রসনাবিলাস I মৃদুমন্দ হাওয়ার সঙ্গে খাওয়া
চোখের সামনে মন্ত্রমুগ্ধকর সিটিস্কেপ। টেবিলে সুস্বাদু খাবার। রাজধানীর বুকে নতুন এক রেস্তোরাঁ পরখ করে এসে লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
বনানী এলাকা যেন আকাশ ছোঁয়ার খেলায় নেমেছে। আর সেই খেলায় কেন পিছিয়ে থাকবে খাবারের রেস্তোরাঁগুলো। একগাদা রুফটপ রেস্টুরেন্ট এখন বনানীর আকাশজুড়ে। এর মধ্যে নতুন সংযোজন জিফাহ। সিটিস্কেপে চোখ বুলিয়ে কফির কাপে চুমুক বা ঝাল-ঝাল স্কুইড লেমন-বাটার সসে ডুবিয়ে খাওয়ার নাকি এটাই সেরা জায়গা এখন। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনে এবারে আমাদের গন্তব্য জিফাহ।
লিফট থেকে বেরিয়ে হাতের ডানে তিন-চার কদম ফেলতেই এক তরুণী দরজা খুলে দিলেন। শুরুতেই চোখে আসে কাউন্টার কাম কফি বার। অপারেশন ম্যানেজার টি এস আল মামুন স্বাগত জানালেন হাসিমুখে। খানিকক্ষণ ছোটখাটো কনফারেন্স রুমে বসে জানিয়ে দিলেন এই রেস্টুরেন্টের ইতিহাস। আমিও যথারীতি আমেরিকানোর কাপে চুমুক দিয়ে নোট করে নিলাম, এ বছরের ২ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করেছে প্রায় ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের এই রেস্টুরেন্ট কাম লাউঞ্জ। কালো নেকড ফলস সিলিং, আর সেখানে বাতির ব্যবহার দারুণ। কিছু জায়গায় বাঁকানো শিট ব্যবহার করে খানিকটা হ্যাঙ্গারের মতো আকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে কাঠ প্যাটার্নের টাইলসের সঙ্গে সাদা টাইলসের বৈপরীত্য, দেয়ালে কাঠের আর গ্রিলের কাজ, অবারিত সূর্যের আলো ঢোকার ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে দারুণ ইন্টেরিয়র। বসার টেবিল আর চেয়ারেও বৈপরীত্য বজায় রাখা হয়েছে, এক প্রান্তে এলইডি স্ক্রিন। তবে এই ইন্টেরিয়রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো এখানে অসংখ্য গাছের ব্যবহার।
কফি কাপ হাতে বারান্দায় যেতেই শেফের সঙ্গে আলাপ হলো। জাহাঙ্গীর সাহেবের ঝুলিতে আছে নানা রেস্টুরেন্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা। বিকেলের সিটিস্কেপ দেখতে দেখতে কথা হলো খাবার নিয়ে। শীতের বিকেলে এখানে খানিকটা সময় কাটাতে, কফির কাপে চুমুক দিতে আসা যেতেই পারে।
শেফকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল তার মতো করে খাবার দেওয়ার, তাই তিনি নিয়মিত খাবার পরিবেশন করার বদলে আপকামিং মেনুর কিছু পদ সাধলেন। তথাস্তু বলে আবারও মন দিলাম ঢাকার দিগন্তরেখায় অস্তমিত সূর্য দেখতে। এর মধ্যেই এসে হাজির হলো পেস্তো চিকেন ফোকাসিয়া। গ্রিক ও আট্রাস্কান সংস্কৃতির এই বিনা খামিরের ফোকাসিয়া ব্রেড অবশ্য এখানে ট্র্যাডিশনালভাবে দেওয়া হয় না; বরং এটা এসেছে স্যান্ডইউচ রূপে, মাঝখানে পেস্তো চিকেনের ফিলিং দিয়ে। পেস্তো চিকেনের স্বাদ খারাপ হওয়ার সুযোগই নেই; কারণ, পেস্তো তৈরিতেই চিজ, অলিভ অয়েল, পাইন নাট আর ব্যাসিল পাতার ব্যবহার হয়। সঙ্গে চিকেন যোগ হলে তো কথাই নেই।
এরপর আসরে এলো নরওয়ের স্যামন। হালকা গোলাপি রঙে সেজে। স্যামন সাধারণত গোলাপি রঙের হলেও মাথায় রাখা প্রয়োজন, চকচক করলেই সোনা হয় না। খোলা সমুদ্রে ধরা স্যামনের রং গোলাপি হলেও চাষ করা স্যামনের রং ফ্যাকাশে। খোলা সমুদ্রে স্যামন চিংড়িজাতীয় প্রাণী খেয়ে গোলাপি রং ধারণ করে; কিন্তু চাষের স্যামনে সেই রং আনতে কিছু অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন মাছচাষিরা। তাই স্যামন খাওয়ার সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়। ক্যাপার্সি লেমন বাটার সস ভয়াবহ রকমের ভালো। ম্যাশ পটেটোও ভালো; কারণ, আলু যে রূপেই আসুক না কেন, তাকে বরণ করে নেওয়াই আমাদের রীতি। সঁতে করা ভেজিটেবলও ভালো সঙ্গ দেয় স্যামনের। তবে সঙ্গে থাকা ক্রিমি স্পিনাচের কথা না বললে পাপ হবে! সব মিলিয়ে স্যামনের প্লেটার দারুণ একটা আইটেম; বিশেষ করে ক্যাপার্সি সসে মাখিয়ে স্যামনের টুকরো মুখে পড়তেই চোখ আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে আসতে বাধ্য। সেটা সসের গুণে, না মাছের গুণে সে বিতর্ক থাক; তবে এই দুটোকে এক থালায় আনা শেফকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। যদিও স্যামন নিয়ে আমি খুঁতখুঁতে, তারপরও মুখে ভালো লেগে গেলে তা বলতে দোষ কি!
সিগনেচার ওপেন হাউস পানিনো এলো এরপরে। সাধারণত পানিনো (এর বহুবচন পানিনি) স্যান্ডউইচ আসে দু টুকরো রুটির মাঝখানে ফিলিং বা পুর ভরে। নাম যেহেতু ওপেন, তাই ফিলিং এখানে রুটির ওপর টপিং হিসেবেই আসে। মুখে দিতে দিতে কলকাতার চকোলেট রুম রেস্টুরেন্টের কথা মনে পড়ল। প্রায় একই স্বাদ। খেতে দারুণ, বিশেষত যারা চিজের আধিক্যে ডুবে যেতে চান। তবে এখানকার পানিনোর ক্যাপসিকাম আর অন্য সবজিগুলো খানিকটা আন্ডারকুক; ফলে ব্রেড, চিজ আর নানা ধরনের হার্বসের সঙ্গে খানিকটা ক্রাঞ্চিনেস যোগ করে, যেটা আমার কাছে মন্দ লাগেনি।
সবশেষে এলো ঝাঁজরিতে করে রান্না করা নারকেলি, কোরাল, চিংড়ি, আলু; সঙ্গে সঁতে করা সবজি, আর লেমন-বাটার সস—অর্থাৎ সিফুড মিক্সড গ্রিল প্ল্যাটার। স্কুইডকে নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপের লোকেরা নারকেলি বলেই চেনে। প্রন খেতে বেশ, ব্যাটার দিয়ে গ্রিল করা। কোরাল মাছ ব্যাপারটাই স্বর্গীয়! সেটা নিয়ে বাক্যব্যয় অনর্থক। প্রন আর কোরাল লেমন-বাটার সসে মাখিয়ে খেতে দারুণ। এই প্ল্যাটারে যদি সত্যিকারের স্টার থাকে, সেটা স্কুইড। প্রচুর ঝাল, কিন্তু সেটাকে বশ করতে একটু গ্রিল করা আলু আর লেমন-বাটার সস দিয়ে যদি স্কুইডকে মুখে পোরা যায়—মুখের ভেতরে স্বাদের বিস্ফোরণ ঘটে। এই প্ল্যাটার খাওয়ার ব্যাপারে দ্বিতীয়বার চিন্তার সুযোগ নেই।
ওহ্, বলতে ভুলেই গেছি, এই রেস্টুরেন্টে বোতলের কোমল পানীয় নেই; রয়েছে চমৎকার সব ঠাণ্ডা আর গরম পানীয়। সেখান থেকেই এলো সানরাইজ আর ব্লু হাওয়াই মকটেল। সানরাইজ হলো পিচ আর অরেঞ্জ জুসের সঙ্গে গ্রেনাডাইন বা বেদানার রসের মিশ্রণ। গ্লাসে নিচে লাল, তারপর গাঢ় কমলা থেকে ধীরে ধীরে হলুদাভ কমলা হয়ে ওঠায় এর এই নাম। চমৎকার রিফ্রেশিং। লেবু আর নারকেলের চমৎকার আরেকটি মকটেল ব্লু হাওয়াই। দুটোই দারুণ।
এই রেস্টুরেন্টের সমস্ত কারবার মূলত কন্টিনেন্টাল খাবার নিয়েই। মেনুও সাজানো হয়েছে সেভাবে—অ্যাপেটাইজার, ফ্রাইস, স্যুপ, স্যালাড, স্যান্ডউইচ, বার্গার, ব্রেড, ইতালিয়ান পিৎজা, পাস্তা, স্প্যাগেটি, স্টেক, প্ল্যাটার, রাইস, ডেজার্ট চিলার, মকটেল, চা, কফি, ফ্র্যাপে, স্মুদি, হেডিংয়ে।
আবারও আমেরিকানোর কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা হলো এই রেস্টুরেন্টের দুজন কর্ণধারের সঙ্গেই। কাজী মোতায়াজ্জেদ বিল্লাহ বলেন, ‘আমাদের এখানে আরও লোক বসানোর ব্যবস্থা চাইলেই করা যেত, কিন্তু সেটা চাইনি। আমরা এটাকে ফাইন ডাইনের আদলে সাজাতে চেয়েছি শৈল্পিকভাবে। আমাদের এটাকে বাজার বানানোর পরিকল্পনা নেই। আমরা চাই মানুষ এখানে এসে নিরিবিলি খানিকটা সময় কাটাক, খাবার উপভোগ করুক সময় নিয়ে।’ আরেক কর্ণধার আমির আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা খাবারের ব্যাপারে কোনো রাখঢাক করি না। এখানে বাইরে থেকে আমদানি করা বিএসটিআই অনুমোদিত উপকরণই কেবল ব্যবহার করা হয়। এমনকি বোতলের পানীয় রাখিনি; কারণ, আমরা স্বাস্থ্যকর খাবার প্রমোট করি।’
খাবার, পরিবেশ আর আতিথেয়তা—সব মিলিয়ে জিফাহ বেশ সফিস্টিকেটেড। একই সঙ্গে নস্টালজিকও, সেই শূন্য দশকের লাউঞ্জ কালচারকে আরও একবার পরিশীলিতভাবে তুলে ধরছে, ঢাকা শহরের চমৎকার বিষণ্ন সিটিস্কেপ দেখিয়ে।
ঠিকানা: রুফটপ, ক্যাথারসিস টাওয়ার, বাড়ি ১৩৩, রোড ১২, ব্লক ই, বনানী, ঢাকা। মোবাইল: ০১৩২১১৯৭৩৩৭।
ফেসবুক: https://www.facebook.com/zephyr.restaurant.lounge|