পাতে পরিমিতি I বদহজম বিপত্তি?
এই ঈদে না চাইলেও খাওয়াদাওয়ায় অনেক সময় বেসামাল হয়ে যেতে হয়! একটু বেশি খেয়ে ফেলা কিংবা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাদ্য গ্রহণের ফলে হজমে দেখা দিতে পারে বিপত্তি। সামলানোর পরামর্শ দিচ্ছেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি
খাবার গ্রহণের পর হজমপ্রক্রিয়া শুরু হয়, যার পরিণামে দেহে পুষ্টি উপাদানের শোষণ ঘটে। আমরা যে খাবারই খাই না কেন, সঠিকভাবে হজম সম্পন্ন না হলে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা। যার একটি হলো বদহজম। প্রত্যেক মানুষেরই ডাইজেস্টিভ সিস্টেম আলাদা। হজম কেন হয় না কিংবা কী কারণে বদহজম হচ্ছে, তার পেছনে থাকতে পারে বিভিন্ন কারণ। যেমন—
যারা সব সময় বাইরের খাবারে অভ্যস্ত, তাদের ক্ষেত্রে অ্যাসিডিটি কিংবা বদহজম হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
খালি পেটে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার গ্রহণের অভ্যাস অনেকের রয়েছে। সকালের সাধারণ নাশতা বাদ দিয়ে অনেক সময় এ ধরনের কোনো খাবারে সূচনা ঘটান দিনের শুরুটার। সে ক্ষেত্রে পেটের নানা সমস্যা থেকে শুরু করে হজমক্ষমতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
অনেক ক্ষেত্রে খালি পেটে থাকলেও বদহজমের ঝুঁকি থাকে। যারা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকেন, তাদের শরীরে অ্যাসিডিটি কিংবা হজমজনিত সমস্যা হতে দেখা যায়।
আমাদের দেহের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই পানি। যাদের সারা দিনে পানি গ্রহণের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম থাকে, তারাও অ্যাসিডিটি কিংবা পেটের নানা সমস্যায় পড়তে পারেন।
আর বদহজম হলে দেখা দিতে পারে এই সমস্যাগুলো—
পেটে ব্যথা;
বমি বমি ভাব হওয়া;
বুকের ওপর চাপ অনুভব করা;
বারবার ঢেকুর তোলা;
ঢেকুরের সঙ্গে অনেক সময় বাজে গন্ধ অনুভব করা;
বারবার মলত্যাগের চাপ সৃষ্টি হওয়া।
বেশির ভাগ মানুষই হজমের নানা সমস্যাকে শুরুতে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। অথচ এ ধরনের সমস্যার কারণে সাধারণ জীবনযাপনও অনেক সময় বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আর খাবার গ্রহণের পরে বদহজম হওয়ার ফলে দেহে পুষ্টি উপাদান শোষণও সম্পূর্ণরূপে করা সম্ভব হয় না। তাই যাদের বারবার বদহজম বা পেটের গন্ডগোল হওয়ার সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য ডায়েটারি মডিফিকেশন অত্যন্ত জরুরি। বদহজম থেকে মুক্তি পেতে গ্রহণ করা চাই সহজপাচ্য খাবার। খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন এই দুই ধরনের সবজি—
লাউ: পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় স্বর্গীয় সবজি হিসেবে অভিহিত করা হয় একে। লাউয়ে রয়েছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফোলেট ও আয়রন। আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি এবং সি। লাউ খেলে দূর হয় পেটের নানা সমস্যা।
কাঁচা পেঁপে: পাকলে ফল আর কাঁচা থাকলে সবজি হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। যেহেতু কাঁচা ও পাকা—দুভাবেই খাওয়া যায়, তাই বছরজুড়ে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক। বদহজম, কনস্টিপেশন, হৃদ্পিণ্ডের জটিলতা, কোলনের সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের আলসার ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে রক্ষা পেতেও কাঁচা পেঁপের জুড়ি নেই। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, সি এবং ই। এ ছাড়া এটি লো ক্যালরিক এবং ফাইবার সমৃদ্ধ। পেঁপের আঁশ শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। তাই যারা বারবার পেটের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে কষ্টে আছেন, কাঁচা পেঁপে রাখতে পারেন প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায়।
অতিরিক্ত খাবার একসঙ্গে গ্রহণ করলেও অনেক সময় হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা হতে পারে। দেখা দিতে পারে বদহজম। মনে রাখা চাই, সকল খাবার একসঙ্গে নয়, বরং একটু বিরতি দিয়ে খাওয়া শ্রেয়। এ ছাড়া ওভারলোডেড খাবার গ্রহণেও বদহজম হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যদি খেতেই হয়, পছন্দের খাবারের তালিকা তৈরি করে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর গ্রহণ করতে পারেন।
হজমে অসুবিধা হওয়ার ভয়ে অনেকে খাবার গ্রহণ বাদ দিয়ে দেন। অথচ বিভিন্ন ধরনের খাবার বাদ দেওয়ার কারণে ডিফিসিয়েন্সির সমস্যা দেখা দিতে পারে। কেননা, নানা ধরনের খাবারের পুষ্টি উপাদান বিভিন্ন। তাই গণহারে খাদ্য তথা পুষ্টি পরিত্যাগ ভালো সমাধান নয়। তবে যাদের পেটের নানা সমস্যা রয়েছে কিংবা অল্প খাবারেও বদহজম হয়, তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা হতে পারে এ রকম—
সকালের নাশতা
মর্নিং ব্রেকফাস্ট হিসেবে অনেকের পছন্দ ব্রেড বা পরোটা। যাদের পেটের সমস্যা বা বদহজমের অসুবিধা ফিরে ফিরে আসে, তারা সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করলেই মঙ্গল। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে কনস্টিপেশনের কারণেও বদহজম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় সকালের নাশতা হিসেবে রাখতে পারেন ওটস। এটি ইয়োগার্ট, লো ফ্যাট মিল্ক কিংবা অল্প তেলে তৈরি ভেজিটেবিল খিচুড়ি হিসেবে খাওয়া যেতে পারে।
মিড ও ইভনিং স্ন্যাকস
পেটের সমস্যায় যারা ভুগছেন, তাদের একটি কমন অভ্যাস হলো দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা। এতে উপকারের বদলে পেটের গন্ডগোল বা বদহজম আরও বাড়ে। সে ক্ষেত্রে সারা দিনের আহার গ্রহণ শুধু তিনবার নয়, বরং সকালের নাশতা আর দুপুরের আহারের মাঝে হালকা কিছু খাবার রাখা স্বাস্থ্যসম্মত। এ রকম মিড বা ইভনিং স্ন্যাকসে রাখতে পারেন টক দই। পাকা পেঁপে, কলা অথবা বিভিন্ন ফল যোগে মিক্সড ফ্রুটস খাওয়া যেতে পারে টক দই দিয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন ফলের স্মুদি বা জুস গ্রহণে পেট ঠান্ডা থাকবে। রাখতে পারেন সাগু দানা। নরম মিক্সড ফ্রুট আর সাগু দানা যোগে মধ্য সকাল বা বিকেলের স্ন্যাকস—ভিন্ন স্বাদ এনে দেওয়ার পাশাপাশি ফিটনেস ও হজম উভয়ের জন্য উপকারী। এ ছাড়া কর্নফ্লাওয়ার ও টেস্টিং সল্ট ছাড়া তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে ঝটপট ভেজিটেবল স্যুপ।
লাঞ্চ ও ডিনার
বাঙালির প্রধান খাবার মানেই ভাত। এটি পেটে গোলযোগের সমস্যা, বদহজম ইত্যাদির সমাধানে বেশ দারুণ অপশন; অথচ এই ভালো অপশনকে বদহজমের কারণ করে ফেলি আমরা নিজেরাই। ভাত মানেই ভীষণ ঝাল বা স্পাইসি কারি কিংবা ভর্তা দিয়ে খাওয়া? মাছ বা মুরগির মাংস, অতিরিক্ত চর্বিসমৃদ্ধ গরু কিংবা খাসির মাংস, এমনকি সাধারণ সবজিও অত্যধিক ঝাল মসলা দিয়ে তৈরি খাবারে একেক বেলার থালা যেন হয়ে ওঠে আগুন! এতে অ্যাসিডিটি বেড়ে যায় এবং বদহজমের সমস্যাও তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই যাদের পেটের নানাবিধ সমস্যা রয়েছে, তারা দুপুর কিংবা রাতের মেনুতে রাখতে পারেন এগুলো—
মাছ: ওমেগা থ্রি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ মাছের পাতলা ঝোল রাখা যেতে পারে ভাতের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে শোল মাছ, শিং মাছ, রুই মাছ বেশ উপকারী। এ ধরনের মাছ হালকা মসলা দিয়ে রান্না করলে দারুণ সুস্বাদু হয় এবং পেটের সমস্যা দূর করতে কাজে দেয়।
বাচ্চা মুরগির কারি: প্রোটিনের আরেকটি দারুণ উৎস হিসেবে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন চিকেন। তবে ছোট ও বাচ্চা মুরগির মাংস সহজপাচ্য। তাই ছোট মুরগির মাংস অল্প তেল, অল্প ঝাল ও অল্প মসলায় রান্না করে নিলেই সহজপাচ্য ডায়েট তৈরি সম্ভব।
মিক্সড ভেজিটেবল: বদহজম সমস্যার রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের খাবার গ্রহণই কষ্টসাধ্য বলে নির্দিষ্ট একটি সবজি অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ না করে বরং নানাবিধ সবজি একত্রে মিশিয়ে রান্না করলে অনেকটুকু পুষ্টি একসঙ্গে পাওয়া সম্ভব। কেননা, একই সবজি বারবার গ্রহণ করলে শরীর অনেক ভিটামিন ও মিনারেল কম পায়। সে ক্ষেত্রে কাঁচা পেঁপে, লাউ অথবা চালকুমড়া; সঙ্গে চিচিঙ্গা, পটোল, ঝিঙে, অল্প গাজর এবং প্রয়োজনে ঢ্যাঁড়স, বেগুন, কাঁচা কলা, আলু ইত্যাদি একেক দিন একেকভাবে মিশিয়ে বানিয়ে নিতে পারেন মিক্সড ভেজিটেবল। আর তা রাখতে পারেন দুপুর কিংবা রাতের খাবারে, এমনকি সকালের নাশতায়ও।
মনে রাখা চাই, সুস্থ থাকতে হলে কিছু নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলা জরুরি। ডায়েট বা পথ্য নির্বাচন সঠিক হলে রোগ নিরাময় সহজ হয়। মোটকথা, ডিসিপ্লিন লাইফের পাশাপাশি ডায়েট হওয়া প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত। সে ক্ষেত্রে যাদের বদহজম হয়, তারা তো অবশ্যই, একই সঙ্গে যেকোনো মানুষেরই সুস্থ থাকতে নিয়ম-শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করা দরকার। তবে শারীরিক সমস্যা অতিরিক্ত পরিমাণে অনিয়ন্ত্রিত থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হয়ে ডায়েটারি মডিফিকেশন করিয়ে নিতে ভুলবেন না যেন।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট