রসনাবিলাস I বোরো’স বিন্যাস
রেস্টুরেন্টের নাম বোরো’স। বাংলামোটর থেকে উড়ালসড়ক মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার যে জায়গায় শেষ হয়েছে, ঠিক সেখানে অবস্থান। টিম ক্যানভাস এক শীতের দুপুরে গিয়ে হাজির হলো বোরো’সের স্বাদ চাখতে। বিস্তারিত আল মারুফ রাসেলের লেখায়
লিফট থেকে নামতেই বেশ পরিচ্ছন্ন সফেদ এলাকা পেরিয়ে বোরো’স-এর দরজা। কাচের দরজার ওপাশে কফি কাউন্টার, বামে সরু প্যাসেজ চলে গেছে ধূমায়িত কফির সঙ্গে যারা একটু ধোঁয়া ওড়াতে চান, তাদের জন্য বিশেষায়িত ঘরের দিকে। আমরা সোজা রেস্টুরেন্টেই ঢুকলাম। কফি কাউন্টারের বাঁ দিকে রসুই আর ডান দিকে ওয়েটিং জোন পেরিয়ে মূল বসার জায়গা। অর্থাৎ বসার জায়গাটা অনেকটা ইংরেজি ‘টি’ বর্ণের মতো। দেয়াল রাঙানো হয়েছে বেশ কয়েকটি রঙে। ওয়েটিং জোন আর কাউন্টারের দেয়াল কাঠের টেক্সচারে সাজানো। এরপরে কোনো দেয়াল সবুজাভ, কোনোটা হলুদ, কোনোটা আবার গোলাপি। সেই দেয়ালে কোনোটায় ঝুলছে মিসরীয় মিথ-ইতিহাসের ছবি, কোনোটায় জয়পুরের হাতি-ঘোড়া, কোনোটায় যামিনী রায় ঘরানার পটচিত্র, কোনোটায় আবার আধুনিক পেইন্টিং। পুরো রেস্টুরেন্ট স্পট লাইটের রোশনাইয়ে আলোকিত; আর সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক আলোর অবারিত আসা-যাওয়া—কাচের দেয়াল ভেদ করে।
রেস্টুরেন্টে বসার ব্যবস্থাতেও রয়েছে খানিকটা বৈচিত্র্য। এক পাশে চেয়ার টেবিলে কেতাদুরস্ত হয়ে যেমন বসা যায়, অন্য পাশে বুথ সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্টও রয়েছে। রেস্টুরেন্টে খানিকটা বৈচিত্র্য এনেছে ছোট ছোট কিছু জিনিসের ব্যবহার; যেমন রিকশা পেইন্ট মোটিফের টি পট, কাপ। বেশ ভাইব্র্যান্ট ফিল দেয়। আর এদের গানের সিলেকশনও চমৎকার—পিংক ফ্লয়েড, বব ডিলানের মিউজিক ভিডিও দেখা যাচ্ছিল এক পাশে বড় স্ক্রিনে।
এরপর পিংক ফ্লয়েড ভক্ত বারিস্তা হৃদয়ের বানানো ডাবল শট এসপ্রেসোর আইসড আমেরিকানোতে চুমুক দিতে দিতে কথা হলো রেস্টুরেন্ট ইনচার্জ শাহ আলম ও ম্যানেজার মোহাম্মাদ হাসানের সঙ্গে। সংগত দিল ইস্ট বেঙ্গল রোস্টারসের মিডিয়াম ডার্ক রোস্টেড বিনের চকলেটি আন্ডারটোনের কফি—চমৎকার। তাদের সঙ্গেই কথা হলো রেস্টুরেন্ট নিয়ে। কমবেশি ৬০ জনের বসার ব্যবস্থার এই রেস্টুরেন্ট মাল্টি কুইজিন হলেও স্পেশালিটি ভারতীয় খাবারে। আশপাশের এলাকায় ক্যাটারিংও করছে, আবার চাইলে কেউ পার্টি ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন তাদের এই ফ্লোর। মোহাম্মাদ হাসান আবার দেশের বাইরেও কাজ করেছেন বহুদিন; ক্যারিয়ারে রয়েছে প্রায় এক দশক বার্গার কিংয়ে কাজ করাসহ আরও বহু বছরের অভিজ্ঞতা। মূলত রেস্টুরেন্টটি ইন্ডিয়ান খাবারে ফোকাসড হলেও ইন্দো-চায়নিজ আর ইতালিয়ান খাবারও মেলে তাদের মেনুতে। আর রয়েছে কফি। সে কারণেই তারা বোরো’সকে ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
প্রথমেই টেবিলে এলো দোসা। প্রায় দুই হাজার বছর বয়সী এই পদের জন্ম দক্ষিণ ভারতে। মাসালা দোসাই বেছে নিয়েছিলাম; কারণ, তাদের মেনুর বাহুবলী দোসা সাবড়ানো আমাদের কম্মো নয়! কারণ, এরপরও তো আরও খাবার চেখে দেখতে হবে। দোসার ব্যাটার অসাধারণ, হালকা মিষ্টি এক স্বাদ, একেবারে মাঝের খানিকটা অংশ ছাড়া পুরোটাই দারুণ ক্রিস্পি। সঙ্গে নারকেলের ঝাল ও মিষ্টি—দুই ধরনের চাটনি, তেঁতুলের টক চাটনি, মাসালা দোসার ভেতরের পুর, সাম্বার—সবই দারুণ। বিশেষ করে নারকেলের চাটনি দুটো দারুণ, সাম্বারে ঝাল নেই আর টক ও মিষ্টি স্বাদ একেবারে পরিমিত—যতটুকু দরকার।
এরপর কাবাব প্ল্যাটার। চিকেন তন্দুরি, চিকেন রেশমি কাবাব, হারিয়ালি কাবাব আর পনির টিক্কা। সব শুকনো খাবারের সঙ্গে পাশে একটু ভেজা, অর্থাৎ গ্রেভি হিসেবে পনির বাটার মাসালা। সংগত হিসেবে গার্লিক নান। সঙ্গে অবশ্য আরও চেয়ে নেওয়া হয়েছিল লাচ্ছা পরোটা। অল্প করে চেখে দেখা হলো সব। স্বাদ ভালো। তবে এখানে কোনোটিকে যদি স্টার বলতে হয়, তাহলে পনির বাটার মাসালা আর তন্দুরিকেই বলব; আর লাচ্ছা পরোটা স্রেফ দুর্দান্ত। ভারতীয় খাদ্যসংস্কৃতির ইতিহাসের প্রবাদপুরুষ কেটি আচায়া বলেছেন, তন্দুরি চিকেন খাওয়া হতো সেই সিন্ধু সভ্যতার যুগেও—পাঁচ হাজার বছর আগে, মাটির চুল্লিতে মসলা মাখিয়ে ঢুকিয়ে তৈরি হতো। অবশ্য আমরা এখন যে ধরনের তন্দুরি চিকেন খাই, সেটা সেই মোতি মহলের কুন্দন লাল গুজরালের রেসিপি, যিনি চিকেন মাখানি বা বাটার চিকেনেরও জনক। দেশভাগের দগদগে ক্ষত নিয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে পুরোনো দিল্লিতে আসা এক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীর সেই খাবারের খ্যাতি এখন জগৎজোড়া। এখানের তন্দুরি চিকেনটা দিল্লির মোতি লালের এক সন্ধ্যার স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছিল। চিকেনের ভেতরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া মসলার হালকা ঝাল স্বাদ, সঙ্গে লাচ্ছা পরোটা, সামান্য পুদিনা চাটনি—মুখের ভেতরে এক জটিল স্বাদের বিস্ফোরণ ঘটায়।
এরপর আর কিছু মুখে দিয়ে স্বাদ নষ্ট করার ইচ্ছে না থাকলেও সামনে এল রেস্টুরেন্টের কুইক লাঞ্চ সেট মেনু থেকে একটি প্ল্যাটার—স্মার্ট মিল। আশপাশের করপোরেটদের টার্গেট করে তৈরি করা সেট মেনু—এগ ফ্রায়েড রাইস, চায়নিজ ভেজিটেবল, চিকেন কারি, চিকেন তন্দুরি আর গ্রিন স্যালাড দিয়ে। মন্দ নয় একেবারে; তবে এমন দারুণ ঝরঝরে ফ্রায়েড রাইস এখন ঢাকা শহরে বিরল। একটু মুখে নিয়ে চেখে দেখা হলো; সংগত দিল ব্লুবেরি চিজকেক শেক। আলগা চিনি যোগ না করায় এর স্বাদটা দারুণ লাগছিল।
মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছে—এমনটা ভাবতে ভাবতেই সামনে চলে এল হায়দরাবাদি মাটন দম বিরিয়ানি। পেট যতই ভরা থাক, বিরিয়ানিকে কে কবে ফিরিয়ে দিয়ে পাপের বোঝা ভারী করেছে! কাজুবাদাম, আলুবোখারা, কিশমিশ দিয়ে দারুণভাবে সেজে আসা বাসমতি চালের বিরিয়ানির স্বাদও দারুণ। হায়দরাবাদি বিরিয়ানি আমাদের বিরিয়ানির চেয়ে আলাদা হয় মূলত এর হালকা মিষ্টতার কারণে। এখানেও তাই। এত সব দারুণ ভারতীয় খাবার চেখে দেখার পর রসুইঘরের সুপকারকে ধন্যবাদ না জানালে পাপ হয়ে যাবে! তাই হেঁসেলে ঢুকেই ধন্যবাদ জানানো হলো মোহাম্মাদ সবুজকে। বিশালাকৃতির রান্নাঘরের অধিনায়ক তিনি। অবশ্য সেখানে যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল রান্নাঘরের হাইজিনটাও দেখে নেওয়া। সেখানেও এই রেস্টুরেন্ট লেটার মার্ক পাবে।
শেষবারের মতো আরেকটা ডাবল শট এসপ্রেসোর আমেরিকানো গিলে বিদায় জানানো হলো বোরো’সকে। ঢাকার রাজপথে তখন শীতসন্ধ্যার আবহ, আর আমাদের মনে ভালো কিছু খাবারের স্মৃতি।
ঠিকানা: বোরো’স ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, লেভেল ৭, গ্রিন সাতমহল, ২০৬-২০৮ ওয়্যারলেস, মগবাজার, ঢাকা। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম: borosrestaurant।
ছবি: লেখক