স্বাদশেকড় I হট ডগ
নাম শুনলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়! এই খাবারের সঙ্গে কুকুরের সম্পর্কই-বা কী? কোথায় এর আঁতুড়ঘর? জানাচ্ছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
লম্বা একটা বান বা পাউরুটির মাঝখান থেকে চেড়া। ভেতরে পুরে দেওয়া হয়েছে মাংসের সসেজ। প্রচুর মেয়নেজ এবং চিজসমৃদ্ধ এই খাবারের প্রচলন সুদূর জার্মানিতে হলেও মূলত আমেরিকানদের মাধ্যমেই হট ডগ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শরণার্থীদের সঙ্গে জার্মানি থেকে প্রথমে ইউরোপ হয়ে এটি পৌঁছে যায় আমেরিকাতে। আমেরিকার জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড হিসেবে এই খাবার ব্যাপক আলোচিত ছিল। ঠিক কোন সময় থেকে খাবারটির প্রচলন আমাদের দেশে শুরু, এর সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, বার্গারের পরপরই এ দেশে হট ডগের প্রচলন ঘটে। বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেই এখন এর সমান জনপ্রিয়তা।
নামের সঙ্গে কুকুর যুক্ত থাকলেও আমাদের দেশে হট ডগের সসেজ তৈরিতে মুরগি অথবা গরুর মাংস ব্যবহৃত হয়। যদিও ইউরোপে বেশির ভাগ সময় শূকরের মাংস দিয়েই এর সসেজ তৈরি হয়। তবে বিশ শতকে জার্মানিতে কুকুরের মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল। তাই একসময় মনে করা হতো, জার্মানরা কুকুরের মাংস দিয়ে সসেজ তৈরি করতেন। এ কারণে ১৮ শতক থেকে সেখানে সসেজের আরেক নাম হয়েছিল ডগ। যদিও এখন যেটাকে হট ডগ বলা হয়, তখন সেটাকে ডাকা হতো ‘ডাচশান্ড সসেজ’ নামে।
প্রথম দিকে হট ডগ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দিনমজুর এবং কারখানার শ্রমিকদের কাছে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট ঠেলাগাড়িতে করে সে সময় এটি বিক্রি হতো। কর্মবিরতির ফাঁকে অথবা দুপুরে খাবার বিরতিতে কারখানার শ্রমিকদের কাছে হট ডগই ছিল কাঙ্ক্ষিত খাবার। একসময় রাস্তার পাশ থেকে পুরো আমেরিকাতেই ছড়িয়ে পড়ে এটি। বদলাতে থাকে এর প্রণালিও। স্বাদের ভিন্নতার কারণে একেক অঞ্চলের মানুষ একেক রকমভাবে হট ডগ বানানো শুরু করেন।
কুকুরের মাংস দিয়েও তৈরি নয়, খাবারটি দেখতে কুকুরসদৃশও নয়, তাহলে আর কী কারণ থাকতে পারে এমন উদ্ভট নামকরণের? জানা যায়, ডাচশান্ড সসেজ পরিচিতি পাওয়া এই খাবার ঘিরে মার্কিন কার্টুনিস্ট থমাস আলয়সিয়াস দর্গান হট ডগ নাম দিয়ে একটি কার্টুন আঁকেন। কার্টুনটি রাতারাতি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। তখন থেকেই ডাচশান্ড সসেজ পরিণত হয় হট ডগে।
এই কার্টুন আঁকার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ওই কার্টুনিস্ট জানিয়েছিলেন, এক জার্মান ব্যবসায়ী নিউইয়র্কের পোলো গ্রাউন্ডের বাইরে ঠেলাগাড়ি করে গরম-গরম ডাচশান্ড সসেজ বিক্রি করছিলেন। বিক্রির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে তিনি ক্রেতাদের ডাচশান্ড সসেজ খাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থমাসও এই দৃশ্য দেখছিলেন। পোলো গ্রাউন্ডে তখন চলছিল বেসবল ম্যাচ। সেখান থেকে ফেরার পর থমাস একটি কার্টুনের মাধ্যমে ওই দিনের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন তার সংবাদপত্রে। তবু হিসাব মেলে না—কেন এর নাম হট ডগ দিয়েছিলেন থমাস! মূল মজাটা এখানেই। পোলো গ্রাউন্ডের বাইরে ওই বিক্রেতা আসলে কী নামে খাবারটিকে ডাকছিলেন বা পরিচয় দিচ্ছিলেন, থমাস তা বুঝতে পারেননি। তিনি শুধু বুঝতে পেরেছিলেন, গরম-গরম সসেজ বিক্রি করা হচ্ছে। যেহেতু একসময় জার্মানিতে সসেজকে ডগ বলা হতো, তাই তিনি তার কার্টুনে লেখেন, `Get your hot dogs while they are red hot’। নাম না বোঝা বা না জানার কারণে থমাস তার কার্টুনে নিজের মনমতো যে নাম দিয়ে দিলেন, পরবর্তী সময়ে সে নামই বিশ্বের কাছে সমাদৃত হয়েছে।
তবে এটাই একমাত্র গল্প নয়! হট ডগের নামকরণের আরও কিছু গল্প প্রচলিত রয়েছে। ১৮ শতকের শুরুর দিকে জার্মান অভিবাসীরা আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। যাপনের তাগিদে এবং জীবিকার কারণেই তাদেরকে সসেজ বিক্রি করতে হতো। এই বিক্রেতাদের সঙ্গে সব সময় কিছু পালিত কুকুর দেখা যেত, যেগুলোর স্বাস্থ্য বেশ রুগ্্ণ। বিক্রি হওয়া সসেজের সঙ্গে কুকুরগুলো সাদৃশ্য থাকার কারণে এ খাবারের এমন নামকরণ হয়েছে বলেও একধরনের গল্প শোনা যায়।
বিশ্বের দীর্ঘতম হট ডগের দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ মিটার। এর বান ছিল ৬০ দশমিক ৩ মিটার। ওই হট ডগ অল-জাপান রুটি সমিতির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের ৪ আগস্ট জাপানের টোকিওর আকাসাকা প্রিন্স হোটেলে এই অ্যাসোসিয়েশনের পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদযাপনের সময় ওই হট ডগ এবং বানটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
একসময় জার্মানি ও আমেরিকার রাস্তার পাশে বিক্রি হতো হট ডগ। এখন এমনই জনপ্রিয় যে প্রতিবছর জুলাইয়ের তৃতীয় বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় হট ডগ দিবস উদ্যাপন করে। দিনটি ছুটির দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অনানুষ্ঠানিক ইভেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে পালিত হয়। দিনটি ঘিরে বিভিন্ন স্বাদের হট ডগ খাওয়া ছাড়াও আরও কিছু ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। সেই সব ইভেন্ট থেকে আয় হওয়া অর্থ দেওয়া হয় বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে।
তবে এই খাবার অতিরিক্ত গ্রহণেও রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমনটাই বলছে গবেষণা। বলা হচ্ছে, হট ডগ, শর্করা জাতীয় পানীয়, বার্গার ও স্যান্ডউইচের মতো খাবার খেলে জীবন থেকে বেশ কিছুটা আয়ু কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। হট ডগ বা স্যান্ডউইচের মতো খাবারে ৬১ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত মাংস থাকে, যা একজন মানুষের জীবন থেকে ৩৬ মিনিটের মতো আয়ু কমিয়ে দিতে পারে। হট ডগে থাকা পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ফাইবারের উপকারিতা থাকলেও এটি জীবন থেকে বেশ অনেকটা সময় কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে হট ডগপ্রেমীদের প্রতি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, এই খাবার অতিরিক্ত না খাওয়াই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
ছবি: ইন্টারনেট