আসা এই রুটি তার আসন বেশ পোক্ত করে নিয়েছে ফরাসি অভিজাত সব রুটির তালিকায়। ভিয়েনার প্রভাব এতটাই বেশি ফরাসি বেকারির জগতে যে পাতিসেরি আর বুলোঞ্জের পাশাপাশি আলাদা করে এখন ভিয়েনোসারি নামের শাখাই তৈরি হয়ে গেছে।
পাতিসেরির কাজ সব ঠান্ডা উপকরণ নিয়ে, যেমন পাফ পেস্ট্রি, ক্রিম ইত্যাদি নিয়ে; বুলোঞ্জের কাজ ইস্ট দিয়ে ফোলানো রুটি নিয়ে, অর্থাৎ যেসব তৈরিতে উষ্ণতার প্রয়োজন; আর অস্ট্রিয়ান সামরিক কর্মকর্তা অগাস্ট যাং পাহী বা পারী শহরে ১৮৩৭ সাল নাগাদ অস্ট্রিয়ার সমৃদ্ধ রুটি তৈরির ঐতিহ্য তুলে এনে যে বেকারি খুলে বসেন, সেটাই পরে পরিণত হয় ভিয়েনোসারি নামে। কোঁয়াসোঁ নামের রুটিটাও সেখান থেকেই আসা। আর ডেলিফ্রান্সের ক্ল্যাসিক স্যান্ডউইচ সব কোঁয়াসোঁ দিয়েই হয়। যেহেতু কোঁয়াসোঁকে কেন্দ্র করেই ডেলিফ্রান্সের কারবার, তাই এর স্বাদ, গন্ধ নিয়ে সন্দেহাতীতভাবে মুখে তোলা যায়। তুলতুলে, নরম এই অর্ধচন্দ্রাকৃতির রুটির সঙ্গে অবশ্য খানিক জ্যাম আর বাটারও দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে চলল আরেক দফা আমেরিকানো—ডবল শট এসপ্রেসো দিয়ে, বাকিটা গরম পানি দিয়ে পূর্ণ মগ।
কথায় কথা বাড়ে, তাই ডেলিফ্রান্সের গন্ডি ছেড়ে আলাপ গড়াল আবিদ মনসুরের আরেক প্রকল্প চা-টা নিয়ে। যেখানে ইন্ডিয়ান কুজিন নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন রয়েছে তার। অবশ্য তাতেও ডেলিফ্রান্সের খাবার সঙ্গ জোগাল। এবারে তার পছন্দসই খাবারে ভরসা করলাম আমরা। তিনিই জানালেন, এখানকার স্মোকড স্যামন স্যান্ডউইচ তার পছন্দের। ফ্রেঞ্চ কালিনারি জগতে স্যান্ডউইচ নামক খাবারের আগমন কিন্তু তাদের শত্রু-মিত্র দেশ ইংল্যান্ডের কেন্টের স্যান্ডউইচ এলাকা থেকে। ১৭৬২ সাল নাগাদ স্যান্ডউইচের চতুর্থ আর্ল জন মন্টাগু এই খাবার আবিষ্কার করেছিলেন সময় বাঁচাতে। আর সেটাকে ফ্রেঞ্চরা প্রথমে বাগেটে করে, পরে কোঁয়াসোঁয় ভরে খেয়ে চলেছে। ক্রিম চিজ, শসা, টমেটো আর লেটুসের বিছানায় শুয়ে এল মৎস্যরাজ স্যামন। স্মোকি ফ্লেভারের স্যামনের এই কোঁয়াসোঁ আসলেই দারুণ। সঙ্গ দিল ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা ফ্র্যাপে।
খাবারের স্বাদ নিতে নিতে তখন শেষ বিকেল। দুপুরের গুলশানের নিরিবিলি রাস্তা তখন পরিণত হয়েছে মানুষের ভিড়ে। ভিড় বাড়তে শুরু করেছে এই ক্যাফেতেও। কোঁয়াসোঁর সঙ্গে এক কাপ কফি বা অল ডে ব্রেকফাস্ট বা কেবল স্যান্ডউইচ ক্রেভিং হলেও ঢুঁ মারা যেতে পারে এখানে।
ঠিকানা: কাসাব্লাংকা টাওয়ার, ১১৪ গুলশান অ্যাভিনিউ, ঢাকা ১২১২। ফোন: ০১৭০৮৪৯৪৪৯৯।
ছবি: আকাশ খান