ফুডচেইন I টুংটাং টাকো বেল
টাকো বেল। আমেরিকান বহুজাতিক ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট চেইন। যাত্রা শুরু ১৯৬২ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার ডাউনিতে, গ্লেন বেলের হাত ধরে। সাধারণত মেক্সিকান অনুপ্রাণিত বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করে। ১৯৭৮ সালে এর মালিকানা কিনে নেয় পেপসিকো
‘ইনোভেশন উইদ আ টুইস্ট অন দ্য ফেমিলিয়ার’—টাকো বেলের প্রোডাক্ট ফিলোসফি। পণ্য উদ্ভাবনের জন্য এই মেক্সিকান অনুপ্রাণিত আমেরিকান ফাস্ট ফুড চেইন বরাবরই পরিচিত। এমন উদ্ভাবনের সূচনা ঘটে ২০১২ সালে, ব্যাপক জনপ্রিয় ফুড আইটেম ডোরিটস লোকস টাকোসের মাধ্যমে। টাকো বেলের কৌশলে পণ্যের উন্নয়নের রয়েছে অগ্রাধিকার। এর ভিত্তিতে ব্যাপক সফলও ফুড চেইনটি। আর বিষয়টি শুধু তাদের খাবারের মেনুতেই নয়, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে, অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের বিশেষ ফিচার কিয়স্কে প্রবর্তনের মাধ্যমে সেলফ সার্ভিস প্রযুক্তির জন্য উদ্ভাবনী পুরস্কারও জিতে নিয়েছে টাকো বেল।
গেল শতকের ষাটের দশকে শুরু করে কীভাবে এত দিন পরও একটি উদ্ভাবনী ফ্র্যাঞ্চাইজি হওয়ার খ্যাতি বজায় রাখতে পেরেছে এই প্রতিষ্ঠান? তা বুঝতে হলে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া চাই:
টার্গেট মিলেনিয়াল
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টাকো বেল তার টার্গেট কাস্টমার হিসেবে পরিবার ও শিশুদের বদলে বরং বিবেচনায় রাখছে মিলেনিয়ালদের; অর্থাৎ ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে জন্মগ্রহণকারী ভোক্তাদের। এমনকি এই পরিবর্তনের সময় তারা শিশুদের মেনু সরিয়ে ফেলেছে। কেননা, বিশ্বাস করা হয়, মিলেনিয়ালরা এই ব্র্যান্ডের প্রতি অনুগত বলে পরিচিত এবং এরাই যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ। মিলেনিয়ালরা প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা রাখে; আর তা মাথায় রেখে একাধিক কৌশল প্রয়োগ করেছে টাকো বেল। বাড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিটিস; এমনকি এক্স (টুইটার) ও স্ন্যাপচ্যাটের মাধ্যমে মিলেনিয়ালদের আরও কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রচারণা চালিয়েছে। এটি তাদেরকে কাঙ্ক্ষিত ভোক্তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মাধ্যমে তাদের ব্র্যান্ড সচেতনতারও প্রসার ঘটেছে।
শুধু তা-ই নয়, মিলেনিয়ালরা যে তাৎক্ষণিক তৃপ্তি ও সেবা পেতে আগ্রহী—এ ব্যাপারেও টাকো বেল টিম সচেতন। তাই তারা অর্ডারিং ও সার্ভিসের উন্নতি ঘটাতে প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে। এতে সার্বিক সিস্টেমকে আগের চেয়ে আরও দক্ষ করে তুলেছে। মিলেনিয়ালদের ওপর ফোকাস করেই থামেনি তারা; খেয়াল করেছে, কর্মশক্তির একটি বড় অংশ ওই প্রজন্মের প্রতিনিধি। তার মানে, চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে ভিন্নভাবে জড়ানো প্রয়োজন, বিশেষ করে চাকরির বিজ্ঞাপনে। মিলেনিয়ালরা সাধারণত সেলফোন নিয়ে সময় বেশি কাটায়। তাদের জন্য সহজে চাকরির আবেদনের ব্যবস্থা রাখতে ওয়ার্কস্ট্রিমের এন্ড-টু-এন্ড হায়ারিং প্ল্যাটফর্মের স্বয়ংক্রিয় টেক্সট বার্তার শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে ব্র্যান্ডটি।
মেনু উদ্ভাবন
টাকো বেলের ইনসাইটস ল্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মেলিসা ফ্রাইবের মতে, তাদের পণ্য উদ্ভাবনগুলো কেবলই গ্রাহকদের চাহিদার প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ তারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে উদ্ভাবন করছে না; বরং গ্রাহকদের চাহিদা ভালোভাবে পূরণ করাকে নিশ্চিত করতে চায়। তাদের ব্যাপক বাজার গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত কিছু মেনু আইটেমে নজর বোলালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ডোরিটোস লোকোস টাকোস: তাদের সর্বাধিক জনপ্রিয় এই পণ্য ২০১২ সালে আবির্ভূত হলেও আমেরিকান আরঅ্যান্ডডি প্রতিষ্ঠান ফ্রিটো লের সঙ্গে যৌথভাবে টাকো বেল আরঅ্যান্ডডি টিম ২০০৯ সাল থেকে এর পেছনে কাজ করে আসছে। বেশির ভাগ ভোক্তা স্যান্ডউইচে আলুর চিপস পছন্দ করেন। এ ছাড়া কারও কারও পছন্দ ডোরিটোসের স্বাদ—বিষয়টি টের পেয়ে এই আইডিয়ার সূত্রপাত। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে টাকোগুলোকে আরও সুস্বাদু করার উপায় খুঁজে নেয় তারা। বলা বাহুল্য, সফলও হয়। প্রবর্তনের পর থেকে এ পর্যন্ত এক বিলিয়নের বেশি ডোরিটোস লোকোস টাকোস বিক্রি হয়েছে। আর একে গণ্য করা হয় টাকো বেলের ইতিহাসের অন্যতম আইকনিক খাদ্য উদ্ভাবন হিসেবে।
স্বাস্থ্যসচেতন খাবার: পরিবর্তিত ভোক্তা প্রবণতায় অধিকাংশ মানুষ এমনকি ফাস্ট ফুডের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করে—এটি নতুন কিছু নয়। আর এর গুরুত্বকেও এড়িয়ে যায়নি টাকো বেল। ২০১২ সালে ব্র্যান্ডটি ক্যান্টিনা মেনু চালু করে, যাতে উচ্চ মানের উপাদান ও স্বাস্থ্যকর বিকল্প অন্তর্ভুক্ত। তাদের মেনুর এই অংশ সিনিয়র সিটিজেন ও নারীরা সাদরে গ্রহণ করেন; অথচ ব্যাপারটি অনেক ফাস্ট ফুড জায়েন্ট বিশেষভাবে খেয়াল করেনি। এই প্রবণতা বজায় রেখে এবং নতুন মেনু উদ্ভাবনের মাধ্যমে টাকো বেল দ্রুত পরিষেবা রেস্তোরাঁ (কিউএসআর) শিল্পের অন্যতম উদ্ভাবনী ব্র্যান্ড হিসেবে অবস্থান দৃঢ় করেছে।
গ্রাহক অভিজ্ঞতা অগ্রাধিকার
এই যুগে ডিজিটালাইজেশনের প্রভাব সর্বব্যাপী—টাকো বেল কর্তৃপক্ষ তা জানত। তারা বুঝতে পেরেছিল, গ্রাহকেরা যে আচরণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া চাই। প্রকৃতপক্ষে, তারাই প্রথম কিউএসআর—যারা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার দেওয়ার এবং পেমেন্ট করার সিস্টেম চালু করেছে। লাইনে দাঁড়ানোর মতো দীর্ঘসূত্রতা যারা এড়াতে চান, এই পরিষেবা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা এনে দেয় তাদের। টাকো বেল’স অল অ্যাকসেসের সিনিয়র ডিরেক্টর রফিক হান্নার মতে, কোম্পানির প্রতিটি ডিজিটাল ট্রানজিশনের জন্য তারা সব সময় জিজ্ঞেস করে, ‘গ্রাহকের জন্য এতে কী রয়েছে?’ সর্বোত্তম গ্রাহক অভিজ্ঞতা তৈরি করতে তাদের কিছু উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান গ্রুভুবের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে ডেলিভারি সার্ভিস সম্প্রসারণ। এভাবে নিজেদের ডেলিভারি সার্ভিসগুলোকে স্ট্রিমলাইন করে তারা দূরবর্তী গ্রাহকদের সেরা অর্ডারিং অভিজ্ঞতা দেওয়া নিশ্চিত করেছে।
শুধু তা-ই নয়, পুরস্কার বিজয়ী কিউএসআর প্রযুক্তিতে সেলফ সার্ভিস কিয়স্কে ব্যবহার ও সচল করা হয়েছে, যেন গ্রাহকেরা তাদের অর্ডারিং অভিজ্ঞতার ‘মালিকানা’ পেতে পারেন। খাবারের মেনু কাস্টমাইজ এবং নিরামিষ অর্ডার করা কিয়স্কের মাধ্যমে সহজ হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া এই পরিষেবায় রয়েছে একাধিক বিকল্প ভাষা, এমনকি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যবহারকারীদের আইনসম্মত বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমে মেনুতে নেভিগেট করার অনুমতি। মোটকথা, গ্রাহকদের কী প্রয়োজন, তা জানা এবং সেই অনুসারে দুর্দান্ত সেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন উদ্যোগ পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে টাকো বেল সদা প্রস্তুত।
তার ওপর ব্যবহারকারীদের আরও নির্বিঘ্ন অর্ডারিং অভিজ্ঞতা দিতে ওয়েবসাইট পুনরায় চালু করেছে টাকো বেল। গ্রাহকেরা এখন দ্রুত অর্ডারের ক্ষেত্রে চাহিদামতো পণ্যের অনুসন্ধান খুব সহজে চালাতে পারছেন। এ ছাড়া যাদের বিশেষ খাদ্যের চাহিদা রয়েছে, তাদের জন্য উপাদানসংবলিত তথ্যে সাজানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নিউট্রিশন ক্যালেন্ডার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো টাকো বেলের ওয়েবসাইট (এবং মোবাইল অ্যাপ) গ্রাহকদের সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকার জটিলতা দূর করে, টার্গেট কাস্টমার মিলেনিয়ালদের জন্য হাজির করে দারুণ অভিজ্ঞতা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর
টাকো বেলের প্রধান টার্গেট ভোক্তারা প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। মিলেনিয়াল প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর সময় ব্যয় করে। তাই টাকো বেল কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের কাছে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। ইনফ্লুয়েন্সারদের পাশাপাশি ভোক্তারাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের ব্র্যান্ড সচেতনতা বাড়াতে পারবেন, এমনটা আশা করে টাকো বেল। নতুন খাদ্যপণ্য উদ্ভাবনের সময় মেনুর নান্দনিকতাকে সব সময় গুরুত্ব দেয় এই ফুড চেইন। যেন ভোক্তারা খাদ্যপণ্যের ছবি নিজ আগ্রহে তুলে নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন, সেই লক্ষ্যে টাকো বেল তাদের খাবারগুলো যথেষ্ট আকর্ষণীয় কিংবা ‘ইন্সটা-ওয়ার্দি’ করার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে চায়। কেননা, এভাবে ছবিগুলো গ্রাহকদের ফলোয়ারদের কাছে পৌঁছে যাবে এবং ডমিনো ইফেক্টের মাধ্যমে আরও বেশি মানুষ তাদের পণ্যের প্রতি হবে আকৃষ্ট।
টাকো বেলের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো বেশ কিছু উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। গ্রাহকদের অভিযোগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে এক্স অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করা হয় নিবিড়ভাবে। নতুন মেনু সম্পর্কে গ্রাহকদের অগ্রিম ধারণা দিতে জোর দেওয়া হয় স্ন্যাপচ্যাটে। খাবারবিষয়ক পোস্ট শৈল্পিকভাবে প্রকাশের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে সাহায্য নেয় ইনস্টাগ্রামের। এককথায়, টাকো বেল তার ব্র্যান্ডের বিকাশ ঘটাতে এবং প্রভাব ধরে রাখতে সোশ্যাল মিডিয়া ক্রেজকে দারুণভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
মোবাইল রেস্তোরাঁ
করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে প্রায় সবকিছুর মতো টাকো বেলের ব্যবসাও পড়ে গিয়েছিল বিপদে। সেই দুঃসময়ে ড্রাইভ-থ্রু পরিষেবা প্রদানকারী ফাস্ট ফুড চেইনগুলো অন্যদের তুলনায় বেশ দ্রুত পুনরুদ্ধার পেয়েছিল। টাকো বেল টিম খেয়াল করেছিল, পারস্পরিক সরাসরি যোগাযোগ যখন ন্যূনতম হয়ে ওঠে, এমন সংকটকালে বেশির ভাগ ভোক্তাই হাতের নাগালে খাবার পেতে পছন্দ করেন। এ ধরনের ড্রাইভ-থ্রু কিউএসআরের অপারেশন সহজ করে তোলে। টাকো বেল বিশেষ করে সম্প্রতি ড্রাইভ-থ্রু ব্যবসার গুরুত্ব মেনে নিয়ে নতুন উদ্যোগ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেটি টাকো বেল গো মোবাইল নামে পরিচিত।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে, গ্রাহকদের চাহিদা পূরণের প্রত্যাশা অতিক্রম করেও থেমে থাকেনি টাকো বেল; প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে নতুন রোমাঞ্চ সঙ্গী করে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট