মনোজাল I নখ কাটার নেপথ্যে
চোখের মতোই দর্পণতুল্য শরীর-স্বাস্থ্যের আয়না। কিন্তু দাঁত দিয়ে নখ কাটা হেলদ হ্যাজার্ড। সৌন্দর্যের বারোটা বাজানোর জন্যও যথেষ্ট। বেমালুম ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো?
মানুষ অভ্যাসের দাস। বাক্যটি বহু পুরোনো, তবে তার সারকথা আজও সত্যি, নতুনের মতোই চকচকে। যেকোনো অভ্যাস সেটি ভালো-খারাপ যা-ই হোক না কেন, গড়ে উঠতে সময় লাগে। মানুষ তার মস্তিষ্কের ভেতর ধীরে ধীরে তাকে লালন করে, একসময় সেটি ডালপালা ছাড়িয়ে বেড়ে ওঠে, তারপর পরিণত হয়ে মহীরুহে। ইচ্ছে করলেই তাকে ছাড়া যায় না। যেমন ধরা যাক নখ কামড়ানো। আমাদের আশপাশে অনেকেই আছেন, যারা কথা বলার সময়, কোনো কিছু চিন্তা করার সময়, টিভি দেখার সময় কিংবা এমনি এমনি নখ কামড়াতে থাকেন। এ কাজ তারা কেন করেন? মানুষ আসলে নখ কামড়ায় কেন? প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার আগে বলে নেওয়া ভালো, এটিকে কেবল বাজে অভ্যাস বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। আদতে এটি একটি রোগ। যার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অনিকোফ্যাগিয়া (onychophagia)। এই অভ্যাস কেউ কেউ শখেও গড়ে তুলতে পারেন। কথিত আছে, যারা নখ কামড়ান, তাদেরকে নাকি বুদ্ধিমানদের কাতারে ফেলা হয়! তাই নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করার জন্যও কেউ কেউ নখ কামড়ানো শুরু করতে পারেন। আচরণটি শারীরিক হলেও পেছনের কারণ কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক।
আবার বয়ঃসন্ধিকালীন অনেক মেয়েকেই দেখা যায় আচার-আচরণে কিউটনেস, লজ্জাভাব প্রকাশের জন্যও কথা বলার সময় একটু একটু করে নখ কামড়াতে থাকেন। তাতে নিজের অজান্তেই তিনি কতটা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, ব্যাপারটি ধরে ফেলার আগেই হয়তো সেটি তার অভ্যাসে পরিণত হতে শুরু করে। ২০-৩০ শতাংশ মানুষের মধ্যে চেতন বা অবচেতনভাবে এ অভ্যাস আছে বলে ধারণা করা হয়। বইয়ের ভাষায় বলতে গেলে, নখ কামড়ানো বা অনিকোফ্যাগিয়া হলো একধরনের বডি ফোকাসড রিপিটিটিভ ডিসঅর্ডার। এ ধরনের রোগগুলো সাধারণত অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত থাকে। ফলে একবার হয়ে গেলে ত্যাগ করা খুবই কঠিন। ডাক্তারদের পরিভাষায় এর কারণ হলো, যিনি অভ্যাসটি রপ্ত করেন, তিনি আসলে এটিকে ছাড়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন না। অর্থাৎ তিনি তার শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর এর পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকলেও অবচেতনভাবে স্থির থাকেন বা তার সরে আসার ক্ষমতা থাকে না।
আসলে কেন এ ধরনের অভ্যাসের শিকার হন তারা? খারাপ খবর হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা এর নির্দিষ্ট কারণ এখনো বের করতে পারেননি। তবে, সম্ভাব্য কারণ হিসেবে অনেকগুলোকে উল্লেখ করেছেন। যেমন, হতাশা। যারা সাধারণত নিজের সম্পর্কে হতাশ, উদাসীন এবং সহজেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন, তারা সহজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার উপায় হিসেবে নখ কামড়াতে শুরু করেন। আবার যারা কাজে সহজে মনঃসংযোগ করতে পারেন না, তাদেরও এ অভ্যাস থাকতে পারে। বিশেষ করে, অমনোযোগী হয়ে যখন কেউ কোনো কাজ করতে যান, তারা মনঃসংযোগের অভাবে নিজের অজান্তেই নখ কামড়ান। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নখ কামড়ানো স্নায়বিক দুর্বলাবস্থা ও উদ্বেগ থেকে সাময়িক মুক্তি দেয়, তাই এমন অবস্থায় নখ কামড়াতে ভালো লাগে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগজনিত অসুস্থতার মতোই এটিকে মানসিক অসুস্থতার প্রকাশ হিসেবে ধরা হয়।
কাজটি করার পেছনে যে নির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকতেই হবে, ব্যাপারটি এমনও নয়। এমনি এমনি কামড়াতে শুরু করলেও একসময় সেটি ভয়ংকর অসুস্থতার দিকে মোড় নেয়। কারণ যা-ই হোক, নখ কামড়ানোর ফলে নখের চারপাশের টিস্যু ও ত্বক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নখের চারপাশে ব্যথা হয় এবং নখগুলো একসময় অস্বাভাবিক দেখাতে শুরু করে। সবচেয়ে বড় কথা, আঙুল থেকে মুখে ব্যাকটেরিয়া যাওয়ার কারণে ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজটি করে আসছেন, তাদের হাতের সৌন্দর্য বলে কিছু থাকে না।
সৌন্দর্যবিশ্বে যেখানে নখের সৌন্দর্যচর্চা দারুণভাবে জনপ্রিয়, প্রতিনিয়ত আবিষ্কৃত হচ্ছে নেইল আর্ট, ম্যানিকিউরের নতুন নতুন পদ্ধতি সেখানে নেইলবিটারদের (যারা নখ কামড়ান) ভিলেনের মতোই গণ্য করা হয়। অনেক সেলিব্রিটির মধ্যেও এই অভ্যাস দেখা যায়। যারা ছাড়তে চান কিন্তু পারেন না। পারার জন্য যে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন, সেটি তাদের থাকে না। কারণ, কাজটি খুব একটা জটিল কিছু নয়। অভ্যাসটি ছাড়ার জন্য প্রথমেই বলা হয় নখের যত্ন নেওয়ার কথা। ঘন ঘন নখ ছাঁটা বা কাটা। বড় নখ রাখা যাবে না কিছুতেই। ম্যানিকিউর করতে হবে নিয়মিত। নানাভাবে নেইল আর্ট করে নখের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে। যাতে অর্থ ব্যয় হয়। বলা হয়, টাকা খরচ করে যে নখকে আপনি সুন্দর করে তুলেছেন, তার ক্ষতি করতে অবচেতন মন আপনাতেই বাধা দেবে, নখ কামড়ে নষ্ট করতে ইচ্ছে করবে না। ওই যে বললাম, ব্যাপারটা অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। আবার, কোনো কোনো চিকিৎসক হাতে গ্লাভস পরার পরামর্শ দেন। তবে এর কোনোটিই স্থায়ী সমাধান নয়। ব্যাপারটা যেহেতু মানসিক, তাই মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনাটাই সবচেয়ে জরুরি। এই অভ্যাস খারাপ, আমার জন্য ক্ষতিকর এবং আমাকে যেভাবেই হোক ছাড়তে হবে, ব্যাপারটি মাথায় আনতে হবে প্রথমেই। হাত মুখে যাওয়ার আগেই মন যেন অটো সাজেশন দেয়। সবার ক্ষেত্রে পদ্ধতি এক রকমভাবে না-ও কাজ করতে পারে, তাই নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে, কী করলে এটি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারবেন। পশ্চিমা বিশ্বে অনেকে এই অভ্যাস ছাড়তে পেরেছেন হাতে একটি চুইংগাম রেখে। নখ মুখের কাছে যাওয়া মাত্রই চুইংগাম পুরে দিলে মুখ ব্যস্ত হয়ে পড়ে বলে অভ্যাসটি ধীরে ধীরে ছাড়া সম্ভব হয়েছে অনেকের পক্ষে। কিংবা এ অভ্যাসের পরিবর্তে আপনি নিজের জন্য নতুন কোনো প্র্যাকটিস শুরু করতে পারেন। যাতে টেনশন হলে বা গভীরভাবে কোনো কিছু চিন্তা করার সময় ক্ষতিকর নখ কামড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রাখা সহজ হয়। তবে মনে রাখা চাই, যেকোনো অভ্যাস গড়া বা ছাড়া এক-দুই দিনে সম্ভব নয়। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে মাথায় সেটি লালন করতে হবে, আস্তে আস্তে সেটি ডালপালা ছড়াবে, তারপর একদিন দেখা যাবে, টেনশনেও হাতের নখ আর মুখে যাচ্ছে না।
বাহ্যিক সৌন্দর্যচর্চায় হাতের সৌন্দর্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাত ও নখের শেপ ব্যক্তিত্ব প্রকাশেও ভূমিকা রাখে, তাই নখের যত্ন নেওয়া খুব জরুরি।
রায়া ফাতিমা
ছবি: সংগ্রহ