ত্বকতত্ত্ব I হেতু হরমোন
ত্বকের ধরন কিংবা আচরণ—সবেতেই এর প্রভাব প্রমাণিত। যার ভিত্তিতে সৌন্দর্যের চর্চা আর পণ্যের পরিবর্তন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
গ্লোবাল লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড সিনথিয়া রাওলির সিইও অ্যালি এগান। তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারী হলেও এটি নিয়ে কখনো তাকে খুব একটা বড় সমস্যায় পড়তে হয়নি। স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে এগানের পছন্দ ছিল লাক্সারি ব্র্যান্ড লা মের ও ক্লিনিকের প্রোডাক্ট। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন খেয়াল করলেন, তার ত্বক আগের মতো তৈলাক্ত নেই। হঠাৎ করে অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে গেছে। এত বেশি যে, মুখে ড্রাই প্যাচ পর্যন্ত দেখা দিয়েছে। এই সমস্যা নিয়ে তিনি বেশ কয়েকজন ডার্মাটোলজিস্টের দ্বারস্থ হন। সবাই জানান, এটি কন্টাক্ট ডারমাটাইটিস ছাড়া কিছুই নয়। আর এটি হয়েছে তার ব্যবহৃত কোনো প্রোডাক্ট থেকে। ডারমাটোলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী নিজের বিশ্বস্ত প্রোডাক্টগুলো ব্যবহার করা বন্ধ করলেন। তার স্কিনকেয়ার রুটিনে যোগ হলো নতুন সব পণ্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। এভাবে কেটে গেল কয়েকটি বছর।
ঠিক চার বছর পর অ্যালি এগান খুব অপ্রত্যাশিতভাবে তার ত্বকের সমস্যার আসল রহস্য উদঘাটন করলেন। মা হওয়ার জন্য অনেক দিন ধরে চেষ্টায় ছিলেন তিনি। শেষমেশ তাকে যেতে হয় ফার্টিলিটি ক্লিনিকে। অ্যালি সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, তিনি হাশিমোতো ডিজিজে আক্রান্ত। এটি একধরনের অটোইমিউন ডিজিজ, যা থাইরয়েডকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই রোগ তার বন্ধ্যাত্ব ও ত্বকের ড্রাই প্যাচের কারণ। সঠিক ওষুধ ও ডায়েটের মাধ্যমে তিনি দুটি সমস্যা থেকে একসঙ্গে মুক্তি পান।
শুধু অ্যালি এগান নয়, তার মতো এমন হাজারো নারী আছেন, যারা হরমোনের ভারসাম্যহীনতায় ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগে থাকেন। এ সম্পর্কে না জানার ফলে নানা রকমের স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন। এতে সমস্যার কোনো সমাধান তো হয়ই না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্বক ও শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়। সেই সঙ্গে অর্থেরও অপচয় হয়।
ত্বকের ওপর হরমোন অনেক বড় প্রভাব ফেলে। যেমন, বয়ঃসন্ধিকালে হরমোন পরিবর্তনের জন্য ছেলেমেয়ে উভয়ের ত্বকে হরমোনাল অ্যাকনে দেখা দেয়। গর্ভকালীন অনেকের ত্বকে মেলাজমা বা মেছতা হয়, থাইরয়েড সমস্যার কারণে ত্বক অনেক শুষ্ক ও কিছু ক্ষেত্রে কালচে হয়ে যায়। পেরিমেনোপজ ও মেনোপজের সময়ও একই সমস্যা দেখা দেয়। আবার কিছু হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল হয়। এই সমস্যাগুলো শুধু কিছু নির্দিষ্ট প্রোডাক্ট ব্যবহারে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। সবার আগে দরকার সঠিক হরমোন চিকিৎসা ও ডায়েট। এর সঙ্গে এমন স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহার করা উচিত, যা এই মেডিকেশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অ্যালি এগান এমন একটি স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড তৈরির অনুপ্রেরণা পেলেন, যা হরমোনের ওপর ভিত্তি করে ত্বকের চাহিদা অনুযায়ী নিরাপদ ও কার্যকরী প্রোডাক্ট সরবরাহ করবে। করোনা পরিস্থিতি যখন খুব খারাপ, ঠিক তখন সিনথিয়া রাওলির সিইও পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জমানো কিছু অর্থ নিয়ে দীর্ঘ এক বছর কঠোর পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন ‘ভেরাসিটি’—ইতিহাসের প্রথম বায়োফ্যাক্টরভিত্তিক স্কিনকেয়ার লেবেল। গত জুন মাসে ব্র্যান্ডটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। এর মূল লক্ষ্য সৌন্দর্যচর্চার বিজ্ঞানকে ব্যক্তিগত করে তোলা। এ জন্য ভেরাসিটি গ্রাহকদের লালা সংগ্রহ করে হরমোন ও ত্বকের পিএইচ নির্ণয় করে। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কাস্টমাররা নিজ নিজ হরমোন লেভেল এবং সেই অনুযায়ী ত্বক সুস্থ রাখার দীর্ঘস্থায়ী উপায় ও উপাদান সম্পর্কে জানতে পারেন।
টেস্ট পারসোনাল হলেও ভেরাসিটির প্রোডাক্ট কিন্তু বেসপোক নয়। এসব প্রোডাক্টের মধ্যে আছে হরমোনজনিত কারণে হওয়া ত্বকের সমস্যাগুলো সারাতে সক্ষম—এমন সব উপাদানে তৈরি চারটি ভাইটাল কনসেন্ট্রেট, একটি ময়শ্চারাইজার ও একটি সেরাম। এ ছাড়া কাস্টমারদের জন্য ডায়েট, লাইফস্টাইল ও সাপ্লিমেন্ট-সংক্রান্ত পরামর্শ দিতে ভেরাসিটিতে নারী চিকিৎসকদের একটি দল নিয়োজিত আছে। এই মেডিকেল টিমে আছেন ডার্মাটোলজিস্ট, এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, ওবসটেট্রেশিয়ান-গাইনোকোলজিস্ট, ফাংশনাল মেডিসিন, মলিকিউলার ও ইন্টিগ্রেটিভ ফিজিওলজি অথবা নিউট্রিশন বিশেষজ্ঞ।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা অনেক কারণে হতে পারে। এর জন্য লাইফস্টাইল বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। সৌন্দর্যচর্চা এরই অংশ। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মহিলা দিনে গড়ে ১২টি সৌন্দর্যপণ্য ব্যবহার করেন, আর এগুলোতে কম করে হলেও ১৬৮টি রাসায়নিক উপাদান থাকে। অনেক স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট আছে, যেগুলোতে ইনগ্রেডিয়েন্ট হিসেবে হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায় এমন কিছু কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এদেরকে এন্ডোক্রাইন-ডিসরাপ্টিং কেমিক্যালস বা ইডিসি বলে। আবার কিছু ইডিসি কিন্তু কারসিনোজেন। অর্থাৎ এ উপাদানগুলো শুধু হরমোন বিঘ্নকারীই নয়, পরোক্ষভাবে ক্যানসারের জন্যও দায়ী। সবার উচিত এই কেমিক্যাল সম্পর্কে জানা এবং যেকোনো সৌন্দর্যপণ্য কেনার সময় ইনগ্রেডিয়েন্ট লিস্ট পড়ে নেওয়া। সবচেয়ে বেশি যে ইডিসিগুলো স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টে দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন ধরনের প্যারাবেন, যেমন: মিথাইলপ্যারাবেন, বুটালপ্যারাবেন, প্রোপিলপ্যারাবেন, আইসোবুটালপ্যারাবেন, বেনজিলপ্যারাবেন। এছাড়া ফরমালডিহাইড, ফ্রেগরেন্স, লিড, মার্কারি, অক্সিবেনজন, সোডিয়াম লরেল/ইথার সালফেট (এসএলএস, এসএলইএস), ডায়াথিলিন গ্লাইকল (ডিইজি) আছে লিস্টে।
এ ছাড়া তালিকায় আছে নানা ধরনের প্লাস্টিক। যেমন পলিইথিলিন (পিই), পলিপ্রপিলিন (পিপি), পলিমিথাইল মিথাক্রাইলেট (পিএমএমএ), নাইলন (পিএ), পলিইউরেথিন, অ্যাক্রিলেট কোপলিমার। প্লাস্টিকের কথা এলে প্যাকেজিংয়ের কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। সহজলভ্যের জন্য বেশির ভাগ স্কিনকেয়ার পণ্যে প্লাস্টিক প্যাকেজিং ব্যবহার করা হয়। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, প্লাস্টিকের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টে ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে বিক্রিয়া করার ক্ষমতা আছে। এমন একটি কেমিক্যাল হলো বিসফেনল-এ বা বিপিএ। এটি বর্তমানের অন্যতম ভয়ানক মনুষ্যসৃষ্ট রাসায়নিক উপাদান, যা প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ে বেশি পাওয়া যায়। বিপিএ একটি ইডিসি ও জেনোএস্ট্রোজেন। জেনোএস্ট্রোজেনের কাজ হলো, এস্ট্রোজেন হরমোনকে নকল করে মানবদেহে এর স্বাভাবিক কর্মকান্ড কে ব্যাহত করা।
ভেরাসিটির প্রোডাক্ট সব ধরনের ইডিসি মুক্ত। ব্র্যান্ডটির ওয়েবসাইটে গেলে একটি ইনগ্রেডিয়েন্ট লিস্ট পাওয়া যাবে। সেখানে রয়েছে ১০৩টির মতো হরমোন ও ত্বকের জন্য নিরাপদ কেমিক্যাল ও প্ল্যান্ট এক্সট্রাক্ট এবং ৩০টির মতো ক্ষতিকর হরমোন ডিসরাপ্টারের নাম। এই লিস্ট করা হয়েছে সবাইকে স্কিনকেয়ার ইনগ্রেডিয়েন্ট সম্পর্কে সচেতন করতে। এটি শুধু ভেরাসিটির কাস্টমারদের জন্য নয়, সবার জন্য। কারণ, এই হরমোন টেস্টিং স্কিনকেয়ার অনেকের জন্যই সুলভ নয়। যাদের সামর্থ্য নেই, তারা যেন অন্তত ইডিসি ও টক্সিনযুক্ত প্রোডাক্ট এড়িয়ে নিজেদের ত্বক ও শরীরের যত্ন নিতে পারেন, সে জন্য এই ব্যবস্থা।
অনেক ডার্মাটোলজিস্ট ও বিউটি এক্সপার্টদের ধারণা, হরমোন টেস্টিং স্কিনকেয়ার দুনিয়ার ‘নেক্সট বিগ থিং’। ভবিষ্যতে ভেরাসিটির মতো আরও অনেক ব্র্যান্ডের আবির্ভাব হওয়ার একটা প্রবল সম্ভাবনা আছে। আর এভাবে স্কিনকেয়ার সবার জন্য ইনক্লুসিভ হবে।
মডেল: মিলা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: তানভীর খান