আলাপন I সুরপথিক
‘নীলাঞ্জনা নামে ডেকোনা’, ‘তুমি মেঘ দেখেছো’, ‘এলোমেলো চুল’ আর ‘ললাটের ভাঁজ’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি। ডুবে আছেন সুরের ভুবনে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপার জীবনসঙ্গী। সুরকার ও সংগীত পরিচালক মইনুল ইসলাম খানের অর্জন আর ব্যক্তিগত ভাবনা উঠে এসেছে ক্যানভাসের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে
সংগীত জগতে প্রবেশ, প্রেরণা, সাফল্য…
– প্রথমত, শিল্পের প্রতি ভালোবাসার জন্ম পারিবারিক সূত্রেই। আমার পরিবারে নিয়মিত সংগীতচর্চা হতো; সেই ধারায় সংগীতকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়া। আমার বড় ভাই শওকত হায়াত খান পেশায় একজন সরকারি চাকুরীজীবী ছিলেন এবং পাশাপাশি তিনি একজন কন্ঠশিল্পী ছিলেন। বলতে গেলে তিনিই আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। ছোটবেলা থেকেই খেলাঘর এবং অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমরাই প্রথম ব্যাচ, যারা রেডিও এবং টেলিভিশনে ছোটদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। এরপর গান গাইতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক সমর দাশ আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সংগীত বিষয়ে তার জ্ঞান, দক্ষতা ও নির্দেশনার ভঙ্গিমা আমাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। ক্রমেই সুরের মোহে আমি আবিষ্ট হয়ে পড়ি। সেই আবেশ থেকেই আমার সুরকার হয়ে ওঠা। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা।
‘নীলাঞ্জনা নামে ডেকোনা’, ‘তুমি মেঘ দেখেছো’, ‘এলোমেলো চুল’ আর ‘ললাটের ভাঁজ’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান এ দেশের শ্রোতাকে উপহার দিয়েছেন।
– আমি খুব অল্প বয়সে অডিশনের মাধ্যমে রেডিও এবং টেলিভিশনে সংগীত পরিচালক হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। এরপর ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘অন্তরঙ্গ’র সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে আমার অভিষেক। সেটি দুই বছর নিয়মিত সম্প্রচারিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে আমার সংগীত নির্দেশনায় কনকচাঁপা চমৎকার কয়েকটি গান গেয়েছেন। যেমন-সেজান মাহমুদের লেখা ‘এলোমেলো চুল’ আর ‘ললাটের ভাঁজ’। মূলত এই দুটি গান দিয়েই আমি ও কনকচাঁপা দর্শক-শ্রোতার মন জয় করতে সক্ষম হই। এ দুটি গান এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, কলকাতা থেকে পুনঃপ্রচারের আবেদন জানিয়ে চিঠি আসে। পরবর্তী সময়ে, আউটডোরে শুটিং করে গানটি আবার প্রচার করা হয়। এরপর আমার সৌভাগ্য হয় ফজলে লোহানীর সঞ্চালনায় ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিচালনা করার। সেখানে আমার সুর করা গানগুলোর মধ্যে সেজান মাহমুদের লেখা ‘আমি নই বনলতা সেন’ বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। বাংলাদেশে যখন প্রথম সার্ক গঠিত হয়, তখন সার্কবিষয়ক বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান বিটিভিতে সম্প্রচার করা হলো। সেখানেও আমি সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পেলাম। এরপর নিয়মিত মহান ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে অসংখ্য গান পরিচালনা করেছি। আমার সৌভাগ্য হয়েছে প্রয়াত মাহমুদুন্নবীর সঙ্গে কাজ করার। পরবর্তী সময়ে শাহনাজ রহমতুল্লাহ, খুরশীদ আলম, এম এ হামিদ, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, আঞ্জুমান আরা বেগম, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, এন্ড্রু কিশোর, শাকিলা জামান, রিজিয়া পারভীন, শুভ্র দেবসহ অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি। ‘জাগরণ সাংস্কৃতিক চর্চা’ নামক সংগঠন ১০০টি দেশের গান নিয়ে ‘জাগরণের গান’ নামে একটি অ্যালবাম রিলিজ করে, যেখানে আমার পাঁচটি গান রয়েছে। উল্লেখ্য, এর জন্য আমাকে চ্যানেল আই আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে উত্তরীয় পরানো হয় এবং পুরস্কার দেয়া হয়। এ ছাড়া ‘নীলাঞ্জনা নামে ডেকোনা’ গানটির জন্য আমি ‘বাচসাস’ পুরস্কারে সম্মানিত হই। আমেরিকায় আমাকে ঢালিউড অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে প্রয়াত মাসুদ করীম, নজরুল ইসলাম বাবু, শেখ নুরুজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও মো. রফিকুজ্জামানের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেজান মাহমুদ, কবির বকুল ও জুলফিকার রাসেলের সঙ্গে ১০-১৫ বছর ধরে কাজ করছি। ২৫টির অধিক অ্যালবামে আমার সুর সংযোজনা ও পরিচালনায় গান রয়েছে। এম.এম.আই.মিউজিক, সংগীতা, সাউন্ডটেক, লেজার ভিশন-এর সাথে অনেক কাজ করেছি, যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসবই আমার ৪০ বছরের সংগীত জীবনের অর্জন বলে মনে করি।
জীবন সম্পর্কে আপনার বোধ কিংবা বিশ্বাস…
– জীবনকে সব সময়ই আমি খুব সাধারণভাবে দেখতে চাই। আমার মতে, জীবনে জটিলতা যত পরিহার করে চলা যায়, জীবন ততই মঙ্গলময় হয়। আমি কখনও ফরমায়েশি কাজ করিনি এবং বাণীর ব্যাপারে আমি খুব সচেতন।
কী করতে চান ভবিষ্যতে? বিশেষ কোনো পরিকল্পনা?
– খুব বেশি পরিকল্পনা করে আমার কাজ করা হয়ে ওঠে না। শুধু এটুকুই চাইব, সংগীতবিষয়ক যা কিছু আমি জেনেছি, বুঝেছি ও শিখেছি, তা সবার মাঝে যেন বিলিয়ে দিতে পারি।
সিনেমা দেখা হয়?
– আজকাল অবসরে চলচ্চিত্র সবার মতো আয়োজন করে খুব বেশি দেখা হয়ে ওঠে না। তবে একসময় খুব দেখতাম। আমার পছন্দের চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘স্পার্টাকাস’ এবং ‘টু উইমেন’ উল্লেখযোগ্য। দুটি চলচ্চিত্রই আমি বহুবার হলে গিয়ে দেখেছি।
সংগীত তো আপনার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। তবু প্রিয় কোনো গান কি আছে?
– আমার পছন্দের গানের তালিকা বিশাল। তবে খুব প্রিয় কিছু গান আছে, যা সব সময় আমাকে আন্দোলিত করে। যেমন আমাদের দেশের একজন প্রতিভাবান শিল্পী প্রয়াত লাকী আখান্দের গান আমার ভীষণ প্রিয়। এ ছাড়া নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’; কুমার বিশ্বজিৎ-এর “যেখানেই সীমান্ত তোমার”; আলাউদ্দিন আলীর কথা ও সুরে এবং মিতালি মুখার্জির কণ্ঠে ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছো তুমি’ আমার অসম্ভব পছন্দের গান। আর আমার নিজের গানের মধ্যে কনকচাঁপার কণ্ঠে ‘নীলাঞ্জনা নামে ডেকোনা’, ‘তুমি মেঘ দেখেছো’, ‘রক্ত রাঙা সন্ধ্যা রবি’, ‘দু-ফোঁটা বৃষ্টিতে মনটা আমার’, ‘কিছুতেই মন ভোলে না’ এবং ‘যে দেশেতে শহীদ মিনার’ আমার পছন্দের গানের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
সবার জীবনেই অন্তত একজন আদর্শ থাকেন। আপনার জীবনের আদর্শ হিসেবে কার নামটি স্মরণে আসে?
– সংগীতের দিক থেকে বিচার করলে আমার আদর্শ শ্রদ্ধেয় লতা মঙ্গেশকর। আর জীবনের দর্শন বা নীতিগত দিক বিবেচনায় আমার মা কামরুন্নাহার খানম আমার আদর্শ।
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের উদ্দেশে যদি কিছু বলার থাকে।…
– সংগীতে সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধিলাভ করা যায়। আজকাল অনেকেই দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার চিন্তায় মগ্ন। কিন্তু সংগীতের প্রকৃত মর্মার্থ হয়তো তারা জানে না। তাই নতুন প্রজন্মের যেসব শিল্পী সংগীতের জগতে প্রবেশ করেছে বা করতে যাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকুই বলা, তারা যেন সংগীতের মর্ম বুঝে এর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে একে ধারণ করে।
ছবি সৌজন্য: মইনুল ইসলাম খান