এডিটর’স কলাম I পরিণয়পূর্বক
দাম্পত্য জীবনে বিশেষত জীবনসঙ্গীর সঙ্গে স্বার্থপরতার কোনো জায়গা নেই। একজন ব্যক্তিমানুষকে এই সম্পর্কে জড়ানোর শুরু থেকেই নিজের মনোজগতের ‘আমি’ বোধ তাড়িয়ে, জায়গা করে দিতে হবে ‘আমরা’কে
বিয়ে। অনেক আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশায় গড়া একটি স্বীকৃত বন্ধন। এ বন্ধনে জড়িয়ে দুজন আলাদা মানুষ একটি অভিন্ন দাম্পত্য জীবনের ভেতর দিয়ে পাড়ি দেন বাকি পথগুলো, এমনটাই আশা করা হয়। অশেষ স্বপ্নে সাজানো সেই পথ যে সব সময় নিষ্কণ্টক হবে, তা নয়। না চাইলেও, কখনো কখনো ছড়িয়ে পড়ে অতি সূক্ষ্ম থেকে শুরু করে অতিকায় কণ্টক! তাই তো বিয়ে নিয়ে অনেকে ভোগেন দ্বিধা ও শঙ্কায়; বিশেষত এই বন্ধন গড়ার ক্ষণ যাদের আসন্ন কিংবা যারা নবদম্পতি। অথচ জীবনের প্রকৃত মর্ম উদ্ধার করা গেলে, নিজ দায়িত্ববোধ সম্পর্কে থাকতে পারলে সদা সচেতন, বিয়ের ফল মধুর হওয়ারই কথা। সে জন্য চাই কিছু প্রস্তুতিও।
দুই
বিয়ে মানে গভীর এক বোঝাপড়ার সামনে হাজির হওয়ার উপলক্ষও। জীবনকে এত দিন যেভাবে দেখে এসেছেন, সেই একলা পথচলার বেলা ফুরিয়ে, ভাবনাজুড়ে সঙ্গীকেও সঙ্গে রাখার সময়কালের সূচনা। যা বয়ে বেড়ানো চাই আমরণ। এর জন্য বর ও কনে—দুজনকেই শরীর ও মন—উভয় দিক থেকেই থাকা চাই যথাযোগ্য প্রস্তুত। প্রাত্যহিক জীবনচর্চায় আনা চাই কিছু জরুরি পরিবর্তন ও পরিমার্জন।
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা শুরুতেই জোর দিয়ে থাকেন মনোভাব পরিবর্তনের ওপর। কী রকম? দাম্পত্য জীবনে বিশেষত জীবনসঙ্গীর সঙ্গে স্বার্থপরতার কোনো জায়গা নেই। একজন ব্যক্তিমানুষকে এই সম্পর্কে জড়ানোর শুরু থেকেই নিজের মনোজগতের ‘আমি’ বোধ তাড়িয়ে, জায়গা করে দিতে হবে ‘আমরা’কে। এর মানে যে আপনি আত্মপরিচয় খোয়াবেন কিংবা ব্যক্তিগত সুখ-শান্তির ভাবনা বিসর্জন দিতে হবে, তা নয়; বরং জীবনযাত্রার সব ভাবনায় জীবনসঙ্গীকেও জুড়ে নেওয়া। তাতে দুজনের মধ্যে প্রকৃত বন্ধন গড়ে ওঠার বাড়ে সম্ভাবনা; পাশে সরিয়ে রাখা সম্ভব অহম ও আত্মকেন্দ্রিকতার মতো সম্পর্কগ্রাসী বোধ।
একসঙ্গে চলতে গেলে নানা বিষয়ে দ্বিমত হতেই পারে। সব বিষয়ে দুজনে প্রাণখুলে কথা বলতে পারলে দাম্পত্য জীবন হয়ে ওঠে স্বাস্থ্যকর। চাই সেই মানসিকতা। এ ছাড়া সম্ভব হলে বিয়ের আগেই অংশ নিতে পারেন প্রিম্যারিটাল ক্লাস কিংবা কোর্সে। আমাদের সমাজে যদিও তা এখনো খুব একটা প্রচলিত নয়; তবু ইচ্ছে থাকলে তো সম্ভব! এতে বোঝা সহজ হবে দাম্পত্যের নানা বাঁক।
অন্যদিকে, বলা হয়ে থাকে, ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’। আবার অর্থ বা টাকাপয়সা জীবনের অন্যতম অনিবার্য চালিকাশক্তি। তাই অর্থবিষয়ক পরিকল্পনাগুলো আগে থেকেই গুছিয়ে নিতে পারলে মন্দ হয় না। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সন্তান নিয়ে আলোচনা, ক্ষমা করার মতো মহানুভবতা ধারণ প্রভৃতি চর্চাও নিজের ভেতর গড়ে তোলা শ্রেয়।
তিন
বিবাহ মধুর, আর তাতে বিষ হয়ে উঁকি দেয় বিচ্ছেদ। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, আশপাশে তাকালেই হরদম বিবাহবিচ্ছেদের খবর আসে আমাদের কানে; আরও ভেসে আসে ধুঁকতে ধুঁকতে সম্পর্কবিনাশী গুঞ্জরণ ছড়ানো মর্মভেদী ক্রন্দন। বিবাহবিচ্ছেদের যেকোনো পরিসংখ্যানই আঁতকে দেওয়ার মতো। তাতে কি। সুখের সংসারে দুঃসময় হানা দিলে থাকা চাই শক্ত। রুখে দেওয়া চাই ভাঙনের ঢেউ। সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে এবং বিচ্ছেদের শঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। তবে বিশেষজ্ঞরা মোটাদাগে কয়েকটি উপায়ের অবতারণা করে থাকেন। যেমন, দ্রুত ক্ষমা করে দেওয়ার গুণ। জীবনসঙ্গীর কোনো আচরণ কিংবা কথা যদি আপনাকে আহত করে, নিজের অহমকে বড় হয়ে উঠতে দেবেন না; বরং ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে করুন বিবেচনা। এতে দিন শেষে উপকারই হবে—উভয়ের। যদিও জানি, মুখে বলা যত সহজ, ক্ষমা করা তত নয়। এটি একটি মানসিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অর্জন বা আয়ত্ত করতে হয়। স্বাস্থ্যবিষয়ক অলাভজনক আন্তর্জাতিক জোট এনসিএইচসির (ন্যাশনাল কোয়ালিশন অন হেলথ কেয়ার) ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট অরা ডি লস স্যান্টোস যথার্থই বলেছেন, ‘ক্ষমাশীলতা হলো যেকোনো দম্পতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে কঠিন বিষয়ের একটি। কোনো দম্পতি যখন একে অন্যকে ক্ষমা করে দেয়, তাদের সামনের পথ সুগম হয়ে ওঠে। কেননা, ক্ষমাশীলতা হলো সেই জানালা, যার ভেতর দিয়ে তারা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়; ফলে যেসব পরিস্থিতি তাদেরকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, সেসবে আটকে থাকতে হয় না তাদের।’ তাই আসন্ন ভাঙন ঠেকাতে ক্ষমা রাখতে পারে কার্যকর ভূমিকা।
অন্যদিকে, জীবনসঙ্গীকে শ্রদ্ধা করা, পরস্পর যথাসম্ভব সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থাকা, আর্থিক প্রত্যাশা নিয়ে আলাপচারিতা, পরস্পরকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া, দৈহিক ও মানসিকভাবে স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা প্রভৃতির ওপরও জোর দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তাতেও যদি না সারে ক্ষত, সরাসরি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে কুণ্ঠা থাকা উচিত নয়।
চার
মানুষের মন বড়ই বিচিত্র! যখন-তখন বৈচিত্র্যের অন্বেষণে সচেষ্ট! তবু দায়ভার অনুভব করার মতো বোধশক্তি প্রত্যেক স্বাভাবিক মানুষের অন্তস্তলে প্রাকৃতিকভাবেই নিহিত থাকে। একে জাগিয়ে তোলা চাই। আমেরিকান সাহিত্যিক মিগনন ম্যাকলাফলিন বলেছেন, ‘একটি সফল বৈবাহিক জীবনের পূর্বশর্ত হলো বহুবার প্রেমে পড়ার ক্ষমতা; তবে প্রতিবার একই মানুষের প্রতি।’ এই বোধ আয়ত্ত করার জন্য চাই যথাযোগ্য মানসিক প্রস্তুতি।
পাঁচ
সঠিক প্রস্তুতিতে, নির্ভয়ে ও আত্মবিশ্বাসে সূচনা ঘটুক বৈবাহিক জীবনের। তাতে চলমান থাকুক সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্কচর্চা। জীবন আনন্দের হোক।