এডিটর’স কলাম I নিজের কাছে ফেরা
সন্ধ্যায় কোথাও হেঁটে আসুন। ঘুম নিয়মিত করে ফেলুন। সকালের আকাশ দেখুন কিছুক্ষণ। পুরোনো সামাজিক সম্পর্কগুলোয় ফিরে আসুন। আড্ডা দিন নিকটজন ও বন্ধুদের সঙ্গে। ভালো লাগবে। নিজেকেও পাবেন
বেশ আগে থেকেই মুঠোর মধ্যে এসে গেছে পৃথিবী। যোগাযোগের নতুন নতুন পথ ও সেতু তৈরি হয়ে চলেছে প্রযুক্তির কল্যাণে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, পরিবার, বন্ধু ও নিকটজন, সমাজ, দেশ, এমনকি বিশ্বেরও। এখন মানুষ যতটা ব্যক্তিক, ততটা বৈশ্বিক। তাদের হাতেই তৈরি হচ্ছে একেকটা প্ল্যাটফর্ম, যাতে একসঙ্গে পাওয়া যায় পৃথিবীর সবাইকে। তাদের সঙ্গে কথা বলা যায় সরাসরি, দেখাও করা যায়। এককভাবে অথবা একসঙ্গে। এসব ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম বাংলা ভাষায় সামাজিক গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত। তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে এটি বিশাল এবং বহুমুখী প্রভাব সৃষ্টিকারী এক জগৎ, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে গেছে। অনেকেই আছেন, যারা দিনের একটা সময় নির্ধারণ করে রাখেন ফেসবুকের জন্য। আবার অনেকে প্রায় সারা দিন এতেই কাটিয়ে দেন; অন্তত লগ আউট করেন না। এ-ও দেখা যায়, দিনমান নানা ব্যস্ততার পর, রাতে ঢোকেন ফেসবুকে; মধ্যরাত অব্দি সেখানেই কাটান। মাঝেমধ্যে ভাবি, যদি এটা না থাকত, তাহলে কী হতো? আগে যখন ছিল না, তখন কী করে লোকে কাটাত সময়? আমরা তো বই পড়তাম। এখন কেউ যে পড়ে না, তা নয়। বন্ধুদের সঙ্গে, কাজিনদের সঙ্গে আড্ডা হতো। এখনো হয়, তবে দূর-দেশের নিকটজনকেও পাই ইন্টারনেটের কল্যাণে। নানা রকম খেলাধুলায় মেতে থাকতাম আমরা, বেড়াতে যেতাম, সিনেমা দেখতাম হলে গিয়ে। এসবের কিছুই তো এখনকার মানুষ বাদ দেয়নি।
আমি সব সময় মানুষের সম্ভাবনায় আস্থা রাখি; মনে করি, মানুষ শেষ পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ পথই খুঁজে নেয়। তার চাই অনেক বিকল্প, কেননা, সবচেয়ে উপযোগীটাই তাকে বেছে নিতে হবে।
জীবনের প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি বস্তুর ভালো ও মন্দ দিক আছে। ভালো যা, তা আমাদের কারণেই; মন্দও বর্তায় আমাদের ওপর। কিন্তু অতি মাত্রায় কিছুই সুখকর নয়, কোনো কিছুতে অতি নির্ভরশীলতাও সুফল বয়ে আনে না শেষ পর্যন্ত। ফেসবুক ও অন্য সামাজিক মাধ্যমগুলো ক্ষতিকর কিছু নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের জীবন ও যোগাযোগ সহজ আর প্রীতিকর হয়ে ওঠে এর বদৌলতে। কিন্তু যারা এতে আচ্ছন্ন, তাদের জন্য এটা একরকম স্নায়বিক চাপ বৈকি। বিশেষত আমাদের মধ্যে যারা খুব সংবেদনশীল, তারা এই ভার্চ্যুয়াল জগতের মধ্যে একসময় হাঁসফাঁস অবস্থার মুখে পড়েন। কিন্তু ছাড়তেও পারেন না, কেননা তারই অজ্ঞাতসারে এটা নিজের লাইফস্টাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। ফলে, তার জীবনের মূল্যবান সময় এই জগতে হারিয়ে যেতে থাকে।
যে বিচিত্রমুখী বাস্তবতার মধ্যে আমাদের বসবাস, সামাজিক মাধ্যমগুলো তা থেকে আমাদের মুক্তির আনন্দ জোগায়; কিন্তু এটা যদি পেয়ে বসে, সেই অবস্থা থেকেও তো বের হওয়া দরকার। নিজের কাছে ফিরে আসার জন্য। তা বলে একেবারে বাদ দেয়া নয়। সঙ্গেই থাকুক। আমাদের জীবনে সত্যিকারের দু-চারজন বন্ধু ও নিকটজন থাকেন, যাদের সঙ্গে দু-চার দিন দেখা বা কথা না হলেও সম্পর্ক আগের মতোই থাকে, কোনো পার্থক্য ঘটে না। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমকে সেভাবেও দেখতে পারেন। এটা আছে, থাকবে। এর মধ্য দিয়ে যাদের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব ও সখ্য, তারাও আছেন এবং থাকবেন। যদি বন্ধন আত্মিক হয়ে থাকে। শুধু জানিয়ে দিন, নইলে তারা উদ্বিগ্ন হতে পারেন। ব্যস, কয়েক দিনের জন্য নিজের কাছে এলেন, নিজেকেই দিলেন খানিকটা সময়। একটু রিফ্রেশড হলেন, এই তো! তারপর যখন ফের লগ ইন করলেন, তখন দেখবেন, এই প্রবেশ ও বিচরণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। বন্ধু ও নিকটজনের স্বাগত সম্ভাষণে আপনার মন ভরে উঠছে।
কথাগুলো তাদের জন্যই, ভার্চ্যুয়াল এই জগতে যারা প্রতিদিনই সময় কাটান; কিন্তু এই অভ্যাসে খানিকটা বিরতি দেয়ার কথা ভাবতে পারেন না। ভাবলেও তা হয়ে ওঠে না। কোনো অভ্যাস বা প্রবণতা থেকে একবার বের হয়ে এসেও তো আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি নিজেদের ইচ্ছাশক্তি কেমন, আর এই বিরতিটুকু কী কাজে লাগে, কতটা সুফল নিয়ে আসতে পারে। সত্য যে, সামাজিক এসব মাধ্যমের হোমপেজ, ওয়াল মানে বিচিত্র ইস্যুর ভান্ডার। কোনো কোনোটিতে মন বেদনায় ভরে যায়, রাগ হয়; মাঝেমধ্যে উৎকণ্ঠায় এমন অবস্থা হয়, রাতে ঘুমানোও কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ অনেক প্রীতিকর বিষয়ও পাই আমরা, অনেক তথ্যও তাতে থাকে, যেগুলো আনন্দদায়ক। কিন্তু মানুষের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, কারও কারও মানসিক চাপ এত বেশি, কোনো সুসংবাদ তাকে স্বাভাবিক সুখটাই দিতে পারে না।
আর যারা আসক্ত? তারা কি জানেন এই আসক্তি নিজেদের থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে? বডি ক্লক বলে একটা কথা আছে, বাংলায় যাকে বলে দেহঘড়ি। এটি ঠিকমতো না চললে যে কত রকমের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ঘটে শরীরে ও মনে, তা আসক্তদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। অনলাইন আসক্তি আর সব নেশার মতোই ক্ষতিকর। দেহ ও মন- দুদিক দিয়েই। যেমন, রাতের পর রাত জেগে থাকার কারণে চুল ঝরে যায়, মেরুদ- ও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। চোখে সমস্যা তো অবধারিত; স্মরণশক্তি কমে যায়, মাথা ব্যথা হয়, মানসিক চাপে একধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। ফলে দিনের স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় কাজে বিঘ্ন ঘটে, ভুলের শঙ্কা থেকে যায়। সুতরাং সময় থাকতে বিরতি দিন। সন্ধ্যায় কোথাও হেঁটে আসুন। ঘুম নিয়মিত করে ফেলুন। সকালের আকাশ দেখুন কিছুক্ষণ। পুরোনো সামাজিক সম্পর্কগুলোয় ফিরে আসুন। আড্ডা দিন নিকটজন ও বন্ধুদের সঙ্গে। ভালো লাগবে। নিজেকেও পাবেন।
সবকিছু নিয়েই তো আমাদের আনন্দে থাকতে হবে। কিন্তু কোনো কিছুকেই জীবনের ওপর চেপে বসতে দেয়া ঠিক নয়। নিজের মতো করে চলুন। নিজের জন্য। জীবন শেষ পর্যন্ত সুন্দর।