skip to Main Content

কভারস্টোরি I স্বাদ সাতকাহন

স্বাদেরও আছে ব্যাকরণ। কোন স্বাদের খাবার কখন খেতে হয়, সেই তালিকা রয়েছে মানুষের হাতে। তা ছাড়া নতুন স্বাদ আবিষ্কৃতও হচ্ছে না আপাতত। সর্বশেষ ১০০ বছর আগে মিলেছিল উমামি নামের জটিল এক স্বাদের হদিস। বিস্তারিত আহমেদ সজিবের লেখায়

পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের শুরুটা ঘটে স্বাদের মাধ্যমে। মানবশিশু জন্মের পর থেকে সবকিছু মুখে দিয়ে সেটার সঙ্গে পরিচিত হতে চায়। এরপর মৃত্যু পর্যন্ত জিভ দিয়ে চলতে থাকে স্বাদ গ্রহণের এই কাজ। তবে সারা জীবন মানুষ হাতে গোনা কয়েকটি স্বাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। মাঝেমধ্যে স্বাদ চলেও যায়।
স্বাদ সম্পর্কে বিজ্ঞানে-অবিজ্ঞানে নানান আলাপ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে বোধ হয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রে। এই মতানুসারে স্বাদ ছয় প্রকার। মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, কটু, তিতা ও কষা। মানুষের খাদ্যপ্রণালিতে এই ছয় স্বাদ ছাড়াও রয়েছে তিনটি ‘দোষ’। স্বাদের সঙ্গে এসব দোষের সংযোগ বেশ জটিল। দোষ বুঝে স্বাদ নিয়ন্ত্রণের ওপর সুস্থতা অনেকাংশেই নির্ভর করে।
আয়ুর্বেদমতে মানুষের শরীরের মূল উপাদান চারটি—দোষ, ধাতু, মল ও অগ্নি। এগুলোর মধ্যে ‘দোষ’ আবার তিনটি মৌলিক উপাদানে গঠিত। সেগুলো হলো বাত, পিত্ত ও কফ। এই তিন দোষের প্রধান কাজ হজম হওয়া খাবার থেকে পুষ্টি শরীরের সব জায়গায় পৌঁছে দিয়ে কোষ ও পেশি গঠনে সাহায্য করা। শরীরে এই তিন দোষের ভারসাম্য বজায় থাকলে মানুষ সুস্থ থাকে। অন্যথায় অসুস্থ হতে হয়।
এবার আসা যাক স্বাদবৈচিত্র্যে। একেক স্বাদ একেক দোষ বাড়ায়, আবার কমায়।
মিষ্টতা
সংস্কৃতে মিষ্টি স্বাদকে বলে মাদুরা। এ ধরনের খাবার বাত ও পিত্তদোষ কমালেও কফ বাড়ায়। ফলে শরীরে দোষের ভারসাম্য নষ্ট হয়। কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলো মিষ্টি হলেও সাধারণভাবে সেই স্বাদ ধরা পড়ে না। যেমন ভাত। এটি হুট করে খেলে মিষ্টি না-ও লাগতে পারে। কিন্তু প্রথমে তিতা স্বাদের কিছু খেয়ে ভাত খেলে সেই মিষ্টতা উপলব্ধি করা যায়। শরীরের পেশি গঠনে কাজে লাগে মিষ্টি খাবার। এটি শক্তি জোগায়। তবে অতিরিক্ত মিষ্টি শরীরকে নিশ্চল করে। এমনকি দেহের সংযোগ ধমনি ও শিরার কার্যক্রমও ব্যাহত করতে পারে।
শরীরে মিষ্টি স্বাদের ভারসাম্য থাকলে মনে ভালোবাসা ও আনন্দ জন্মায়। এর বিপরীত হলে লোভের পাশাপাশি জড় জগতের প্রতি আসক্তি বাড়ে বলে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বলা হয়েছে। তা ছাড়া মানসিক অস্থিরতা ও তন্দ্রাচ্ছন্নতার জন্য দায়ী মিষ্টি স্বাদের আধিক্য। কফ দোষ বাড়ায় বলে এই স্বাদের প্রভাব পড়ে ব্যক্তির মানসিক জগতে। শরীরে কফ বেড়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুশি করা সহজ। এ কারণে মানুষের মন পেতে হয়তো মিষ্টি খাওয়ানো হয়ে থাকে। এমনকি কোনো আনন্দের সংবাদও দেওয়া হয় মিষ্টি খাইয়ে। মিষ্টি স্বাদের খাবারগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমী হলো মধু। এটি দোষের ভারসাম্য নষ্ট করে না।
আধুনিক বিজ্ঞান বলে, খাদ্যের কার্বোহাইড্রেটের হাইড্রক্সিলের উপস্থিতির জন্য খাবারের স্বাদ মিষ্টি হয়। তবে বস্তুর মধ্যে মিষ্টিকণার বিন্যাস সুনির্দিষ্ট হতে হয়। একটু ব্যতিক্রম হলেই তা তিতা হয়ে ওঠে। যেমন স্যাকারিন। সরাসরি মুখে দিলে এটি তিতা লাগে। কিন্তু লঘু তরলে দ্রবীভূত করলে এর মিষ্টটা ধরা দেয়। বলা হয়, জিভের সম্মুখভাগ মিষ্টি স্বাদ গ্রহণ করে।
টক
সংস্কৃত ভাষায় এ স্বাদের নাম অম্ল। এই ধরনের খাদ্য পিত্ত ও কফ বাড়ায়, তবে বাতদোষ কমায়। টক খাবার মানুষের ইন্দ্রিয় তীক্ষè করে। হজমেও সহায়ক। কিন্তু এই স্বাদের খাবার অতিরিক্ত খেলে শরীরের পরিবহন নালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যাদের পিত্তদোষ রয়েছে, টক খাবার তাদের শরীরে অম্লরোগ সৃষ্টি করে। অবশ্য এই স্বাদের খাদ্য সচেতনতা ও বিচক্ষণতা বাড়ায়। বিপরীত দিকে অতিরিক্ত টক খেলে মনে শত্রুতা ও ঈর্ষা বৃদ্ধি পায়। বসন্ত লোধ নামে একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের ভাষ্য, প্রিয় সম্পর্ক ভেঙে গেলে মুখে টক স্বাদ পরিলক্ষিত হয়।
সাধারণত হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সাপেক্ষে কোনো খাবারে টক স্বাদের পরিমাণ মাপা হয়। হাইড্রোজেন আয়নের জন্য খাদ্যে এমন স্বাদ হয়।
লবণাক্ত
এটি অন্য খাবারের স্বাদ বাড়ায়। এই স্বাদের খাদ্য পিত্ত ও কফ বাড়ালেও বাতদোষ কমায়। এটি পেট ফাঁপা কমায় এবং শরীরের বর্জ্য টেনে বের করে দেয়। কিন্তু দেহে এই স্বাদের খাবার বেশি প্রবেশ করলে রক্তকণা দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। সামুদ্রিক লবণ পিত্তদোষ বাড়ায়। তবে খনিজ লবণে ক্ষতির মাত্রা কম। লবণাক্ত খাবার জীবনীশক্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে; পাশাপাশি বৃদ্ধি করে যৌনকামনাও।
খাবারে সোডিয়াম আয়নের উপস্থিতির জন্য স্বাদ লবণাক্ত হয়। অবশ্য ক্ষার ধাতুর আয়নের কারণেও তা হতে পারে। যেসব লবণের আণবিক ভর কম, সেগুলো বেশি লবণাক্ত। তবে লবণ শুধু লবণাক্ত স্বাদেরই হয় না; লেড অ্যাসিটেট ও বেরিলিয়াম ধাতুর লবণ মিষ্টি স্বাদের।
কটু
এটি মসলাদার স্বাদ হিসেবেও পরিচিত। এ স্বাদের খাবার পিত্ত ও বাতদোষ বাড়ায়; তবে কফ কমায়। মরিচ, আদা, লবঙ্গ ও গোলমরিচে কটু স্বাদ মেলে। পেঁয়াজ, রসুন ও মুলাতেও এই স্বাদ আছে। এ ধরনের খাবার ক্ষুধা বাড়ায় এবং পরিপাকে সহায়তা করে। কটু খাবার চর্বি কমানোতেও কার্যকর। তবে এই স্বাদের খাদ্য অতিরিক্ত খেলে শরীরে বীর্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা কমে যায়। তা ছাড়া আয়ুর্বেদমতে, কটু খাবার রাগ ও হতাশা বাড়ায়। তাই পেঁয়াজ, রসুন ও বেশি ঝাল এড়িয়ে চলতে বলেন অনেকে।
তিক্ত
মানুষের খাবারের তালিকায় তিক্ত তথা তিতা স্বাদের পদ খুবই কম। তবে খাওয়ার আগে এই স্বাদ কিছুটা গ্রহণ করলে জিভে মূল খাদ্যের স্বাদ বেড়ে যায়। এ ধরনের খাবার লিভার পরিষ্কার করে, শরীরের বিষাক্ততা ও উষ্ণতা কমায়, জীবাণু ধ্বংস করে। রক্ত পরিশুদ্ধ করার গুণও রয়েছে এই স্বাদের খাদ্যে। তবে অতিরিক্ত তিক্ত গ্রহণ করলে যৌনকামনা কমে যায়। তাই যারা ব্রহ্মচারীব্রত পালন করেন, তারা এই স্বাদের খাবার বেশি খান। এ স্বাদ মানুষের মনে মিষ্টি, টক ও কটু খাবারে আসক্তি কমায়।
কষা
এই স্বাদের খাবার বাতদোষ বাড়ায়; কিন্তু পিত্ত ও কফ কমায়। কাঁচা কলা, মটরশুঁটি ও শিমে এই স্বাদ মেলে। এ ধরনের খাদ্য আলসারের পথ্য। শরীরে রক্তপ্রবাহও স্বাভাবিক করতে পারে। কষা স্বাদের খাবার মানসিক বিকাশ ঘটায়, তবে বেশি খেলে মনে ভয়ভীতি বাড়ে বলে দাবি আয়ুর্বেদশাস্ত্রের।
বিভিন্ন বিশ্লেষণে বোঝা গেল, একেক স্বাদের খাবার একেক দোষ বাড়ায় ও কমায়। কোনো স্বাদের খাবারেই এককভাবে বাত, পিত্ত ও কফদোষের ভারসাম্য মেলে না। তাই আয়ুর্বেদমতে সব স্বাদের খাদ্য সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। শরীরের অবস্থা বুঝে একেকজনের জন্য একেক স্বাদের খাবারের পরামর্শ দেয় এই শাস্ত্র।
বায়ু, পিত্ত ও কফই শরীর পরিচালনার মূল শক্তি। মানুষের মধ্যে কারও শরীর বায়ু প্রকৃতির; কারও আবার পিত্ত প্রকৃতির, কেউ কেউ কফ প্রকৃতির। তাই প্রকৃতি বুঝে বিভিন্ন স্বাদের খাবার গ্রহণ ও বর্জন করার পরামর্শ দেন আয়ুর্বেদবিশারদেরা। যেমন বায়ু প্রকৃতির মানুষের খাবারে ৫০ শতাংশ শর্করা, ৪০ শতাংশ উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং ১০ শতাংশ ফল থাকা চাই। এই দোষের লোকেদের শুকনা, মচমচে, শীতল ও কাঁচা খাবার এড়িয়ে যেতে বলা হয়।
পিত্ত প্রকৃতির মানুষের খাদ্যতালিকায় বেশি সবজি ও তিক্ত স্বাদযুক্ত খাবার থাকা জরুরি। খাদ্যে বেশি লবণ ও মসলা ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে তাদের। এমনকি টক স্বাদের খাবারও খেতে হবে কম। তবে এই প্রকৃতির মানুষের দারুচিনি, হলুদ, গোলমরিচ, চা ও কফি খেতে বাধা নেই। অ্যালকোহল তাদের জন্য পরিত্যাজ্য।
কফ প্রকৃতির মানুষদের ক্ষুধার চেয়ে কম খাবার গ্রহণ করা ভালো। মসলাদার খাবার, শুকনা ডুমুর, সামান্য শর্করা, ডিম, মুরগি, মাষকলাই ছাড়া অন্য ডাল, মধু, ননিমুক্ত দুধ—এসব খাবার তাদের স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম।
স্বাদে যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি কোন স্বাদের খাবার কখন খাওয়া উচিত, সেই রুটিনও রয়েছে আয়ুর্বেদে। দুপুর ও রাতের খাবারে ছয় স্বাদযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করাই ভালো। এ ক্ষেত্রে বায়ু, পিত্ত ও কফের প্রকৃতি মেনে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ জরুরি। খাবারের শুরুতে মিষ্টি ফল দিয়ে শুরু করা ভালো। এরপর লবণাক্ত ও টক স্বাদের খাবার খাওয়া উত্তম। শেষে কটু, কষা ও তিক্ত দিয়ে সমাপ্তি ঘটাতে বলে আয়ুর্বেদশাস্ত্র। তা ছাড়া খেতে হবে মনোযোগসহকারে। খাদ্যবস্তু ঠান্ডা হওয়ার আগেই খেয়ে শেষ করা স্বাস্থ্যকর। তবে খাবারের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণের জন্য হাতে সময় নিয়ে খেতে বসা ভালো। তা ছাড়া বেশি খাওয়ার অভ্যাস বাদ দেওয়া চাই। খেতে হবে শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্য। আগের বেলার খাবার হজম না হলে পরের বেলায় কম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। এমনকি আয়ুর্বেদের পণ্ডিতদের মতে, ক্ষুধা না লাগলে রাতের খাবার না খাওয়াই শ্রেয়।
এগুলোর বাইরেও কিছু স্বাদের হদিস পেয়েছে মানুষ। যেমন ‘উমামি’। অন্য স্বাদের তুলনায় এ কিছুটা জটিল। এই স্বাদ বোঝা ও চেনা কষ্টকর। এমনকি বড় বড় রন্ধনশিল্পীও এই স্বাদের কথা সঠিকভাবে বুঝিয়ে উঠতে পারেননি।
শতবর্ষ আগে পৃথিবীতে এই স্বাদের হদিস মেলে। জাপানের টোকিওর ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর কিকুনাই ইকিদা আবিষ্কার করেন এই স্বাদ। পড়াশোনার জন্য জার্মানের লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন ইকিদা। সেখানে ইউরোপীয় ঐতিহ্যবাহী কুজিনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। সে সময় সে দেশে বেশির ভাগ খাবারে থাকত টমেটো, অ্যাসপারাগাস ও চিজ। এসব খাবারেই এই স্বাদ আবিষ্কার করেন জাপানি ইকিদা। নিজ দেশে তিনি কখনোই এই স্বাদ পাননি। স্বাদটির ব্যাখ্যা বেশ জটিল মনে হয়েছিল তার কাছে। তবে অন্য স্বাদ থেকে যে তা আলাদা, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। পরে দেশে ফিরে নতুন এই স্বাদের সন্ধান করতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যান একসময়। সামুদ্রিক গুল্ম-লতা মিশিয়ে জাপানে ‘কমবু’ নামে একধরনের স্যুপ তৈরি হয়। স্বাদ বাড়ানোর জন্য দেশটিতে এই স্যুপ খেয়ে থাকেন কেউ কেউ। তাতেই উমামি স্বাদ খুঁজে পান ইকিদা। তিনি খেয়াল করলেন, এই স্বাদের উৎস গ্লুটামেট নামের একধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড, যা প্রোটিনে মেলে।
উমামি স্বাদের জন্ম ১৯০৮ সালে। ১৯১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন স্বাদ খুঁজে পাওয়ার কথা জানান ইকিদা। কিন্তু জাপানের বাইরে এই স্বাদ খুব একটা পরিচিতি পায়নি। কেননা মূল স্বাদের বাইরেও স্বাদ থাকতে পারে—বিশ্বের অন্যান্য মানুষ তা বিশ্বাস করতে চাইত না।
জাপানি উমামি শব্দের অর্থ ভালো স্বাদ। গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা ইকিদার আবিষ্কারের বিষয়ে অনুসন্ধান চালান। ১৯৮২ সালে উমামি স্বাদকে দেওয়া হয় বিশ্ব স্বীকৃতি। স্বাদটি বড় বড় শেফ ও খাদ্য সমালোচকের কাছে এখনো ব্যাখ্যাতীত। আবিষ্কারের প্রায় ৯০ বছর পর গবেষকেরা নিশ্চিত করেছিলেন, মানুষের জিভ পৃথকভাবে উমামি স্বাদ শনাক্ত করতে সক্ষম। উমামি বর্তমানে ভোজনরসিক ও রন্ধনশিল্পীদের কাছে পরিচিত নাম। বিভিন্ন খাবারকে সুস্বাদু করে তোলে এই স্বাদ।
নানান স্বাদের মিশেলে আছে আবার মিশ্র স্বাদ। উদাহরণ দেওয়া যাক। একটি কমলার অর্ধেক খাওয়ার পর মধু খেয়ে তারপর বাকি অর্ধেক খাওয়া হলো। এ ক্ষেত্রে প্রথম অর্ধেক কমলা মিষ্টি লাগলেও দ্বিতীয় অর্ধেক লাগবে টক। কারণ, মধুর মিষ্টতা কমলার মিষ্টতাকে প্রভাবিত করেছে। এই প্রভাবিত স্বাদকেই বলা হচ্ছে মিশ্র স্বাদ। অন্যদিকে, আধুনিক গবেষণায় চর্বিজাত খাবারকেও আলাদা স্বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। লালা রসে উপস্থিত কিছু উৎসেচক চর্বি ভেঙে ফ্যাটি অ্যাসিডে পরিণত করে। এরপরই চর্বির স্বাদ পাওয়া যায়। মানুষের জিভের কিছু রিসেপ্টর চর্বি ও উদ্ভিজ্জ তেলের ট্রাইগ্লিসারাইডে সাড়া দেয়।
স্বাদ যেমনই হোক, তা গ্রহণের অন্যতম অঙ্গ হলো জিভ। এটির ওপরে ছোট ছোট দানা রয়েছে, যেগুলো স্বাদনালি নামে পরিচিত। একেকটি নালিকা বেশ কিছু কোষের সমষ্টি। এগুলোর উপরিভাগে চুলের মতো চিকন শিরা দেখা যায়। মানুষের স্বাদনালিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলোই মস্তিষ্কে স্বাদের বার্তা পৌঁছায়। জিভের গোড়ায় পাওয়া যায় ঝাল ও মিষ্টি স্বাদ, পেছনে তিতা এবং দুপাশে লবণাক্ত, টক ও কষা। জিভের মাঝ বরাবর কোনো স্বাদনালিকা থাকে না। তাই সেখানে স্বাদ মেলে না। তবে এসবের বিপরীত মতও রয়েছে।
যেকোনো খাবার একটু তরল না হলে সেটির স্বাদ খোলে না। তাই খাদ্যবস্তু মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লালা বেরোয়। তারপর স্বাদনালি জেগে ওঠে। এরপর স্নায়ুর মাধ্যমে স্বাদের তথ্য পৌঁছায় মগজে। তবে খাবারের স্বাদ পেতে জিভই একমাত্র অঙ্গ নয়। খাদ্যের সুবাসও স্বাদের সঙ্গে যুক্ত। তাই নাকও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মূলত যেকোনো খাবারের স্বাদের ব্যাপারে প্রথমেই বার্তা দেয় নাসিকা। এ জন্যই কথায় বলে, ঘ্রাণেই অর্ধভোজন। নাকের অলফ্যাক্টরির এপিথেলিয়ামের মাধ্যমে খাদ্যের সুবাস বোঝা যায়। তা ছাড়া বিভিন্ন নার্ভের মাধ্যমে খাবারের আকারের বার্তা পৌঁছায় মস্তিষ্কে। এ ছাড়া ত্বকের থার্মোরিসেপ্টরের মাধ্যমে খাদ্যটির তাপমাত্রার সংকেত মেলে। কেমেসথেরিসের মাধ্যমে খাবারে ঠান্ডা ও গরম বোঝা যায়। খাবার মুখে দেওয়ার পর প্রথমে লালা রসে মিশে সেগুলো স্বাদনালির সংস্পর্শে আসে। পরে সেই স্বাদ যুক্ত হয় গাস্টেটরি রোমের রিসেপ্টরে। এরপর ক্রেনিয়াল নার্ভের মাধ্যমে স্বাদের বার্তা পৌঁছে যায় নিউরনে। শেষে থালামাসের মাধ্যমে পৌঁছায় ব্রেইনে।
মানুষের জিভের সামনে ও পেছনে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার স্বাদকোরক থাকে। এমনকি মুখগহ্বরের উপরিভাগে, পাশে ও গলায়ও আছে স্বাদকোরক। শুধু জিভে এ ধরনের কোরকের সংখ্যা ১০ হাজার, যেগুলোর গড় আয়ু মাত্র ১০ দিন। এরপর আবারও নতুন কোরক জন্মায়। ব্যক্তিমানুষটির বয়স ৫০ পেরোনোর পর এগুলোর জন্মানোর হার কমে আসে। অন্যদিকে বড়দের জিভে স্বাদনালিকার সংখ্যা ছোটদের চেয়ে বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে নালিকাগুলো ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সেগুলো নিষ্ক্রিয় হয়। একজন ৭০ বছর বয়সী মানুষের জিভে স্বাদনালিকার সংখ্যা কমতে কমতে চার শয়ে ঠেকতে পারে। এ ছাড়া স্বাদের বিষয়টি ব্যক্তির লৈঙ্গিক বিষয়ের ওপরও নির্ভর করে। যেমন মেয়েরা মিষ্টি, সবজি ও ফল বেশি পছন্দ করে। অন্যদিকে ছেলেদের পছন্দ মাছ-মাংস। পুরুষেরা চকলেটি স্বাদের প্রতি অনেকটা নিরাসক্তই থাকে। আবার নারীদের জিভের আগা টক স্বাদের ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় একটু বেশিই সেনসিটিভ।
ওপরে নানান স্বাদের আলোচনা হলেও ঝালের কথা বলা হয়নি। কারণ, ঝাল কোনো স্বাদই নয়! এটি একধরনের অনুভূতিমাত্র। খেয়াল করলে দেখা যাবে মিষ্টি, টক কিংবা তিতা স্বাদের কোনো খাবার হাতে কচলে নিলে তাতে চামড়া জ্বলে না। কিন্তু ঝাল কিছু কচলাতে গেলেই হাত জ্বলে। এ থেকেই বোঝা যায়, ঝাল মূলত ষড়স্বাদের মধ্যে পড়ে না। মানুষের জিভ যেসব স্বাদ বুঝতে পারে, সেগুলোর মধ্যে ঝাল অনুপস্থিত। ঝাল অনুভূতি তৈরি হয় মূলত একধরনের জ্বালাপোড়া ও উষ্ণতা থেকে। মরিচের মধ্যে ক্যাপসিসিন নামের উপাদান থাকে। এটি মরিচ ছাড়া অন্য কিছুতে মেলে না। স্বাদগ্রন্থিগুলোর সঙ্গে এই ক্যাপসিসিন মিশে মুখের ভেতর জ্বালাপোড়া ও উষ্ণতা তৈরি করে, যা মানুষের মুখে ঝালের অনুভূতি দেয়। আরেকটি বিষয়, মিষ্টি কিংবা টক খাওয়ার জন্য অভ্যাসের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ঝাল গ্রহণ করতে অভ্যাসের প্রয়োজন। সবাই সমান ঝাল খেতে অভ্যস্ত নয়।
যাহোক, জিভ থাকলেই যে স্বাদ মিলবে, তা না-ও হতে পারে। শারীরিক বিভিন্ন জটিলতায় স্বাদের হেরফের হতে পারে। এমনকি স্বাদ উবেও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবকিছুর স্বাদই এক রকম লাগে। সেটা হলো বিস্বাদ! বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মুখের স্বাদ বদলে যেতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বাদে পরিবর্তন আসতে পারে। হরমোনের কারণে অন্তঃসত্ত্বার জিভের স্বাদকোরকে পরিবর্তন আসে। এমনকি দাঁতের অযত্ন করলেও খাবারের প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এমনটাই জানিয়েছেন দন্ত চিকিৎসকেরা।
শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা ও শ্লেষ্মার কারণেও অনেক সময় জিভে স্বাদ মেলে না। এ ক্ষেত্রে গলা ও নাকের শ্লেষ্মার স্বাদ মুখে চলে আসে। সাইনাসের কারণেও এমনটা হতে পারে। আবার শরীরে জিংকের ঘাটতির কারণেও স্বাদেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অনেক সময় ক্ষুধা বাড়াতে চিকিৎসকেরা জিংক দিয়ে থাকেন। কেমোথেরাপি নেওয়া রোগীরাও অনেক সময় স্বাদশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তারা তিক্ত স্বাদ পান মুখে। এটা মূলত ওষুধের কারণে হয়।
কোনো কোনো খাবার আছে, যেগুলো স্বাদকোরকে প্রভাব ফেলে। যেমন পাইন বাদাম। এটি খাওয়ার ১২ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুখে তিক্ত স্বাদ অনুভূত হয়। একে বলে পাইন সিনড্রোম। এ ছাড়া স্বাদ হারানোর আরেকটি কারণ হতে পারে মার্কারি পয়জনিং। পারদসংশ্লিষ্ট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা এ ধরনের বিষক্রিয়ায় স্বাদ হারানোর শঙ্কায় থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে লিভার ও কিডনি রোগে ভোগার কারণেও মুখের স্বাদ হারিয়ে যেতে পারে। দুনিয়াজুড়ে স্বাদ হারানোর একটি সর্বনাশা ঢেউ এসেছিল বছর তিনেক আগে, যার রেশ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। বলছি করোনাভাইরাসের কথা। প্রাণঘাতী এই মহামারিতে আক্রান্তদের অনেকে অভিযোগ তুলেছিলেন স্বাদ খোয়ানোর। একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা অবশ্য ফিরে পেয়েছেন বেশির ভাগ জনই। তবে যত দিন তা পাননি, ততদিন কেমন বিস্বাদ জীবন কেটেছে তাদের, তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া বোধ করি আন্দাজ করাও সম্ভব নয়।
খাদ্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে সকল প্রাণসত্তা। বুদ্ধিবৃত্তির জোরে মানুষ তার খাবারের স্বাদে আনে বৈচিত্র্য। স্বাদবিহীন খাদ্য আসলে ভাবা যায় না!

স্বাদ-ভাবনা
-আরিফিন শুভ

স্বাদের নানা বৈচিত্র্য বিবেচনা হয়তো অতটা না করে, যা খেতে ভালো লাগে, তা-ই আমার পছন্দের খাবার। এর মধ্যে বিরিয়ানি, তেহারি, ভাত, আলুভর্তা, ডিম, ভাজির কথা বলতেই হবে। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ হিসেবে পছন্দের খাবারের তালিকা দেখে হয়তো অনেকে অবাক হবেন। তবে যতটুকু খাবার খাই, সেই অনুসারে ক্যালরি বার্ন করলে আসলে কোনো ঝামেলা থাকার কথা নয়। অনেক খাবার বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের পরও শ্রমজীবীদের অনেকের দেহে ফ্যাট দেখা যায় না। এর অন্যতম কারণ কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে ক্যালরি বার্ন করা। আমি দেশে-বিদেশে নতুন খাবার এক্সপ্লোর করতে খুব পছন্দ করি। স্থানীয় খাবারের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান, জাপানিজ, কোরিয়ান, ইন্ডিয়ান, মেক্সিকান ফুড পছন্দ। এক্সপ্লোর করা সবচেয়ে পছন্দের খাবার মেক্সিকান ‘ক্যাসেডিলা’। টং দোকানের মতো জায়গায় রুটির মাঝে চিজ ও মিট দিয়ে ভেজে পরিবেশন করা হয়। লস অ্যাঞ্জেলেসে খাবারটি খেয়েছিলাম।

অনুলিখন: ফুয়াদ রূহানী খান

মডেল: আরিফিন শুভ
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ওয়্যারড্রোব: রাইজ
ছবি: ফারাবী তমাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top