skip to Main Content

মনোযতন I সম্মোহনে দূর মনের ব্যারাম

মনের অসুখ সারাতে ক্লিনিক্যাল হিপনোথেরাপির কদর বাড়ছে দুনিয়াজুড়ে। লিখেছেন তানজিরা নূর

বয়স, অভিজ্ঞতা কিংবা জ্ঞানের পরিধি অনুযায়ী আমরা একেকজন একেক অবস্থানে। কারও রয়েছে নির্দিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জটিলতা, কারও হয়তো একদমই সমস্যা নেই। সুস্থ স্বাভাবিক আছি। ছোট থেকে বড় হওয়ার কালে আমরা সাধারণত সবকিছু পরিবার থেকেই শিখেছি। কিন্তু আলাদা করে আমাদের জীবনের ট্রমা বা মানসিক আঘাত এবং এর ফলে দৈহিক অসুস্থতা সম্পর্কে হয়তো তেমনভাবে শিখিনি কিছু। যেকোনো মানসিক আঘাত মোকাবিলা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা পারিবারিক শিক্ষা তেমনভাবে সবাই পায় না। অথচ জানা কথা, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার এবং মানসিক আঘাত মোকাবিলার শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলে বেশি উপকৃত হতে পারতাম।
জীবনে নানা পরীক্ষা আসবে, দুর্ঘটনা আসতে পারে, কষ্ট পেতে পারি। এই কষ্টগুলো কীভাবে মোকাবিলা করব আর কীভাবে সেগুলোকে অন্যদিকে পরিচালনা করব, তা সবার জানা থাকা ভালো। এই আধুনিক সময়ে যখন হাতের মুঠোয় পুরো বিশ্ব, আর গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলো যখন খুবই সহজলভ্য, একটু সময় নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে যদি নিজেরাই খোঁজখবর করি আর নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের রক্ষণাবেক্ষণে একটু সচেষ্ট হই, তাহলে গুরুতর কোনো মনোরোগ থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। জীবনে যেকোনো ধরনের কষ্ট আসতে পারে—সন্তান হারানো, সম্পদ হারানো, সৌন্দর্যহানি, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া, প্রিয়জনকে হারানো, ক্ষমতা হারানোর কষ্ট ইত্যাদি। চাইলেই সেই কষ্ট এক তুড়িতে দূর করতে পারব না; কিন্তু দৃঢ়ভাবে সেগুলো মোকাবিলা করে মানসিক স্বাস্থ্যকে অক্ষুণ্ন রাখা তো সম্ভব।
আর এ কাজে সহায়তা করতে বর্তমানে বিভিন্ন রকমের গাইডেড মেডিটেশন ছাড়াও ক্লিনিক্যাল হিপনোথেরাপির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে লাইফ কোচ কিংবা থেরাপিস্টের সহযোগিতায় হিপনোসিসের মাধ্যমে মানসিক অবসাদ কিংবা অস্থিরতা দূর করার পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। সাইকোথেরাপির অন্যান্য সাধারণ শাখার একটি হলো ক্লিনিক্যাল হিপনোথেরাপি। এখানে কোনো ওষুধ ছাড়া শুধু থেরাপিস্টের সহযোগিতায় মানসিক বিভিন্ন অসুস্থতা চিকিৎসার প্রচলন দিন দিন সমাদৃত হচ্ছে।
একদিকে যেমন সুস্বাস্থ্যের জন্য মানুষ হেলদি ডায়েটের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন, অর্গানিক ফুড পাচ্ছে জনপ্রিয়তা, তেমনি অলটারনেটিভ ট্রিটমেন্ট হিসেবে হিপনোথেরাপি এখন নতুন মাত্রা যোগ করছে। ক্লিনিক্যাল হিপনোথেরাপির মাধ্যমে ওজন ও ব্যথার উপসর্গ, ধূমপানের আসক্তি, স্লিপ ডিসঅর্ডার, অবসাদ, উৎকণ্ঠা, আইবিএস বা পেটের পীড়াদায়ক অস্থিরতাসহ আরও অনেক যাতনা সারিয়ে তোলা যায়। বিনা ওষুধে শুধু থেরাপিস্টের সঙ্গে এক বা একাধিক সেশনের মাধ্যমে এ চিকিৎসা করা সম্ভব। অ্যাংজাইটি বা উৎকণ্ঠা আমাদের সমাজে বা সমাজব্যবস্থায় খুবই সাধারণ ও বহুল উপলব্ধ একটি মানসিক অস্থিরতা কিংবা বৈশিষ্ট্য। সমাজের কম-বেশি সব শ্রেণির মানুষই কখনো না কখনো এর সম্মুখীন হয়। এই উৎকণ্ঠা থেকে কিছুক্ষণের জন্য মনকে সরিয়ে নিয়ে শান্ত করে, শিথিলায়নের মাধ্যমে সতেজ ও কর্মক্ষম করে তোলাই ক্লিনিক্যাল হিপনোসিসের কাজ।
বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে এই সেবা শুরু করলেও এ ব্যাপারে খুব বেশি মানুষের তেমন ধারণা নেই। হিপনোসিস কথাটি শোনামাত্রই হয়তো মনে পড়ে যায় পেন্ডুলাম থেকে কেউ কাউকে সম্মোহন করছে! অথচ বাস্তবে তা ভিন্ন। ক্লিনিক্যাল হিপনোথেরাপি সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক একটি প্রক্রিয়া, যা মনের সাবকনসাস অংশকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে সুস্থভাবে মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। মনের গভীর থেকে গভীরে গিয়ে মনকে শান্ত করে শক্তি আর সাহস জোগানোই এর কাজ। পাশ্চাত্যের মতো এখন ধীরে ধীরে প্রাচ্যের দেশগুলোতেও তাই ক্লিনিক্যাল হিপনোথেরাপির প্রচলন বাড়ছে। ট্রমা বা মানসিক আঘাত থেকে হিলিংয়ের জন্য এই চিকিৎসা অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোভিডবিষয়ক অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠায় বহু মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ঝুঁকিতে ভুগছেন। আয়ের উৎস কমায় পরিবারকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে না পেরে হতাশ হয়ে এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন কেউ কেউ। মনের কষ্টগুলো কাউকে বলতে না পারা থেকেই মানসিক ব্যাধির উৎপত্তি। যে যেখানেই থাকি না কেন, ছাত্র কিংবা গৃহিণী বা সুপার মডেল অথবা চিকিৎসক কিংবা রোগী—প্রত্যেকেই আমরা মানুষ। দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সমন্বয়ে তৈরি পরিপূর্ণ মানুষ। তাই পরিপূর্ণতাকে অক্ষত রাখতে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হতে পারে এমন বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি জানা ও বোঝা দরকার। সচেতনতা ও সবার সাহায্যের হাতই পারবে আমাদেরকে সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী করতে। ক্লিনিক্যাল হিপনোসিস বিজ্ঞানের এক বিশেষ শাখা হিসেবে মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। কেননা ‘মন ভালো যার, সব ভালো তার’ মূলমন্ত্রই সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত্তি।

লেখক: ক্লিনিক্যাল হিপনোথেরাপিস্ট
লন্ডন কলেজ অব ক্লিনিক্যাল হিপনোসিস এশিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top