সাক্ষাৎকার I কার-আলাপন
দেশে গাড়ি ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট তিন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে গাড়ির বাজারের বিবিধ চিত্র
সারা দুনিয়া দেখবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর গাড়ি
-জাকির হোসেন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হোসেন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ
ক্যানভাস: দেশীয় গাড়ি তৈরি করছেন আপনারা। এ প্রসঙ্গে কিছু বলুন।
জাকির হোসেন: কোটি টাকা খরচ করে কেনা বিদেশি গাড়িতে একজন গ্রাহক যেসব সুবিধা পান, সেই সুবিধাগুলো হোসেন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘বাংলা কারস’-এর তৈরি মাত্র ৩০ লাখ টাকা দামের গাড়িতে পাওয়া যাবে। দেশি এই ব্র্যান্ডের গাড়ি বিক্রির কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো শুরু না হলেও ইতিমধ্যে শতাধিক গাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। এখন সাত আসনের গাড়ি নামানো হয়েছে। ভবিষ্যতে পাঁচ আসনের গাড়িও নামাব। চেষ্টা থাকবে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায় ক্রেতাদের হাতে দেশি ব্র্যান্ডের নতুন গাড়ি তুলে দেওয়ার।
ক্যানভাস: ‘বাংলা কারস’-এর বিশেষত্ব কী?
জাকির হোসেন: প্র্রাইভেট কার, ট্রাক, বাস, লরি ট্রাক, পিকআপসহ মোট ১২ ধরনের গাড়ি তৈরির লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আমাদের গাড়ি তৈরির কারখানা নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটীতে। আমরা দেশীয় ব্র্যান্ড, দেশীয় ডিজাইনে গাড়ি ম্যানুফ্যাকচার করছি। জাপানের ইসুজুর সহযোগিতায় ইঞ্জিন, চায়না বডি এবং চেসিস এসেছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। এসব গাড়ি অন্য গাড়ি থেকে ভিন্ন। পিএইচপি, প্রোটন বা মিতসুবিশি একটা বা দুটি মডেলের গাড়ি তৈরি করতে পারবে; কিন্তু ‘বাংলা কারস’ সব মডেলের গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম। আবার ৮ রঙের গাড়ি থাকলেও ক্রেতা যদি অন্য কোনো রং পছন্দ করেন, আমরা সেটাও করে দিতে পারব।
ক্যানভাস: ক্রেতারা আর কী কী সুবিধা পাবেন?
জাকির হোসেন: ‘বাংলা কারস’-এর প্রতিটি গাড়ির এ-টু-জেড ফ্যাসিলিটি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকেই পাবেন। বন্ড লাইসেন্স পেলে প্রতিবছর চার থেকে পাঁচ হাজার গাড়ি বাজারজাত করার ইচ্ছা আছে। ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল, ইলেকট্রিক ভেহিকল, বড় লরি ট্রাক, সিমেন্টসহ যত ধরনের গাড়ি আছে, আমরা সব গাড়ি উৎপাদন করব। প্রতিটি গাড়িতে থাকছে ৫ বছরের ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি।
ক্যানভাস: রপ্তানির কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?
জাকির হোসেন: বিদেশি গাড়ি নয়, বরং নিজেদের নামে নিজেদের গাড়ি প্রথমবারের মতো আমরা উৎপাদন করছি। এখনো ট্রায়াল প্রোডাকশনে রয়েছি। শিগগিরই আরও কিছু গাড়ি বাজারে আসবে। আমাদের গাড়ি এ দেশের পোশাক খাতের মতোই ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নাম বহন করবে। দেশকে গাড়ি উৎপাদনে নেতৃত্ব দেবে জাপান, চীন ও ভারতের মতো। প্রথম পর্যায়ে দেশের ৮ বিভাগে থাকছে শোরুম। তা ছাড়া আরও ৩০টি শোরুম খুলতে যাচ্ছি আমরা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে তারপরই রপ্তানিতে যাব। সারা দুনিয়া দেখবে, মেইড ইন বাংলাদেশ-এর ‘বাংলা কারস’।
দেশীয় গাড়িনির্ভর উন্নত দেশ গড়তে চাই
—তাসির করিম
এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, পিএইচপি অটোমোবাইলস লিমিটেড
ক্যানভাস: মূল কোম্পানির সঙ্গে আপনাদের কাজের প্রক্রিয়া কেমন?
তাসির করিম: ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ বাংলাদেশ সফরে এসে পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে এ দেশে প্রোটনের কারখানা খোলার প্রস্তাব দেন। সেই থেকে একযোগে প্রোটন মালয়েশিয়া এবং পিএইচপি অটোমোবাইলস লিমিটেড কাজ করছে। এখানে মালয়েশিয়ার সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে গাড়ি সংযোজন, বিপণন, বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হয়। প্রোটনের সব কটি গাড়িতে তাদের নিজস্ব ৫ বছর অথবা ১ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি দেওয়া হয়। সংযোজন, বিপণন, বিক্রয় এবং বিক্রয়োত্তর পর্যন্ত প্রতিটা ধাপে প্রোটনের আন্তর্জাতিক আদর্শ ঠিক রেখে কাজ করা হয়।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপনাদের গাড়িগুলো কতটা পরিবেশবান্ধব?
তাসির করিম: আমাদের গাড়িগুলো ব্র্যান্ড নিউ ও পরিবেশবান্ধব। এতে পরিবেশবান্ধব ও সমসাময়িক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। শুধু তা-ই নয়, বিক্রয়োত্তর ধাপে অরিজিনাল যন্ত্রাংশ ব্যবহারের কারণে গাড়ি টেকসই থাকে এবং পরিবেশ দূষণ করে না।
ক্যানভাস: আপনাদের টার্গেটেড কাস্টমার কারা? তারা আপনাদের কাছ থেকে কী ধরনের ক্রয়সুবিধা পান?
তাসির করিম: অনেকেই বহুদিন ধরে পুরোনো গাড়ির নামে জঞ্জাল কিনছেন বা নতুন গাড়ির নামে অতিরিক্ত টাকা ঢালছেন। চাকচিক্যের খোলসে ঢাকা সেসব গাড়ির বিক্রয়োত্তর সেবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ ধরনের গাড়ির ক্রেতারা আমাদের টার্গেটেড কাস্টমার। তাদের জন্য আমাদের SUV PROTON X70-এর কথাই ধরুন। আমাদের এই গাড়ি বর্তমানে বিলাসবহুল অনেক গাড়ির তুলনায় অধিক ফিচারসংবলিত ও ১৫০০ সিসি হওয়ার কারণে সাশ্রয়ী। সম্প্রতি যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান এই গাড়ি নিয়েছে, তারা এখন অন্যান্য SUV-এর বদলে আমাদের এই গাড়ি নিচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, গুণ কথা বলে! VOLVO-এর নকশা এবং প্রযুক্তির কারণে এটি বর্তমান বাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় SUV গাড়ি। এ ছাড়া মধ্যবিত্তদের কথা চিন্তা করে আমরা ১৩৩২ সিসির PROTON SAGA 2021 মডেলের গাড়িটি দেশে সংযোজন করছি। এর মূল্য ১৭ দশমিক ৫ লাখ টাকা। আগের বছর আমরা ক্রেতাদেরকে সুদবিহীন ইএমআইতে নতুন গাড়ি কেনার সুযোগ দিয়েছি। এখন সেটারও প্রয়োজন পড়ছে না। সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে নতুন প্রোটন গাড়ি কিনছেন। এ ছাড়া আমাদের পরবর্তী SUV PROTON X50 আসছে আরও সাশ্রয়ী দামে। আমাদের গাড়ির সঙ্গে ক্রেতারা পাচ্ছেন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ির আসল স্পেয়ার ও যন্ত্রাংশ ক্রয়ের এবং তাৎক্ষণিক গাড়ি ডেলিভারির সুবিধা। এসব শুধু সম্ভব পিএইচপি অটোমোবাইলস লিমিটেডের সৌজন্যে।
ক্যানভাস: আপনাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
তাসির করিম: পিএইচপি অটোমোবাইলস লিমিটেড পিএইচপি ফ্যামিলির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান একজন সফল উদ্যোক্তা। তার সুযোগ্য সন্তান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আকতার পারভেজের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটি অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে দেশীয় গাড়ির আবির্ভাব ও বিস্তার লাভ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা এবং দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে রাখা পুরোনো গাড়ির জঞ্জাল সাফ করে দেশীয় গাড়িনির্ভর একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়া। এ কাজ করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টার পাশাপাশি দরকার সরকারের সুদৃষ্টি এবং সর্বসাধারণের ঐকান্তিক সদিচ্ছা। এ দেশের মানুষ পরিবেশদূষণকারী পুরোনো গাড়ি না কিনে দেশে বানানো নতুন গাড়ি ব্যবহার করলে আগামীতে আমরা জাপান-মালয়েশিয়ার মতো একটি স্বনির্ভর ও পরিবেশবান্ধব দেশ পাব।
ক্রেতাদের হাতে সেরা মূল্যে তুলে দিচ্ছি জাপানিজ ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি
-শোয়েব আহমেদ
ডিভিশনাল ডিরেক্টর, মিতসুবিশি মোটরস বাংলাদেশ, র্যাংগ্স লিমিটেড
ক্যানভাস: এত গাড়ির ব্র্যান্ডের মধ্যে কেন একজন ক্রেতা মিতসুবিশি মোটরস বেছে নেবেন?
শোয়েব আহমেদ: মিতসুবিশি মোটরস ১৫০ বছরের পুরোনো জাপানিজ বহুজাতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি। এ দেশের রাস্তায় দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে মিতসুবিশির বিভিন্ন মডেলের গাড়ি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের গাড়িগুলোর ফিচারস ও ডিজাইন প্রতিনিয়ত আপডেট করা হয়। নতুন আকর্ষণীয় ডায়নামিক শিল্ড ডিজাইন কনসেপ্ট গাড়িগুলোতে স্টাইলিশ ডিজাইন ল্যাঙ্গুয়েজের প্রতিফলন, যা একই সেগমেন্টের অন্যান্য ব্র্যান্ডের গাড়ি থেকে ইউনিক ও ফ্যাশনেবল। এ ছাড়া আমাদের গাড়িগুলো ব্র্যান্ড নিউ (জিরো মাইলেজ) হওয়ার ফলে গাড়ির পারফরম্যান্স ও মাইলেজ অসাধারণ।
ক্যানভাস: কোন দিক থেকে মিতসুবিশি অন্যান্য জাপানিজ গাড়ির চেয়ে আলাদা?
শোয়েব আহমেদ: বর্তমানে আমাদের দেশের রাস্তায় চলা বেশির ভাগ জাপানিজ গাড়িই রিকন্ডিশন্ড। এই গাড়িগুলো তৈরি করা হয় JDM বা জাপানিজ ডোমেস্টিক মার্কেটের জন্য। তাই বাংলাদেশের পরিবেশে এই গাড়িগুলোর পারফরম্যান্স আশানুরূপ হয় না, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেইনটেন্যান্স খরচ বাড়তে থাকে। মিতসুবিশি মোটরস বাংলাদেশে ক্রেতাদের হাতে সেরা মূল্যে জাপানিজ ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি তুলে দিচ্ছে; সঙ্গে থাকছে বিক্রয়োত্তর সেবা।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপনাদের গাড়িগুলো কতটা পরিবেশবান্ধব?
শোয়েব আহমেদ: দেখুন, জাপান সারা বিশ্বে সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জাপানিজ ব্র্যান্ড হিসেবে পরিবেশের সঙ্গে প্রযুক্তির মেলবন্ধনের মাধ্যমে সেরা সমাধান বের করাই মিতসুবিশি মোটরসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আমাদের গাড়িগুলোতে ব্যবহার করা হয় MIVEC (Mitsubishi Innovative Valve Timing Electronic Control System) ইঞ্জিনসহ নানা ধরনের সর্বাধুনিক পরিবেশবান্ধব টেকনোলজি। প্রতিটি গাড়ি ক্রেতাকে হ্যান্ডওভার করার আগে কার্বন এমিশন টেস্ট পারফর্ম করা হয়। এ ছাড়া ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে নিয়ে এসেছি আমাদের হাইব্রিড গাড়ি ‘Outlander PhevÕ’ যা প্ল্যাগ-ইন হাইব্রিড ভেরিয়েন্টের একটি গাড়ি। গাড়িটি একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও মাইলেজের দিক থেকে অসাধারণ। এ ছাড়া আমাদের বেশির ভাগ গাড়িতে আছে ‘ECO Mode’, যার মাধ্যমে গাড়ির কার্বন নিঃসরণ হয় কম ও মাইলেজ পাওয়া যায় বেশি।
ক্যানভাস: ক্রেতারা আপনাদের কাছ থেকে কী ধরনের বিক্রয়-পরবর্তী সেবা পেয়ে থাকেন?
শোয়েব আহমেদ: র্যাংগ্স লিমিটেড বাংলাদেশে মিতসুবিশি মোটরস-এর অথরাইজড ডিলার। আমাদের গাড়িগুলোতে থাকে ৩ বছর পর্যন্ত ওয়ারেন্টি। র্যাংগ্স ওয়ার্কশপ দেশের স্বনামধন্য ও বৃহৎ ওয়ার্কশপগুলোর অন্যতম। এখানে মিতসুবিশি গাড়ির সব ধরনের অরিজিনাল পার্টস পাওয়া যায় এবং দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে সার্ভিসিং করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে আমাদের অথরাইজড সার্ভিসিং পয়েন্ট। তাই বিক্রয়-পরবর্তী সেবা নিয়ে আমাদের ক্রেতারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
লাইফস্টাইল ডেস্ক