ফিচার I হলিউড DREAM
বাংলাদেশে বড় হয়ে ওঠা এক যুবক দাবড়ে বেড়াচ্ছেন হলিউড সিনেমার জগতে। পর্দার সামনে নয়, পেছনে। বলছি ওয়াহিদ ইবনে রেজার কথা
‘ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস’, ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার’, ‘নাইট অ্যাট দ্য মিউজিয়াম: সিক্রেট অব দ্য টুম্ব’, ‘ফিউরিয়াস সেভেন’ এবং ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’—হলিউড মুভি লাভারদের কাছে নামগুলো খুবই পরিচিত। আড্ডায় তারা এসব সিনেমার গল্প করেন। তবে এই সিনেমাগুলোর পেছনের কুশলীদের খোঁজ কজনই-বা রাখে। ওপরে যে কটি মুভির নাম বলা হলো, সব কটিতেই কাজ করেছেন বাংলাদেশের ওয়াহিদ ইবনে রেজা। না, পর্দায় নয়, বিহাইন্ড দ্য লাইনের কর্মযজ্ঞে কখনো নেতৃত্ব, আবার কখনোবা সহযোগী হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। সম্প্রতি কানাডা থেকে কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। সেই সুযোগে জানা গেল কানাডায় বসে বিভিন্ন হলিউড স্টুডিওর মুভিতে তার কাজ করার এবং যাপিত জীবনের নানান দিক।
সাল ২০০২। বুয়েটের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ওয়াহিদ ইবনে রেজা। যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের কজন মিলে তৈরি করলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘এক পুরুষের প্রেম’। প্রদর্শনীর পর ভালো সাড়া পেয়েছিলেন। প্রকৌশলে পড়লেও তা তাকে খুব একটা টানত না। পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন লেখালেখিতে। এখনো আছেন। তখন থেকেই লিখতেন কবিতা, গান ও মঞ্চনাটকের স্ক্রিপ্ট। সংলাপ লেখাতেই তার হাত বেশি খোলে। বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে থাকতেই সান্নিধ্য পান হুমায়ূন আহমেদের। একসঙ্গে একাধিক ঈদের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্রেক পান। আরও পরিচিত হয়ে ওঠেন হোয়াইট প্লাসের বিজ্ঞাপন করে। এসবের পরেও কিন্তু হলিউডে কাজ করার পরিকল্পনা ছিল না তার। নাটক, বিজ্ঞাপন ও লেখালেখিতে পরিচিত হওয়ার পর উপলব্ধি করেন, তিনি একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে পেরেছেন। তখনই জেঁকে বসে সিনেমায় কাজ করার বাসনা। ইচ্ছাকে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেই ছক কষতে বসেন ওয়াহিদ। সিদ্ধান্ত নেন ফিল্ম বিষয়ে পড়াশোনার।
যেই কথা সেই কাজ। বিশ্বের বিভিন্ন ফিল্ম স্কুলে আবেদন শুরু করেন। কিন্তু সব জায়গা থেকেই প্রথমবার হন রিজেক্ট। এর কারণ, সঠিক পদ্ধতিতে অ্যাপ্লিকেশন করতে না জানা। ফলে দ্বিতীয়বার আটঘাট বেঁধেই নামেন। এবার সুযোগ মেলে কানাডার ভ্যানকুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় পড়ার। ভ্যানকুভারকে বলা হয় ‘হলিউড নর্থ’। কারণ, সেখানেই হলিউডের ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের বেশির ভাগ কাজ হয়; এমনকি ফিল্ম ও টিভি সিরিজের শুটিংও।
ভ্যানকুভারে ওয়াহিদ সেকেন্ড ব্যাচেলর শুরু করেন ফিল্ম প্রোডাকশনের ওপর। বাংলাদেশের ক্যারিয়ারটি তাকে পেছন থেকে সমর্থন জুগিয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি নাটক লিখে যাচ্ছিলেন। মানে, দেশের সঙ্গে যোগাযোগটা বন্ধ করে দেননি। সেসব নাটক টিভিতে প্রচারিত হচ্ছিল। কানাডার কিছু ফিল্ম ফেস্টেও যাচ্ছিল ওয়াহিদের সিনেমা। একসময় শেষ হয় ইন্টার্নশিপ। তবু মিলছিল না জব অপরচুনিটি। ৮৪টি জায়গায় জীবনবৃত্তান্ত পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না ওয়াহিদ। তাতে অবশ্য দমে যাননি। সুযোগ খুঁজতে থাকেন কোমর বেঁধে। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস অ্যানিমেশন স্টুডিওতে জব অ্যাপ্লাই শুরু করেন। এবার চাকরি ধরা দেয়। ডাক পড়ে বার্ডেল স্টুডিওতে। আনপেইড ইন্টার্নশিপের একটা পজিশনে ইন্টারভিউ দিলেও পরে তারা ‘পেইড প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে জব অফার করে। সেটিই ছিল ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের সিনেমাসংশ্লিষ্ট কাজে ওয়াহিদের যাত্রা শুরুর সময়।
ক্যারিয়ার শুরু করেন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। ওয়াহিদের নিজের ভাষায় ‘ফুট-ফরমাশ খাটা’। অবশ্য তিনিই জানালেন, সবাই এভাবেই শুরু করে। খুব দ্রুতই কাজ শেষ করতে পারতেন তিনি। বাড়তি সময় হাতে থাকত। তখন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আরও কাজ চেয়ে নিতেন। ফলে প্রতিষ্ঠানের কর্তারা তাকে টুডি অ্যানিমেশনের ব্যাকগ্রাউন্ড সেটআপ করার কাজটি শিখিয়ে দেন। তারপর ঘণ্টায় ১০টি সেট করার টার্গেট জুড়ে দেওয়া হয়। এবার নিজের কাজ দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন ওয়াহিদ। ঘণ্টায় তিনি ২৬টি ব্যাকগ্রাউন্ড সেট করে প্রশংসিত হন। পরে একে একে আরও অনেক দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। ৬-৭ মাস ওই পদে বহাল থাকার পর মুভিং পিকচার কোম্পানিতে প্রোডাকশন কো-অর্ডিনেটরের কাজ মেলে। দায়িত্ব ছিল অ্যাসেট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট কো-অর্ডিনেশন। প্রথম কাজটিই ছিল ‘গেম অব থ্রোনস’-এর। ওই কোম্পানিতেই তিনি অনেকগুলো সিনেমার কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। সেগুলোর মধ্যে ‘ব্যাটম্যান ভার্সা সুপারম্যান’ ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। সেখানেও প্রশংসিত হন ওয়াহিদ। বনে যান তাদের স্টাফ।
মুভিং পিকচারে ওয়াহিদ ইবনে রেজার যিনি বস ছিলেন, তিনি চলে যান ম্যাথড স্টুডিওতে। ওয়াহিদও তার অনুগামী হন। সেই স্টুডিওতেই মার্ভেল-এর কাজ করার সুযোগ মেলে তার। ‘সিভিল ওয়ার’ ও ‘ডক্টর স্ট্রেইঞ্জ’-এর কাজ করেন। এসব কাজের মুনশিয়ানা তাকে প্রমোশন এনে দেয়। ‘গার্ডিয়ান অ্যান্ড গ্যালাক্সি-২’-তে চমৎকার কাজ করার পর হয়ে যান প্রোডাকশন ম্যানেজার। এরপর মায়ের মৃত্যুতে দেশে ফিরে আসেন ওয়াহিদ। তার শূন্যতা পূরণে সে সময়ে ৬ জন কর্মীকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন পড়েছিল ম্যাথড স্টুডিওর। দুমাস পর আবারও কানাডায় যান ওয়াহিদ। এবার প্রায় সব প্রোডাকশনেই সহযোগিতা করা শুরু করেন। কেননা, তত দিনে হাত পেকেছে। ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ সিনিয়রও হয়ে গেছেন।
এরপর ঝুঁকে পড়েন অ্যানিমেশনের কাজে। তখন সেখানকার সনি স্টুডিও ‘হোটেল ট্রানসালভেনিয়া-থ্রি’ মুভির জন্য লোক হায়ার করছিল। তারা সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর হিসেবে ডাকে ওয়াহিদকে। কিন্তু ইন্টারভিউ চলাকালীনই তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অ্যাসোসিয়েট প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে। এরপরের ধাপে তিনি পাড়ি জমান অ্যাটোমিক কার্টুনস স্টুডিওতে। কাজ করেন স্পাইডারম্যানের একটি প্রি স্কুল শোতে। এরপর ডাক পান ডিজিটাল ডোমেইন নামের আরেকটি বড় স্টুডিওতে, মার্ভেলের আরেকটি প্রজেক্টে কাজের উদ্দেশ্যে।
এই হলো ওয়াহিদ ইবনে রেজার চলমান হলিউড জার্নির সংক্ষিপ্ত বয়ান। চলতি জানুয়ারিতে কানাডার ‘আনাপূর্ণা পিকচার্স’-এ প্রোডাকশন সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করার কথা রয়েছে তার। এই দীর্ঘ যাত্রা ও সফলতা এমনি এমনি ধরা দেয়নি। এ জন্য পরিশ্রম করতে হয়েছে খুব। বিদেশের জীবন তাকে ছাড় দেয়নি মোটেও। এমনিতেই বাইরে থেকে যাওয়া মানুষদেরকে বর্ণের ও ভাষার ভিন্নতার জন্য কিছুটা আলাদাভাবে দেখে কানাডার মানুষ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সময় লাগে। এর পাশাপাশি ওয়াহিদকে ভুগতে হয়েছে অর্থকষ্টেও। এমনও দিন গেছে, সম্বল বলতে ছিল মোটে শূন্য দশমিক ২৫ ডলার। দেশি টাকায় হিসাব করলে ২০ টাকা। ওয়াহিদের ভাষায়, ‘একটা গাড়ি এসে যদি আমাকে চাপা দিত, তাহলে দাফনের টাকাটাও ছিল না তখন।’ কানাডার বিভিন্ন স্টুডিওতে নিজের যাপিত জীবনের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে ওয়াহিদ জানিয়েছেন, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ। মধ্যখানে এক ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেক। তবে প্রজেক্টের চাপ বাড়লে কর্মঘণ্টা বাড়ে। অবশ্য সে জন্য বাড়তি পারিশ্রমিকও পান কর্মীরা। আর কর্মকর্তাদের হয় স্যালারি অ্যাডজাস্টমেন্ট।
কানাডায় খাওয়াদাওয়া বলতে, ক্যাটারিং থেকে সারা সপ্তাহের খাবার কিনে খান ওয়াহিদ। অফিসের পোশাক-আশাকে অবশ্য কড়াকড়ি নেই। ক্যাজুয়াল ড্রেসে অফিস করলেই চলে। তিনি যেই পদ্ধতিতে নিজের স্বপ্ন ছুঁয়েছেন, অন্য কোনো তরুণ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাইলে কী করতে হবে? উত্তরে ওয়াহিদ বলেন, ‘আমি মূলত একটা আলটিমেট টার্গেট রাখি। তারপর সেটিকে লজিক্যাল স্টেপে ভাগ করি। প্রতিটা ধাপেই পরিশ্রম করতে হয়। অবশ্য কিছুটা লাকও লাগে। সেই লাক পেতে হলে প্রচন্ড এফোর্ট দিতে হয়।’
নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের বিষয়ে ওয়াহিদ ইবনে রেজা বলেন, ‘আমি নর্থ আমেরিকায় ফুলটাইম রাইটার হিসেবে কাজ করতে চাই।’ এ উদ্দেশ্যে এখন থেকেই নিজেকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। সম্প্রতি ‘মমলু অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ নামের একটি সিরিজের তিনটি পর্বের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। এটি দুই থেকে চার বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ওয়াহিদ ইবনে রেজার সৌজন্যে