স্বাদশেকড় I নিত্য নিহারি
দারুণ সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার। নেহারিও বলে কেউ কেউ। ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঢুঁ মেরে জানা যাক এর আদ্যোপান্ত
ভারতীয় রন্ধনপ্রণালিতে মোগলদের অবদান এই উপমহাদেশের রন্ধনসম্পর্কীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাইলফলকগুলোর অন্যতম। তাদের শাসনকালে বিশেষত আওয়াধি (লক্ষেèৗ) ও দিল্লি বেশ কিছু সেরা রন্ধনপ্রণালির সাক্ষী হয়েছিল। এমন একটি মুখরোচক খাবার নিহারি। মোগল আমলের খাবারদাবার বললেই চোখের সামনে ভাসতে থাকে সুস্বাদু এই খাদ্যবিশেষ। একে তো মসলা, তার ওপর তেল-ঝাল, আর যায় কোথায়! যুগ যুগ ধরে দুনিয়াব্যাপী এ খাবার জয় করে চলেছে ভোজনরসিকদের মন। সাম্রাজ্য শেষ হওয়ার এত বছর পরেও, মোগল নবাবদের শানদার ইতিহাসের যেটি আমরা বেশি স্মরণ করি, তা সম্ভবত খাবার। নিহারির নাম শুনে জিভে পানি আসার আগে ইতিহাসে একবার ঢুঁ মারা যাক।
নিহারি একটি স্টু-ভিত্তিক খাবার। অস্থিমজ্জাসহ ধীরে ধীরে রান্না করা মাংসে তৈরি। খামেরি রুটির সঙ্গে নল্লি নিহারি পুরোনো দিল্লির সবচেয়ে প্রিয় ঐতিহ্যবাহী ব্রেকফাস্ট। এই উপমহাদেশে মোগলদের আগমন ১৩৯৮ সালে, তৈমুর লংয়ের হাত ধরে। এর অনেক পর এখানে পাকা ঘর প্রথম বাঁধেন সম্রাট বাবর (১৪৮৩-১৫৩০)। তবে নিহারির উৎপত্তি সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ইতিহাসবিদদের দাবি, খাবারটির প্রথম বিকাশ ঘটেছিল পুরোনো দিল্লিতে। কারও কারও মত, এটি ছিল আওয়াধির সেরা খানসামাদের তৈরি, যা প্রাচীন দিল্লির রান্নাঘরে লাভ করে চূড়ান্ত রূপ। এ নিয়ে ঘটি-বাঙালের ঠোকাঠুকি চলে হরদম! তবে এটি লক্ষেèৗ, হায়দরাবাদ, দিল্লি ও কলকাতায় ব্যাপক জনপ্রিয়। কলকাতায় ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা ডালপুরি দিয়ে নিহারি খেতেন। তবে সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায় এটি একটি স্পেশাল তন্দুরি রুটি বা কুলচা দিয়ে খেতে পছন্দ করে। নিহারিকে ইন্দো-পারসিয়ান প্রভাবের একটি খাবার বলেন অনেকে, যা মোগলদের হাত ধরে এখানে এসেছিল বলে মনে করা হয়।
দিল্লিভিত্তিক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, লেখক ও আন্দোলনকর্মী সাদিয়া দেহলভি বলেছেন, ‘যদিও সালতানাতের সময় থেকে দিল্লি একটি হৃদয়গ্রাহী খাবার (নিহারি) উপভোগ করেছে, তবে মোগলদের আমলে এসেছে এর পরিমার্জন। মোগলাই সমৃদ্ধ পারসিয়ান স্বাদের সঙ্গে ভারতীয় স্বাদের সংমিশ্রণে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে খাবারটি। এই সময়ে দিল্লির রন্ধনপ্রণালি সত্যিকার অর্থে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রন্ধনশৈলী হিসেবে আবির্ভূত হতে শুরু করে।’
দিল্লি প্যাভিলিয়নের এক্সিকিউটিভ সু-শেফ কুশা মাথুর জানালেন, কীভাবে আওয়াধির নিহারির বিস্তার দিল্লি থেকে একেবারে আলাদা। তার ভাষ্য, ‘এই পার্থক্য মূলত উপাদান ও মসলাসম্পর্কিত। দিল্লির আমিষভোজীদের খাবারে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। যেমন ধরুন, দিল্লির নিহারি আওয়াধির হালকা ও সামান্য হলুদ রঙের নিহারির তুলনায় বেশি লাল-কমলা। সুতরাং খাবারে অবশ্যই একটি পার্থক্য বিদ্যমান, যেটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এবং বিকশিত হয়েছে; আর দিল্লিতে হয়ে উঠেছে অনন্য।’
‘নিহারি’ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘নাহার’ থেকে, যার অর্থ ‘সকাল’। এটি মূলত মোগল সাম্রাজ্যের নবাবেরা ফজরের নামাজের পর প্রাতরাশের আইটেম হিসেবে রাখতেন। প্রাতরাশের পর জোহরের নামাজের আগপর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস ছিল তাদের। নিহারি খাওয়ার ফলে পেট যেমন ভরা থাকত, মনও থাকত ফুরফুরে! কয়েক বছরের মধ্যেই খাবারটি জনসাধারণ ও মোগল সেনাদের প্রিয় হয়ে ওঠে। দিল্লির শীতের সকালে শক্তিবর্ধক বৈশিষ্ট্যের এই খাবার পায় ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। নিহারির বিশেষত্ব হলো এর মসলা, যাকে গুঁড়া বা কোটি মসলা বলে। ঐতিহ্যগতভাবে, ছয় থেকে আট ঘণ্টা ধরে এ খাবার প্রস্তুত করা হতো মোগল দুর্গ ও প্রাসাদ নির্মাণে জড়িত শ্রমিকদের জন্য। তাদেরকে বিনা মূল্যেই দেওয়া হতো সকালের প্রথম খাবার হিসেবে। সহসাই প্রাচীন দিল্লির কিছু রেস্তোরাঁয় এক আকর্ষণীয় চর্চা শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিনের অবশিষ্ট নিহারি থেকে কয়েক কেজি পরের দিনের পাত্রে যোগ করা হয়। নিহারির এই পুনর্ব্যবহৃত অংশকে বলা হয় ‘তার’। সদ্য রান্না করা নিহারিতে একটি অনন্য ও সমৃদ্ধ মসলাদার স্বাদ যোগ করতে এটি পরিচিত। দিল্লিতে এখনো কিছু নিহারি আউটলেট রয়েছে, যেখানে ‘তার’ নিয়ে বেশ গর্ব করা হয়। এই চর্চা চলে আসছে এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে। অন্যদিকে, প্রাচীর ঘেরা শহরের নামকরা হাকিমেরা সাধারণ সর্দি ও জ্বরের ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবেও নিহারি ব্যবহার করতেন।
পাকিস্তানের রন্ধনশৈলীর একটি বিশাল অংশও হয়ে রয়েছে নিহারি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যখন দিল্লিভিত্তিক মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নতুন গঠিত পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়, নিহারিকেও সঙ্গী করে তারা। দেশটির প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁয় মেলে নল্লি নেহারি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে যাত্রা শুরু করে এই পদ বর্তমানে পাকিস্তানের জাতীয় খাবারের মর্যাদা পেয়েছে।
বাংলাদেশের কিছু অংশে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নিহারি একটি জনপ্রিয় খাবার। বাটারি ও মসলাদার নিহারি রান্না করা হয় ধীরে ধীরে; এ সময়ে মাংস সম্পূর্ণ গলে, স্টুর টেক্সচারের সঙ্গে মিশে যায়। এই খাবারের ওপরের অংশে অনেক সময় জুড়ে দেওয়া হয় ভেজা আদা, কাটা ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ ও ঘি। এটি মূলত গরু, মেষশাবক, ভেড়া কিংবা ছাগলের মাংস, আবার কখনো কখনো মুরগি ও অস্থিমজ্জা দিয়ে রান্না করা হয়। খামেরি রুটি দিয়ে নিহারির স্বাদ সবচেয়ে ভালো উপভোগ করা যায় বলে অনেক ভোজনরসিকের অভিমত। হাজি শরবতি নিহারিওয়ালে এবং কাল্লু নিহারিওয়ালে হলো দিল্লির সবচেয়ে পুরোনো ও জনপ্রিয় নিহারি আউটলেটগুলোর অন্যতম।
২০২২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকাই নিহারি উৎসব। সে বছরের ২৫ আগস্ট পুরান ঢাকার খাজে দেওয়ান সিরাজউদ্দীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনাড়ম্বরপূর্ণ এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষণা কেন্দ্র ‘ঢাকা ফোরাম’ এবং সামাজিক সংগঠন ‘ঢাকাইয়া ঐক্য’ ছিল এর আয়োজক।
বাংলাদেশে গনি চাচার নিহারি দেশখ্যাত। প্রায় ৪০ বছর ধরে বগুড়ার বনানীর সুলতানগঞ্জ হাটে নিহারি বিক্রি করছেন আব্দুল গনি। শুরুর দিকে তিনি এক পিস নিহারি বিক্রি করতেন দুই টাকায়। এখন দাম দাঁড়িয়েছে ১৮০ টাকায়। বর্তমানে আব্দুল গনির দোকানে দিনে ১৫০ কেজি নিহারি, ৪০ কেজি বট, ২৫ কেজি চালের ও ১৮ কেজি আটার রুটি বিক্রি হয়। প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার এসব খাদ্য বিক্রি করেন তিনি। আব্দুল গনির এই নিহারি খেতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, শেরপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, গাইবান্ধা, দিনাজপুর থেকেও লোকজন আসে। গনি চাচার নিহারির স্বাদ নিতে চাইলে আপনাকে প্রথমেই আসতে হবে বগুড়ায়। এরপর সেখানকার সাতমাথা থেকে অটোরিকশা নিয়ে আসতে হবে বনানীর হাটে। আপনি যদি নিজেকে সত্যিকারের নিহারিপ্রেমী দাবি করেন, তাহলে অন্তত একবার তা পরখ করে দেখার সুযোগ হেলায় হারাবেন না যেন!
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট