বিশেষ ফিচার I চক্র-চক্কর
রাশি নিয়ে ভাবনা, আর না আর না…। কেউ বলে ব্যঙ্গ করে, আবার কেউ সিরিয়াসলি। তবু সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, রাশিচক্রের প্রতি কৌতূহল থেকেই যায়
রাশিফলের ইতিহাস সুপ্রাচীন। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে ধর্ম, বিশ^াস, বিজ্ঞান, জীবনাচার…কত কী! মানুন কিংবা না মানুন, রাশিফলে ঢুঁ মারা অনেকেরই নিত্যকার অভ্যাস। আর রাশি ঘিরে রয়েছে বিবিধ সংস্কার। রয়েছে বিবিধ ঘটনা ও দুর্ঘটনা। জানা যাক কিছু।
আপনি কোন রাশির- এই প্রশ্নের বদলে জাপানে রক্তের গ্রুপের দিকেই থাকে কৌতূহল। রক্তের গ্রুপের ভিত্তিতে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব পরখের বিশ্বাস রয়েছে দেশটিতে। একে বলে ‘কেতসুয়েকি-গাতা’ বা ব্লাড টাইপ পার্সোনালিটি। এর সূচনা ১৯৩০ সালে, তোকেজি ফুরুকাওয়া নামের এক অধ্যাপকের চিন্তা থেকে। রক্তের গ্রুপ ও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি পারম্পর্যের ভিত্তিতে এটি নিরূপণের প্রস্তাব রেখেছিলেন তিনি। সেই সূত্রে বলা হয়, ‘এ’ ব্লাড গ্রুপের মানুষ বেশ সৃজনশীল ও একরোখা; অন্যদিকে ‘ও’ গ্রুপের মানুষ আত্মবিশ্বাসী ও আত্মকেন্দ্রিক।
রাশির চক্করে চাকরির বিড়ম্বনা? এমনটাও ঘটে! ২০১১ সালে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি চায়নিজ ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং কোম্পানি দিয়েছিল অদ্ভুত শর্ত। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছিল, কন্যা ও বৃশ্চিক রাশির কারও আবেদন করার দরকার নেই! যদিও এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। তবু নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওই দুটি রাশির জাতক-জাতিকার মধ্যে নাকি ‘দুষ্ট স্বভাবী ও কুটিল’ হওয়ার প্রবণতা বেশি; তাই এমন কাউকে তিনি নিয়োগ দিতে নারাজ!
২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আমেরিকান টেলিভিশন চ্যানেল কার্টুন নেটওয়ার্ক শিশুকালেই পরিচিতি পাওয়া ১০০ তারকার ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, প্রতি পাঁচজন শিশুতারকার মধ্যে একজনের রাশি ধনু। এ তালিকায় রয়েছে ব্রিটনি স্পিয়ার্স, স্কারলেট জোহানসন, ডনি অসমন্ডের নামও।
ব্যস্ত জীবনে গাড়ির স্টিয়ারিং যখন সিংহ রাশির কারও হাতে, তাতে যাত্রী হওয়ার আগে সাবধান! ২০১৭ সালের একটি জরিপ অন্তত এই ভয়ই দেখায়। এক লাখ চালকের ওপর জরিপটি চালিয়েছিল আস্ট্রেলিয়ান কার শেয়ার সার্ভিস গো গেট। তাতে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সিংহের মধ্যে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের হার অনেক বেশি। অন্যদিকে, মেষ রাশির চালকেরা সবচেয়ে সচেতন; তাদের মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটানো কিংবা ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের হার সবচেয়ে কম। অবশ্য, দুর্ঘটনা কি আর রাশি মেনে ঘটে!
সম্পর্কের পিঠে ছুরি চালাতে মকর রাশির জাতক-জাতিকারা ওস্তাদ! এমনই দাবি কানাডিয়ান অনলাইন ডেটিং সার্ভিস অ্যাশলি ম্যাডিসনের। এ রাশির নর-নারীরাই নাকি বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ায়, বলা হয়েছে এমনটাও। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থান কুম্ভের।
রাশিভাগ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চান? ইতিহাস বলে, বৃশ্চিক ও কুম্ভের সম্ভাবনা বেশি। কেননা, বর্তমান জো বাইডেনসহ এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পাঁচজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বৃশ্চিক রাশির জাতক। এর চেয়ে একজন কম কুম্ভের। অন্যদিকে হোয়াইট হাউসে বসে দুনিয়ার ওপর ছড়ি ঘোরানোর সৌভাগ্য সবচেয়ে কম মেষ ও কন্যার জাতকদের। এ পর্যন্ত মাত্র দুজন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এই দুই রাশি থেকে।
এ সময়ে মানুষ, বিশেষত তরুণ-তরুণীরা বেশ স্বাস্থ্যসচেতন। জিমে নিয়মিত হাজিরা দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন অনেকেই। এ তালিকায় নারীদের মধ্যে সবার আগে সিংহ জাতিকারা। ব্রিটিশ ম্যাগাজিন হ্যালো!-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে জিমে যাওয়া যুক্তরাজ্যের ১০ হাজার নারীর ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে, অন্য যেকোনো রাশির চেয়ে এ রাশির জাতিকার সংখ্যা দ্বিগুণ।
এদিকে কোটিপতি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে তুলা রাশির লোকজন। আমেরিকান বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের সাম্প্রতিক বিলিয়নিয়ার লিস্টে নজর রেখে দেখা গেছে, ২৭ জনই তুলা! বলা হয়ে থাকে, ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে নিখুঁতচারী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে এ রাশির জাতক-জাতিকাদের। তাই তাদের মধ্যেই বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেশি, তাতে অবশ্য অবাক হননি অনেকে।
রাশিচক্র যে শুধু ভালো বার্তা দেয়, তা তো নয়। ভয়ংকর কিছুও বলে। সিরিয়াল কিলিং নিয়ে আমেরিকার বদনামের শেষ নেই। দেশটির সবচেয়ে নৃশংস সিরিয়াল কিলারদের একটি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবার ওপরে রয়েছে মীন ও মিথুন- এই দুই রাশির নরপিশাচদের নাম। মীন রাশির জাতক-জাতিকাদের এমনিতেই একাকিত্বে ভোগার বদনাম রয়েছে। অন্যদিকে মিথুন রাশির জাতক-জাতিকারা বশীভূত করার গুণে গুণান্বিত বেশ। সিরিয়াল মার্ডারগুলোর ক্ষেত্রে এ দুটি একেবারেই কমন বৈশিষ্ট্য। অবশ্য তাই বলে নিশ্চয় অপরাধের দায় রাশির কাঁধে চাপাবেন না কেউ!
২০০৮ সালে ক্যারিয়ার বিল্ডার ওয়েবসাইট এক জরিপের মাধ্যমে জানিয়েছে, কর্মক্ষেত্রে বেতনের দিক থেকে বৃশ্চিক, সিংহ, কর্কট ও বৃষ রাশির লোকেরা বেশ ভাগ্যবান। অন্যদিকে, সবচেয়ে দুর্ভাগা কুম্ভ ও মকর রাশির জাতক-জাতিকারা।
জ্যোতিষীদের বিশ্বাস, বৃষ রাশির মানুষ সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর, সেটি শারীরিক স্পর্শের প্রসঙ্গে! তাই বৃশ সামলাতে বাড়তি সতর্ক থাকা একান্তই প্রয়োজন!
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ বা গড়িমসি করার বদনাম মিথুনের ললাটে বেশি থাকলেও তুলা, মীন ও ধনু রাশির জাতক-জাতিকারাও কম যান না! এমনকি রেস্তোরাঁয় বসে কোন খাবার অর্ডার দেবেন, তা ভাবতে ভাবতেও নাকি বেশ খানিকটা সময় গায়েব করে দেন এই চার রাশির নারী-পুরুষেরা!
বৃষের বদনাম গোলমাল বাধানোতে! আমেরিকান সুপারমার্কেট ম্যাগাজিন ওম্যান’স ওয়ার্ল্ড জানিয়েছে, এ পর্যন্ত রাস্তাঘাটে নানা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষতিপূরণের মুখে বেশি পড়েছেন এ রাশির লোক।
এবার অন্য ধরনের কিছু তথ্যে নজর দেওয়া যাক:
ব্যাবিলনীয় রাশিফলের ওপর জার্নাল অব কিউনিফর্ম স্টাডিজে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে জানা গেছে, এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরোনো রাশিফলটির তারিখ ২৯ এপ্রিল ৪১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিউনিফর্মে লেখা ছিল সেটি।
১৯৩৯ সালের কথা। চলছে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ। এর নেপথ্য কারিগর, পরাক্রমশালী নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সুইস জ্যোতিষী কার্ল এর্নস্ট ক্রাফট। নক্ষত্র গবেষণার মাধ্যমে নভেম্বরের তিনটি তারিখ উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় তারিখটিতে, ৮ নভেম্বর মিউনিখ বিয়ার হলে সত্যি সত্যি এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ ঘটে, ঠিক যেখানে মিনিট কয়েক আগেই বক্তব্য দিয়েছিলেন হিটলার। সময়ের হেরফেরে নাৎসিপ্রধান বেঁচে গেলেও প্রাণ যায় আটজনের; ঘটে ব্যাপক ক্ষতি। পরে ক্রাফটের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় সেই জ্যোতিষীকে।
আমরা জানি, রাশি ১২টি। অতীতে, ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে ছিল ১৩টি। তিন হাজার বছর আগে জোডিয়াক ক্যালেন্ডার থেকে ওফিউকাস রাশিটি বাদ দেওয়া হয় বলে দাবি নাসার।
রাশি নিয়ে আছে আরও চক্কর। তবে শেষ করার আগে প্রতিটি রাশির বিভিন্ন চমকজাগানিয়া বিশেষত্ব জেনে নেওয়া যাক একঝলক, টাইমস অব ইন্ডিয়ার সৌজন্যে। জীবনের দায়ভার ও দায়িত্ববোধ থেকে পালাতে পছন্দ করে মকর। অন্তর্মুখী হিসেবে বদনাম থাকলেও ঘনিষ্ঠ সার্কেলে অসংখ্য বন্ধু থাকে কুম্ভের। আদতে প্রাণোচ্ছল হলেও প্রয়োজনে খুবই রূঢ় ও কুচক্রী হয়ে উঠতে পারে মীন। সত্যিকারের সম্পর্কে জড়ানোর বদলে বরং কাউকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার পেছনেই বেশি দৌড়ঝাঁপ মেষের। বিলাসবহুল জীবনযাপন পছন্দ করলেও বৃষ বেশ বিনয়ী। যদিও দ্বৈত সত্তার টানাপোড়েন আছে ব্যক্তিত্বে, মিথুন তবু বেশ খাঁটি ও দারুণ। ক্ষণে ক্ষণে রূঢ় ও বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে কর্কট। লোকে হুল্লোড়বাজ বললেও সিংহ আদতে বেশ সমব্যথী। প্রয়োজনে খুবই পীড়াদায়ক, নিষ্ঠুর ও যাচ্ছেতাই হয়ে ওঠা সম্ভব কন্যার পক্ষে। জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া তুলার পক্ষে বেশ মুশকিল; কেননা কাউকে নাখোশ করতে তাদের মন সায় দেয় না। বৃশ্চিককে যতই শক্ত মনোবলের মনে হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে ভীষণ সংবেদনশীল এবং সত্যিকারের ভালোবাসার কাঙাল। ধনু আসলে নিরাময়ের অবতার; কেননা, অন্যরা তাদের কাছে সঠিক পরামর্শের জন্য ধরনা দেয়।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট