ত্বকতত্ত্ব I পানি নিয়ে ভ্রান্তি
ধারণা ভেঙেছে এত বছর পর। তা-ও আবার সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্ব নিয়ে। মিলেছে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণও
আপনার সৌন্দর্যের রহস্য? প্রতিদিন নিদেনপক্ষে আট গ্লাস পানি পান। বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যসচেতনদের এ বুলি আওড়াতে শোনা গেছে সবচেয়ে বেশি। দেশি-বিদেশি তারকা থেকে সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞদের প্রায়শই অনেকটা হলফ করে পানির প্রয়োজনীয়তা আর উপকারিতার কথা বলতে শোনা যায়। জনপ্রিয় বিউটি বুকগুলোর পাতা ওলটাতেই মিলে যায় পানির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাদা চ্যাপ্টার। কিন্তু আসলেই কি দিনের এই আট গ্লাস পানি পানের প্রচলন ত্বকের সুস্থতায় প্রভাব ফেলে? তেষ্টা মেটালেও কি তা ত্বক আর্দ্র রাখতে সহায়ক?
সারে শুষ্কতা?
একদম না। পানি পানে তৃষ্ণা মিটলে এবং দেহ পর্যাপ্ত আর্দ্রতা পেলেও এককভাবে ত্বককে কখনোই তা আর্দ্র করে তুলতে পারে না। বলা হয় পর্যাপ্ত পানি পান দেহের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন। পাশাপাশি চিকিৎসকেরাও পরামর্শ দিয়ে থাকেন ক্যাফেইন আর চিনিযুক্ত বেভারেজের পরিমাণ কমিয়ে, বেশি করে পানি পানের। কিন্তু এর ফলে ত্বকের হাইড্রেশন লেভেল প্রভাবিত হওয়ার প্রমাণ মেলেনি। এটা নিয়ে গবেষণায় সত্যতাও প্রমাণিত হয়নি। পানি দেহে কীভাবে প্রবাহিত হচ্ছে, তা থেকেই অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে যায়। কারণ, পানি পানের পর তা সরাসরি ত্বকে পৌঁছে যায় না; বরং কিডনি দিয়ে ফিল্টারড হওয়ার পর রক্তপ্রবাহের সময় দেহ তা শুষে নেয়, ফলে কোষগুলো আর্দ্র হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে পুষ্টিগুলো ত্বক অব্দি পৌঁছে যায়।
তবে রয়েছে উপকারিতা
প্রতিদিন পানি পানে ত্বকের আমূল পরিবর্তন আসবে, এ নিয়ে সত্যতা মেলেনি বটে। তাই বলে সুবিধা যে নেই, তা-ও নয়। প্রতিদিন আট গ্লাস পানি পানে ত্বক আর্দ্র ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেখাবে, এটা মিথ হলেও কম পানি পানে দেহ ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেলে যে বিপদ বাড়বে, এতে কোনো ভুল নেই। যার প্রভাব পড়তে পারে ত্বকেও। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত ডিহাইড্রেশনে ত্বকের ইলাস্টিসিটিতে সামান্য প্রভাব পড়তে পারে। তবে নিয়ম মেনে পানি পান না করলে ত্বকের যে খুব বেশি সমস্যা হতে পারে, এমন সত্যতা মেলেনি। আর পানি পানে তো ক্ষতির কিছু নেই। মাত্রাতিরিক্ত ডিহাইড্রেশন থেকে বেঁচে থাকা যাবে। এর ফলে ত্বকে যে শুষ্কতা বা চুলকানি ভাব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা থেকে মিলবে মুক্তি।
শুষ্ক ত্বকের আর্দ্রতায়
শুধু পানির ওপর নির্ভর না করে শুষ্ক ত্বকের অধিকারীরা টপিক্যালি এবং আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে কয়টি অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে উপকার মিলবে। তবে নিয়মিত করলেই পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত ফল:
খুব বেশি শুষ্ক বাতাসে না থাকাই ভালো, প্রয়োজনে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যায়।
লম্বা সময় ধরে কিংবা গরম পানি দিয়ে গোসল এড়িয়ে চলতে হবে। থালাবাসন ব্যবহারের সময় গ্লাভস পরে নিতে হবে। এতে ক্লোরিনেটেড ওয়াটার থেকে বাঁচবে ত্বক।
স্কিন কেয়ার রুটিনে হায়ালুরনিক অ্যাসিডের যোগ করা যেতে পারে। শুষ্কতা সারাইয়ে দারুণ কাজের এটি।
এ ছাড়া আর্দ্রতার জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্বকের উপরিভাগে টপিক্যাল ময়শ্চারাইজেশন পানি পানের চেয়েও বেশি কার্যকর। ময়শ্চারাইজারে সাধারণত তিন ধরনের উপাদান থাকে, যা একসঙ্গে ত্বকের যত্নে সহায়তা করে। প্রথমত, এতে থাকে অক্লুসিভ যেমন হোয়াইট পেট্রোলিয়াম, যা প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করে দেয় ত্বকের ওপর। দ্বিতীয়ত, ময়শ্চারাইজারে থাকে গ্লিসারিনের মতো হিউমেকটেন্ট, যা স্পঞ্জের মতো আর্দ্রতাকে ত্বকের ভেতর টেনে নেয়। তৃতীয়ত, এতে থাকে এমোলিয়েন্ট। ন্যাচারাল এ অয়েলগুলো বাইরের স্তরের ত্বককোষের মধ্যকার রুক্ষ অংশগুলোকে মসৃণ করে তোলে। একটি ভালো ময়শ্চারাইজারে এই তিন উপাদানের উপস্থিতি থাকবেই, যা ত্বকে আর্দ্রতার জোগানই দেয় না, তা ধরে রাখতেও সহায়ক। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গোসল সারার দুই মিনিটের মধ্যে ময়শ্চারাইজার মাখার। তখন এটি সবচেয়ে বেশি শোষিত হয় ত্বকে। ময়শ্চারাইজার তো সহায়তা করেই আর্দ্রতা ধরে রাখতে। এর সঙ্গে যদি সেরাম ব্যবহার করা যায়, তাহলে তা আর্দ্রতার মান বাড়ায়। ভেজা ত্বকে ব্যবহারে এ সুবিধা বেশি মেলে। স্লাগিংও কিন্তু দারুণ কাজের ময়শ্চারাইজেশন ধরে রাখার ক্ষেত্রে। সাধারণত ময়শ্চারাইজিং প্রোডাক্টগুলোকে ভ্যাসলিনের টপ লেয়ার দিয়ে আটকে দেওয়া হয় ত্বকে। এতে ত্বকের সুরক্ষা দেয়ালও ভালো থাকে।
পানি পানের পরিমাণ
দেহকে আর্দ্র রাখার জন্য কতটুকু পানি পান প্রয়োজন, এর একটি সহজ সূত্র রয়েছে। ব্যক্তির ওজনকে অর্ধেক করে নিলে যে সংখ্যা আসে, তাই পান করতে হবে আউন্স হিসাবে। যেমন কারও ওজন যদি ১৪০ পাউন্ড হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন ৭০ আউন্স পানি পান করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, পানিতে পরিপূর্ণ খাবার খেলেও তা আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। হতে পারে তা কোনো ধরনের ফল বা সবজি। এ ছাড়া ফ্রুট ইনফিউজড পানিও এ ক্ষেত্রে খুব কাজে দেয়।
অভ্যন্তরে আর্দ্র থাকতে
রয়েছে আরও নানা ধরনের উপায়। প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলতে হবে। সব সময় সঙ্গে একটা পানির বোতল রাখার চেষ্টা করতে হবে। নজর দিতে হবে রোজকার ডায়েটেও। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার রাখতে হবে তালিকায়। যা ত্বকের সুস্থতা রক্ষায় সহায়ক হবে। এ ছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা, ধূমপান না করা, রোজ সাত ঘণ্টার ঘুম—এগুলোও দারুণ সহায়ক। আর দেহ সঠিকভাবে আর্দ্রতা পাচ্ছে কি না, তা বোঝার জন্য ইউরিন চেক করলেই চলবে। রংহীন পরিষ্কার ইউরিন মানে দেহ ওয়েল হাইড্রেটেড। ফলে পানি পানের সঙ্গে শুষ্ক ত্বকের আর্দ্রতার জোগানের সরাসরি সংযোগ না থাকলেও দেহের সুস্থতা বজায় রাখতে যে এটি সহায়ক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই প্রতিদিন বাড়তি কয়েক গ্লাস পানি পানে ক্ষতি নেই, বরং লাভই বেশি।
জাহেরা শিরীন
মডেল: এফা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল