টেকসহি I সোয়াপ টু সাসটেইনেবল
পৃথিবীবান্ধব হতে শুরু করেছে সৌন্দর্যশিল্প। সে যাত্রায় শামিল হতে চাইলে প্রয়োজন স্থির সংকল্প। সেই সঙ্গে রোজকার সৌন্দর্যচর্চার ছোট ছোট কিছু অদলবদল। বাকিটা জানাচ্ছেন ফাহমিদা শিকদার
লিকুইড→ সলিড
হেয়ার কেয়ার প্রডাক্ট যেমন শ্যাম্পু বা কন্ডিশনার লিকুইড হয়ে থাকে। এ জন্য লিক প্রুফ কনটেইনারের প্রয়োজন। তাই বেশির ভাগ হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ড প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরশীল। এক সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে একটি পরিবার গড়ে ২১৬টির প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের হেয়ার কেয়ার প্রডাক্ট ব্যবহার করে। স্পষ্টতই এই বোতলগুলো পরিবেশের সবচেয়ে বড় দূষক। তবে এখন হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ড শ্যাম্পু ও কন্ডিশনারের সলিড ফর্ম বাজারে এনেছে। এবার শ্যাম্পুগুলোর প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে জীবাণুবিয়োজ্য কাগজ বা অ্যালুমিনিয়ামের কৌটা। কিছু ব্র্যান্ড কোনো প্যাকেটের ধারে-কাছেও যাচ্ছে না। যেমন—বিউটি ব্র্যান্ড লাশ। খুব বেশি দিন হয়নি গার্নিয়ার, ল’রিয়েলের মতো জনপ্রিয় ও সহজলভ্য ব্র্যান্ডগুলো এ ধরনের প্রডাক্ট উৎপাদন শুরু করেছে। মানুষও আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। তাই সলিড বিউটি প্রডাক্টের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ছাড়াও ফেস ক্লিনজার, ময়শ্চারাইজার, সানস্ক্রিন বার আকারে পাওয়া যাচ্ছে।
ক্লিনজিং ওয়াইপস/কটন প্যাড→ রিইউজেবল কটন ক্লথ/মেকআপ রিমুভাল স্পঞ্জ
যারা মেকআপ ওঠানোর জন্য ক্লিনজিং ওয়াইপস বা ডিসপোজেবল কটন প্যাড ব্যবহার করেন, এখনই সময় সেটা বন্ধ করার। ফেস ওয়াইপস দিয়ে যে খুব সহজে মুখের সব মেকআপ পরিষ্কার করে ফেলা যায়, ব্যাপারটা এমন নয়। এগুলো বেশ রুক্ষ হয় এবং অনেক ঘষাঘষি করা লাগে। এতে ত্বকে মাইক্রো-টিয়ার তৈরি হয়; যা ব্রণ, বলিরেখার মতো সমস্যার জন্য দায়ী। এগুলো যে উপাদানে ভেজানো থাকে, সেটিও খুব ভালো কিছু নয়। প্লাস্টিক স্ট্র বা ব্যাগের মতো এই সিঙ্গেল-ইউজ ফেস ওয়াইপসও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)-এর মতে, ওয়াইপস পলিয়েস্টার, পলিপ্রোপিলিন, তুলা, কাষ্ঠমণ্ড অথবা রেয়ন ফাইবারের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি। এগুলোর মধ্যে অনেক উপাদান আছে, যা জীবাণুবিয়োজ্য নয়। বেশির ভাগ ওয়াইপস ল্যান্ডফিলে বছরের পর বছর পড়ে থাকে।
অনেকে কটন প্যাডকে ফেস ওয়াইপসের চেয়ে ভালো অপশন মনে করেন। কিন্তু তুলা উৎপাদনের সময় প্রচুর পানির প্রয়োজন হয় এবং কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে, যা বন্য প্রাণী ও অন্যান্য গাছপালার ওপর বাজে প্রভাব ফেলে। সুসংবাদ হচ্ছে, বাজারে এগুলোর টেকসই বিকল্পের অভাব নেই। এমন কিছু রিইউজেবল কটন বা মসলিন ক্লথ এবং মেকআপ রিমুভাল স্পঞ্জ আছে, যা খুব কোমলভাবে ত্বকের সব মেকআপ পরিষ্কার করতে সক্ষম। এগুলো যেমন টেকসই, তেমনই সাশ্রয়ী। ব্র্যান্ডভেদে এক প্যাকেট (২৫ থেকে ৩০ পিস) মেকআপ ওয়াইপসের দাম তিন শ থেকে আট শ টাকা। কিন্তু একটি মেকআপ রিমুভার স্পঞ্জের দাম আশি থেকে দেড় শ টাকা। ধুয়ে পরিষ্কার করে ব্যবহার করা যায় বছরের পর বছর।
প্লাস্টিক→ অ্যালুমিনিয়াম বা গ্লাস বা গো নেকেড
নিঃসন্দেহে কসমেটিক প্যাকেজিং-মুক্ত থাকা পরিবেশের জন্য আদর্শ বিকল্প। এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় বিউটি ব্র্যান্ড লাশ, হেয়ার ও বডি কেয়ার ছাড়াও মেকআপের সলিড ফর্ম ও নেকেড প্যাকেজিংয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এখন অনেক ব্র্যান্ডই প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে প্লাস্টিককে পাশ কাটিয়ে অ্যালুমিনিয়াম ও গ্লাস বেছে নিচ্ছে। এ দুটিকেই সৌন্দর্যপণ্য প্যাকেজিংয়ের সেরা বিকল্প হিসেবে মানা হচ্ছে। অ্যালুমিনিয়াম এমন এক উপাদান, যা একই আকারে বারবার ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে ৫ শতাংশ প্লাস্টিক ও ৩৪ শতাংশ কাচের তুলনায় ৫৫ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ক্যান কার্যকরভাবে রিসাইকেল হয়। এখনো এ ধরনের প্যাকেজিং মেইনস্ট্রিম হয়নি। তবে অনেক ব্র্যান্ড আছে যারা প্যাকেজিংয়ের জন্য রিসাইকেবল অ্যালুমিনিয়াম ও গ্লাস ব্যবহার করছে। যেমন নেইবারহুড বোটানিক্যালস (ইউকের প্রথম কার্বন নেগেটিভ বিউটি ব্র্যান্ড), উই আর প্যারাডক্স, নীল’স ইয়ার্ড রেমেডিস, এভারিস্ট, ইনিকা, আপসার্কেল প্রভৃতি।
রিফিল
সাসটেইনেবল বিউটি মুভমেন্টে সাড়া দিয়ে অনেক ব্র্যান্ড হাজির হয়েছে রিফিলেবল প্যাকেজিং সিস্টেম নিয়ে। এসব ব্র্যান্ডের মধ্যে আছে রিচুয়ালস, লকসিটান, খিয়ের ওয়েস, ফেন্টি, লে লাবো, ব্লিচ লন্ডন, ফিলস, ক্যানক্যান ইত্যাদি। পণ্য ফুরিয়ে গেলে এইসব ব্র্যান্ডের ফ্ল্যাগশিপ স্টোরে জমা দেওয়ার পর তারা আবার নতুন করে রিফিল করে দেবে। আবার কিছু স্কিন ও হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ডের সেলফ সার্ভিস সিস্টেমও রয়েছে। অর্থাৎ রিফিল স্টেশনে গিয়ে নিজে রিফিল করা যাবে। হেড অ্যান্ড শোল্ডারস, প্যান্টিন, হারবাল এসেন্স, অজি পিঅ্যান্ডজি বিউটির প্রথম ব্র্যান্ড হিসেবে ইউরোপে রিফিলেবল প্যাকেজিং চালু করে। এই রিফিল সিস্টেমের ভেতর রয়েছে ১০০ শতাংশ রিইউজেবল অ্যালুমিনিয়ামের বোতল ও রিসাইকেলেবল রিফিল পাউচ, যা ৬০ শতাংশের কম প্লাস্টিক ব্যবহার করে তৈরি। পরিবেশবান্ধবের পাশাপাশি অনেক সাশ্রয়ী হওয়ায় এই প্যাকেজিংয়ের জনপ্রিয়তা অনেক।
ওয়াটারলেস বিউটি
বিশ্বে কৃষির পরেই সৌন্দর্যশিল্পে সবচেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করা হয়। কসমেটিক ইনফোর মতে, বেশির ভাগ সৌন্দর্যপণ্যের প্রধান উপাদান পানি এবং সেখানে প্রায় সত্তর ভাগ পানি ব্যবহার করা হয়। পানির এই অপচয় কমাতে হাজির হয়েছে ওয়াটারলেস বিউটির। অনেক বিউটি ব্র্যান্ড এখন পানিহীন পণ্য তৈরি করছে। এ ধরনের পণ্যে পানির বদলে বেশি অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া প্রডাক্টটি সংরক্ষণের জন্য কেমিক্যাল বা সিনথেটিক প্রিজারভেটিভের বদলে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ সিনথেটিক প্রিজারভেটিভ মানবদেহ ও পরিবেশ—কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ওয়াটারলেস বিউটির জন্ম হলেও এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পানিমুক্ত সৌন্দর্যপণ্য তৈরি হচ্ছে।
বাঁশ, কাঠ বা অ্যালুমিনিয়ামের বিউটি টুলস
সাশ্রয়ী দেখে বহু বছর ধরে কসমেটিক ব্র্যান্ডগুলো সৌন্দর্য সরঞ্জাম তৈরিতে প্লাস্টিক ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এখন সেই চিত্রে দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন। কিছু ব্র্যান্ড পরিবেশবান্ধব উপাদান যেমন বাঁশ, কাঠ, অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে সৌন্দর্য সরঞ্জাম তৈরি করছে। ইকোটুল এমন একটি বিউটি ব্র্যান্ড, যারা জীবাণুবিয়োজ্য মেকআপ ব্রাশ, মেকআপ ব্লেন্ডার ও স্কিনকেয়ার টুল তৈরি করে এ ধারায় শীর্ষ স্থান দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া দ্য বডি শপ, ওয়েস্টমেন অ্যাটেলিয়ের, এলেইট কসমেটিকস, ভ্যাপর এ ধরনের সৌন্দর্য সরঞ্জাম তৈরি করছে। শুধু মেকআপ টুলস নয়, টুথব্রাশ, চিরুনি, ডেন্টাল ফ্লস, কটন বাড এমন দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রীর সাসটেইনেবল সংস্করণ পাওয়া যাচ্ছে।
উপাদানের টেকসই উৎস
সৌন্দর্যপণ্যে ব্যবহৃত উপাদানের সাসটেইনেবিলিটি পরিবেশগত উদ্বেগের আরেকটি ক্ষেত্র। প্রসাধনীর উদ্দেশ্যে কিছু চাষ করার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কিন্তু পরিবেশে থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ পাম তেলের কথা বলা যেতে পারে। এটি সমগ্র ভোগ্যপণ্যের প্রায় অর্ধেকে ব্যবহার করা হয়। পাম উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে বন উজাড় হচ্ছে এবং অনেক প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটছে। একটি পণ্যের উপাদানগুলো টেকসইভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করার সর্বোত্তম উপায় হলো, প্যাকেজিংয়ে ফেয়ার ট্রেড এবং রেইনফরেস্ট অ্যালায়েন্স, পেটা সার্টিফায়েড লোগোগুলো খুঁজে দেখা।
ফাহমিদা শিকদার
মডেল: বর্ণা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: রিফাত রহমান
ছবি: জিয়া উদ্দীন