skip to Main Content

ট্রিবিউট I বাণিজ্যলক্ষ্মী

৫ এপ্রিল ২০২৩। সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকিয়া আফজাল রহমান। ১৯৪১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণকারী এই ব্যক্তিত্ব চার দশকে বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতেও রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। তার মৃত্যুতে ক্যানভাস পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। ক্যানভাসের ২০১২ সালের এপ্রিল সংখ্যার ‘ব্যক্তিত্ব’ বিভাগে তাকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বিশেষ ফিচার। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো

 

পেঁয়াজরঙা অ্যান্ডি সিল্ক আর হালকা গয়নায় রোকিয়া আফজালকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল। পায়ে নাগরাজাতীয় চপ্পল আর হাতে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করেই বললেন, ‘সরি, একটু দেরি করে ফেললাম!’ যদিও দেরি হয়নি মোটেই। ড্রয়িংরুমের আধুনিক ইন্টেরিয়র আর বারান্দায় থাকা গাছপালা দেখতে-দেখতেই কেটে যাচ্ছিল সময়। পুরো নাম রোকিয়া আফজাল রহমান। একজন নারীর যে কত গুণ থাকতে পারে, তার উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি। জন্ম কলকাতায়। পড়াশোনা প্রথমে কলকাতার লরেটো হাউসে, তারপর করাচির সেন্ট যোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজে। জানালেন, ছেলেবেলা কেটেছে করাচিতে, এক্কেবারে ছেলেদের মতো করে। ভাইদের সঙ্গে গাছে চড়ে, সাইকেল, গাড়ি চালিয়ে। বাবা খোন্দকার আলী আফজাল সব সময় প্রেরণা হয়ে ছিলেন—খেলাধুলা, পড়াশোনা প্রতিটি ব্যাপারে। কলেজে পড়তে-পড়তেই চমৎকার একটি সুযোগ আসে। ইস্টার্ন কমার্শিয়াল ব্যাংকে চাকরির অফার। সেই ১৯৬২ সালের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েরা ব্যাংকে কাজ করবে, ভাবাই যেত না। পরিবার থেকেও রাজি হচ্ছিলেন না কেউ। নিজের উৎসাহ আর বাবার দেওয়া অভয়—কেবল এ দুই-ই ছিল সঙ্গে। রোকিয়ার কর্মজীবন শুরু হলো ব্যাংকে।
সেখানে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, রোল মডেল হিসেবে কেউ নেই, কাজ করতেও ছিল শত বাধা-বিপত্তি। সেই সব ডিঙিয়ে মাত্র দুই বছরের মধ্যে, ১৯৬৪ সালে আমাদের দেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম নারী ব্যাংক ম্যানেজার হয়ে রীতিমতো চমক সৃষ্টি করেন তিনি। চাকরির কিছুদিনের মধ্যেই তাকে করাচি থেকে ঢাকায় বদলি করা হয়। এখানে এসে কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে তিনি শুরু করেন দেশের প্রথম মহিলা ব্যাংক শাখা। মহিলাদের পরিচালিত এই ব্যাংকের গ্রাহকও ছিলেন কেবল নারীরা। রোকিয়া আফজাল বললেন, ‘চালু হবার কিছুদিনের মধ্যে বোঝা গেল, মহিলারা টাকা জমানোর ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহী। তারা যে হারে টাকা জমান, সে হারে তোলেন না। ফলে ডিপোজিটের পরিমাণও দিন দিন বাড়তে থাকে।’ এ দেশের মেয়েদের ব্যাংকিং পেশায় আসার ব্যাপারেও তার একটি প্রবল ভূমিকা রয়েছে। কারণ, তখন প্রচলিত একটি ধারণা ছিল, হিসাব-নিকাশের কাজ মেয়েরা তত ভালো বোঝে না। ‘আমি মেয়েদের কেবল বোঝাতাম, একটা ছেলে পারলে তুমি পারবে না কেন। আমার মনেও দৃঢ়প্রত্যয় ছিল যে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।’ ওই বছরই বিয়ে করেন তিনি। স্বামী আজিমুর রহমানও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন তার ক্যারিয়ার তৈরির ব্যাপারে। একসময় সংসার এবং সন্তানকে সময় দেওয়ার জন্যই ব্যাংকের নিয়মিত চাকরি ছাড়তে হয় তাকে। কারণ, তিনি মনে করেন, একজন নারী হিসেবে ক্যারিয়ারের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ হলো তার সংসার। ঠিক করলেন, সন্তানেরা একটু বড় হয়ে গেলে ব্যবসা করবেন। সেখানেও চ্যালেঞ্জ। বেছে নিলেন এমন এক ব্যবসা, তারা আগে কখনো যা করেননি। বিভিন্ন ঝুঁকি থাকে বলেই মেয়েরা এই ব্যবসায় ভালো করতে পারে না—এমন একটা ধারণা তখন ছিল, এখনো তাতে পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী ব্যবসায়ী; যিনি এই ব্যবসায় খুব ভালোভাবে টিকে আছেন। ব্যবসাটি কোল্ডস্টোরেজের।

১৯৮০ সালে কৃষিভিত্তিক এই শিল্পে তিনি বিনিয়োগ করেন। আর আর নামে একটি কোল্ডস্টোরেজ কেনা দিয়ে শুরু। তারপর কিনেছেন আরও একটা। এতে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে পনেরো হাজারের বেশি ক্ষুদ্র কৃষক। ব্যবসার সব কাজ তিনি নিজেই করেছেন। ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে একাই ছুটে গেছেন মুন্সিগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায়। পরিশ্রমের ফলও মিলেছে, ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে তার ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে নানা দিকে। তাকে বর্তমানে বাংলাদেশের সেরা ব্যবসায়ীদের একজন বলা যায়। ইনস্যুরেন্স, মিডিয়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট, পাওয়ার সেক্টর—সব জায়গায় তিনি তীক্ষè ব্যবসায়িক দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। বর্তমানে আরলিন্কস গ্রুপ অব কোম্পানি, মিডিয়াওয়ার্ল্ড এবং দ্য ডেইলি স্টারের চেয়ারম্যান পদে নিয়োজিত। পাশাপাশি পরিচালক হিসেবে আছেন মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড, রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স, মিডিয়াস্টার লিমিটেড, প্রথম আলো, এবিসি রেডিও এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সঙ্গে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য ছিলেন তিন বছর। ১৯৯৪ সালে তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ওমেন অন্ট্রাপ্রেনারস অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউইএ)। ১৫০ জন নারী উদ্যোক্তা নিয়ে গঠিত এই সংগঠন তাদের যেকোনো সমস্যায় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ওমেন ইন স্মল এন্টারপ্রাইজ (ওয়াইজ) নামে আরও একটি সংগঠন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য গড়ে তোলা হয় এ সংগঠন। তবে এসবের মধ্যে তার সবচেয়ে বড় কাজ সম্ভবত ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উইমেন অন্ট্রাপ্রেনারস সংক্ষেপে বিএফডব্লিউই। এই সংগঠনের কল্যাণে দেশের নারীসমাজ অনেক উপকৃত হয়েছে বলে তার ধারণা। বিশেষ করে গ্রামীণ নিরক্ষর নারীদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য নানা রকম প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত এখান থেকে পাঁচ লাখের বেশি নারী স্বনির্ভর হতে পেরেছেন। নারীরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা যাতে করতে পারেন, সে জন্য তিনি গড়ে তোলেন মিনি মার্ট। কারণ, জায়গার অভাবে ক্ষুদ্র নারী ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারতেন না। ধানমন্ডি, বেইলি রোড, গুলশান ও উত্তরায় রয়েছে মিনি মার্টের শাখা। প্রথমে ভাড়ায় থাকলেও এখন অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিজেরাই দোকান কিনে নিয়েছেন। বললেন, ‘সমাজ কত বদলে গেছে। আজকাল গ্রামে গেলে আমি দেখি, মেয়েরা কত আধুনিক। তারা নৌকা চালাচ্ছে, বাইক চালাচ্ছে, ছোট ছোট দোকান চালাচ্ছে। বিষয়টি আমাকে দারুণ আনন্দ দেয়।’
বাইরের রূপে বড় ব্যবসায়ী হলেও রোকিয়া আফজাল ভেতরে একেবারে সাধারণ বাঙালি নারী। আচার বানাতে ভীষণ পছন্দ করেন। বেশ ফ্যাশনেবল। সব সময় প্রেজেন্টেবল থাকায় বিশ্বাসী। পছন্দের রং সাদা-কালো। সুতি শাড়ি পরতে ভালোবাসেন। স্বপ্ন দেখেন, মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত যেন প্রোডাকটিভ থাকতে পারেন। আর চান, বিয়েতে যৌতুক প্রথা পুরোপুরি বন্ধ হোক।

 রত্না রহিমা
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top