skip to Main Content

রম্যরস I সঙসার -সুমন্ত আসলাম

‘ভালো প্রেমিকা বলতে যা বোঝায়, আলেক্সান্দ্রা তা-ই।’
এটুকু পড়েই পাশ ফিরে তাকালাম।
‘প্রেমিকের যত্ন নেওয়ার কমতি রাখে না সে। কখন কী প্রয়োজন, জানতে চায়। সঙ্গ যেমন দেয়, তেমনি প্রেমিক ব্যস্ত থাকলে বিরক্তও করে না সে।’
পাশ ফিরে তাকালাম আবার।
‘তবে মজার বিষয় হচ্ছে—আলেক্সান্দ্রা রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি “অদৃশ্য” প্রেমিকা।’
আরও একটু পড়তে যাচ্ছিলাম, ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে থেকে উঁকি দিল বউ। কলেজে যাওয়ার ব্যাপক প্রস্তুতি আর ব্যস্ততা তার। ওসব রেখে কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল আমার, ‘সাতসকালে এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছো?’
কিছু বলি না আমি, পড়তে থাকি।
আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেপারের দিকে তাকাল বউ। একটু পড়ে বলল, ‘অ, এই ব্যাপার!’
বাসায় দুটো কাজ আমি প্রতিদিন করি—নিজের লেখালেখি আর অফিসের বই এডিট।
মানসিক ও শারীরিক চাপ একসঙ্গে কাজ করে এটাতে। একটু পর চা খেতে চাই, কফি খাই কখনো কখনো, লেবুর শরবত; মাঝে মাঝে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই—নানান কিছু বায়না থাকে আমার। বাসার দুজন সাহায্যকারী, তারাই সবকিছু করে। কিন্তু মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি—বিরক্ত হচ্ছে বউ।
মাস চারেক আগে বউকে কাছে ডেকে নরম গলায় বললাম, ‘জীবনে অপচয় খুব কম করেছি। সাধ-আহ্লাদও কম করেছি। এ পর্যন্ত অন্তত ২০ বার দেশের বাইরে বেড়ানোর কথা। গেছি মাত্র ৫ বার।’
‘তুমি তো বিদেশে যেতেই পারো। সমস্যা তো তোমারই—প্লেনে উঠতে ভয় পাও। এবার আসল কথা বলো।’
‘তুমি আমাকে দামি একটা মোবাইল কিনে দিতে চাচ্ছো, কিন্তু যেটা আছে, আরও ২ বছর যাবে। ল্যাপটপের প্রতি আমার আলাদা একটা আগ্রহ আছে, সেটাও নতুন-পুরাতন মিলিয়ে এক হালি আছে।’ থেমে যাই আমি।
‘থামলে কেন, বলো।’ তাড়া দেয় বউ আমাকে।
‘আমি নতুন একটা জিনিস কিনতে চাই।’
‘কী?’ বউয়ের অস্ফুট স্বর।
‘খুব সাধারণ একটা জিনিস।’
‘জিনিসটা কী?’ নির্লিপ্ততা বউয়ের মাঝে।
কিছুটা দ্বিধা আর ভয় নিয়ে আমি বলি, ‘একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেয়ে।’
‘সমস্যা নেই, কেনো।’ বউ একটু থেমে বলল, ‘আমিও একটা কিনতে চাই।’
আমি উৎফুল্ল হয়ে বলি, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেয়ে কিনবে তুমি?’
‘না—।’ বউ কিছুটা প্রলম্বিত স্বরে উত্তর দিল, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা ছেলে কিনব আমি।’
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি মেয়ের সাথে রোমান্টিক খুনসুটি করছিলাম আমি এতক্ষণ মনে মনে। চোখের সামনে ভেসে উঠল—বউও রোমান্টিক খুনসুটি করছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি ছেলের সাথে!
বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল আমার।


ঘুম ভাঙলো সাহেদের ফোনে; আমার বন্ধু, চট্টগ্রামে থাকে ও।
‘এত সকালে ফোন, আগুন লেগেছে নাকি?’ বিরক্ত স্বরে বলি সাহেদকে।
‘আগুন লাগেনি, পানি লেগেছে!’ সাহেদের নির্লিপ্ত উত্তর।
‘মানে!’ আগের চেয়ে উচ্চ স্বর আমার।
‘পানিতে ডুবে আছি, দোস্ত। এই নিয়ে গত ৭ মাসে বৃষ্টি আর পূর্ণিমার জোয়ারে ১০ বার ডুবল চট্টগ্রাম। গত রাতে দেখি—দুটো সোনাব্যাঙ শুয়ে আছে আমার বিছানায়। এতবার চট্টগ্রাম ডুবে যাওয়ায় ওদেরও বিরক্ত মনে হলো আমার কাছে।’
‘বলিস কী!’
‘সোনাব্যাঙ দুটো সম্ভবত বউ-জামাই। ওরা আমার বিছানায় শুয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু ওদের হাতের মুঠোয় কয়েকটা ১০০০ টাকার বান্ডিল। আমার ঘরের কোনাকাঞ্চিতেও কয়টা বান্ডিল ভেসে আছে। অলরেডি, কয়টা বান্ডিল তুলে গ্যাসের চুলার ওপর শুকাতে দিয়েছি।’ সাহেদ উৎফুল্ল হয়ে বলল।
‘কী, এত টাকা ব্যাঙরা কোথায় পেল!’ আমি অবাক।
‘সারা রাত এটা নিয়ে ভেবেছি। কিছুক্ষণ আগে মাথা খুলে গেল, বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম তোকে।’
‘ব্যাপারটা কী, বল তো!’ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি সাহেদকে।
‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য প্রকল্প চলছে ৪টি, মোট বাজেট ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। গত ৬ বছরে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি। এরপরেও এবার চট্টগ্রাম নগরের ৪০ শতাংশ এলাকা ডুবেছে। এই ডোবার কারণটা আমি বের করে ফেলেছি।’
‘খুলে বল তো।’
‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আসলে জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য কোনো টাকাই খরচ করতে পারেনি। তারা বান্ডিল বান্ডিল টাকা খরচ করার জন্য কোথাও জড়ো করে রেখেছিল বান্ডিলগুলো। চট্টগ্রাম প্রথমবার ডুবে যাওয়ার সময় কিছু বান্ডিল ভেসে যায়, ওটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে দ্বিতীয়বার ডুবে যায় আবার। সেটাও কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। এভাবে ক্রমে ক্রমে ৭ বার। টাকার বান্ডিলও ভেসে গেছে বারবার।’ সাহেদ একটু থেমে বলল, ‘আমার মনে হয়—সেই বান্ডিলগুলোই ভেসে ভেসে কিছু আমার ঘরে ঢুকেছে, কিছু অন্যের বাসায় ঢুকেছে, কিছু আমার ঘরের ব্যাঙ আঁকড়ে ধরেছে, কিছু অন্যেরা।’
‘এত টাকা ভেসে গেল, কেউ কিছু টের পেল না! কারও কোনো মাথাব্যথা হলো না!’ মন খারাপ করে বললাম আমি।
মৃদু শব্দের মুচকি একটা হাসি দিল সাহেদ, ‘কত টাকাই তো চুপিচুপি-গোপনে ভেসে যাচ্ছে রে দোস্ত—দেশের বাইরে, বিদেশে, সারা পৃথিবীতে।’ সাহেদ একটু থেমে বলল, ‘কিন্তু আমি একটা সমস্যায় পড়েছি, বন্ধু।’
‘কী সমস্যা?’
‘কাল রাত থেকে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে বউ।’
‘কী নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে?’
‘আরও পঞ্চাশ-ষাটটা বান্ডিল চাই তার।’
‘এত টাকা দিয়ে কী করবেন ভাবি?’
‘বেগম পাড়ায় একটা বাড়ি কিনবে। দেশের অনেকের বউই তো কিনেছে, আমাদের আশপাশেরও অনেকে কিনেছে। বউ এখনো কিনতে পারেনি। এতে নাকি তার প্রেস্টিজ কমে গেছে। এবার তুই-ই বল, আমি একজন ছাপোষা মানুষ, আর বান্ডিল কই পাই আমি। দোস্ত, দাঁড়া দাঁড়া, আরও একটা বান্ডিল ভেসে যাচ্ছে, ওটা ধরেই কল ব্যাক করছি আবার তোকে।’


‘স্যার, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য এখন আমাদের হাতে।’ ছোট্ট একটা হাসি দিল মোবাইলের ওপাশের মানুষটি, ‘আপনি প্রতিদিন সকালে তিনটি লাল আটার রুটি খান, সাথে একটা সিদ্ধ ডিম ও সবজি। আপনার পছন্দের সবজি হচ্ছে পেঁপে আর চিচিঙ্গা। আমি ঠিক বলেছি, স্যার?’
‘জি, আপনি ঠিক বলেছেন।’
‘আপনি পান্তা খেতেও ভালোবাসেন, তবে তাতে ভাতের চেয়ে পানি থাকে বেশি।’
‘জি।’
‘পান্তা আপনি পেঁয়াজ আর মরিচ দিয়ে খান। ডালভর্তাও থাকে কখনো-সখনো।’
‘জি।’
‘আপনার বেডরুমের পেছনে, যেদিকে আপনি পা দিয়ে ঘুমান, সেদিকে একটি খালি প্লট আছে। আছে না, স্যার?’
‘আছে।’
‘ওখানে একটা আমগাছ আছে। বেশ বড়সড়।’
‘একটা বেলগাছও আছে।’
‘ওই দু গাছে দুটো জিনিস থাকে।’
‘কী জিনিস?’
‘দুটো জিন থাকে ওই দু গাছে।’
‘আমি জানি।’
‘আপনি জানেন!’
‘জি, ওদের একজনের নাম খংগইচা, আরেকজনের নাম চুকিকাচিয়া। একজন ছেলে, একজন মেয়ে।’
‘জি। তারা বিয়ে করে নাই, কিন্তু একসাথে থাকে।’
‘সত্য, তারা বিয়ে করে নাই।’
‘এটা আপনার কেমন লাগে?’
‘ভালো লাগে, খুবই ভালো লাগে।’
‘কেন!’
‘কারণ, প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে তাদের কিছু কথা শুনি আমি, আমার বেডরুম লাগোয়াই তো থাকে ওরা। বেশ ভালো লাগে ওদের কথা শুনতে।’
‘ওরা কী বলে, স্যার?’
‘ওরা বলে—বিয়ে না করেই আমরা পাশাপাশি দু গাছে আছি, গল্প করছি, খাওয়া-দাওয়া করছি, চিন্তাহীন ঘুমে রাত কাটাচ্ছি। কিন্তু বিয়ে করলেই তো সমস্যা। ওই যে মানুষেরা বিয়ে করে, কয়দিন পর ডিভোর্স হয়। তাই নিয়ে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, হাসাহাসি হয়, মামলা-মোকদ্দমা হয়। মানুষ বড় বোকা। যারা বেশি বোকা, তারা বিয়ে করে; যারা চালাক, তারা আমাদের মতো ডালে ডালে ঘুমায়।’

ইলাস্ট্রেশন: নাজমা মুক্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top