skip to Main Content

টেকসহি I কনশাস ফুটপ্রিন্ট

কেমন হয় যদি কার্বন ফুটপ্রিন্টের বদলে প্রতি পদক্ষেপে রচিত হয় পৃথিবীর প্রতি প্রেম? এমন সব ফুটওয়্যার; যা শুধু পৃথিবীর জন্য ভালো এমন নয়। হটেস্ট ট্রেন্ডও বটে। জুতার জগতের ভোল পাল্টাতে

শুকতলা ক্ষয়ে যাওয়া নিয়ে গল্প মোটামুটি সবার জানা। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে জুতা ছিঁড়ে যাওয়ার অভিনয় করেছেন বহু শক্তিমান অভিনেতা। কিন্তু সেই পটপরিবর্তন হয়েছে ধীরলয়ে। এখন জুতা আর আগের মতো বহুমূল্য নেই। আবার টিকেও থাকে না অতীতের মতো। অল্পতেই হয়ে যায় ব্যবহারের অনুপযোগী। সেই পালে হাওয়া দিচ্ছে ফাস্ট ফ্যাশন। যার প্রভাব যে ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতেও পড়েছে, সে তো আর অস্বীকারের জো নেই। জমছে বর্জ্যরে পাহাড়। জল, বায়ু, মাটি—এই তিনেরই যথেচ্ছ ক্ষতিসাধন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দূষণের মাত্রা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। পরিবর্তনে সচেতনতার বাণী পরিবেশবিদেরা দিয়েছেন নানা সময়ে। পরিকল্পনা থেকে পরিবর্তন—সবই হচ্ছে নিয়ম মেনে। কিন্তু সেখানে কিছু কর্তব্য সাধারণ মানুষেরও তো আছে।
সাসটেইনেবল ফুটওয়্যার
খটমট নাম, তবে এর অর্থ একেবারেই সহজ। প্রকৃতির প্রতি মায়া আছে এমন উপাদানে তৈরি জুতার কথা বলা হচ্ছে এখানে। তৈরি থেকে ব্যবহার—কোনো অংশেই প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি হুমকি নেই; বরং, নকশা করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে কমে আসে কার্বন ফুটপ্রিন্ট। এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড মেনে সব পণ্য প্রস্তুত করা হয় সেখানে। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে স্টাইলের কী হবে! বেসিকেরও বেসিক হবে জুতা, নাকি হবে একদম খাপছাড়া। উত্তর, এর কোনোটাই নয়। বরং একই সঙ্গে পৃথিবী এবং ব্যবহারকারীকে আরাম দিতে সক্ষম এই জুতা।
শর্ত সত্য
সাসটেইনেবল ফুটওয়্যার হওয়ার জন্য মানতে হবে কয়েকটি শর্ত। উপাদান আর উৎপাদন—দুয়েই থাকতে হবে সচেতন। প্রোডাকশনের প্রতিটি স্টেজই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেখানেই শেষ নয়। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া অবধি সবটাই হতে হবে নিয়ম মেনে। এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় আছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নৈতিকতার চর্চা এবং এমন একটি কাজের জায়গা; যেখানে শ্রমিকেরা তাদের পরিশ্রমের জন্য যথাযথ মূল্যায়ন পাবেন। অমানবিক শ্রমের মাধ্যমে তৈরি জুতা কোনোভাবেই সাসটেইনেবল জুতার ক্যাটাগরিতে আসার যোগ্য নয়।
এ তো গেল নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের দায়িত্ব। ক্রেতার কর্তব্যও কিন্তু একদম কম নয়। সাসটেইনেবল শু কেনার ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। প্রোডাক্টের বিস্তারিত তথ্য এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবে।
উপাদান-উপাখ্যান
পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। যেমন পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন প্লাস্টিক ও টেক্সটাইল। প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যে এগিয়ে থাকবে কর্ক, অরগানিক কটন, হেম্প ও বাঁশ। এগুলো অবশ্যই সার্টিফিকেট প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদিত হতে হবে। জৈবভিত্তিক উপাদানের ক্ষেত্রে মাশরুম থেকে প্রাপ্ত লেদার, আনারসের ফাইবার থেকে তৈরি ফ্যাব্রিক, শেওলা থেকে তৈরি ফোম ব্যবহার করা যেতে পারে। ভেগান বিকল্প যেমন প্ল্যান্ট বেইসড উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে ট্র্যাডিশনাল লেদার এবং পশু থেকে প্রাপ্ত উপাদানের ব্যবহারের প্র্যাকটিস থেকে বেরিয়ে আসা যেতে পারে। রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই রকমের নির্দেশনা পাওয়া যায় বাজার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। সেখানেও ধরণীর ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো কিছু যোগ করাতে বিগ নো। প্রাকৃতিক উপাদানেই আস্থা সর্বাধিক।
প্রমাণপত্র
বি কর্প, ফেয়ার ট্রেড, গ্লোবাল টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ড ফুটওয়্যার ব্র্যান্ডদের পরিবেশগত সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে জানা যায় উৎপাদিত পণ্য ধরণীর প্রতি দায়িত্ব পালনে সচেতন কি না। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় সামাজিক দায়িত্ববোধ কতটুকু। এই সার্টিফিকেশনের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে কোম্পানি এবং তার প্রোডাক্টের বিষয়ে।
নৈতিকতা
জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা চর্চার বাস্তব চিত্রও একটি প্যারামিটার। তাদের ব্যবহার করা শক্তি এবং পানির পরিমাণের হিসাব থাকার পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও গুরুত্বপূর্ণ। সে বিষয়ে জানতে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে লেবেল এবং এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের। বিস্তারিত তথ্য জেনে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে নৈতিকতার প্রশ্নে কোনো আপোস করতে হবে না।
পুনর্ব্যবহার
ফুটওয়্যার ব্র্যান্ডটির পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে কি নেই, সেই বিষয়েও জেনে নেওয়া জরুরি। সার্কুলার ইকোনমির মতো তত্ত্ব যদি গ্রহণ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি, তাহলে পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। এর অংশ হিসেবে ব্যবহারের শেষে জুতা ক্রেতাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। কারণ, প্রিয় জুতা যদি ব্যবহারের পরে আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে দিতে হয়, তাহলে বাকি আর কোনো গুণই ধরণীকে শতভাগ সাহায্য করতে পারবে না। জুতাটি বর্জ্য হিসেবে পৃথিবীতে স্থান দখল করবে। গবেষণামতে, অন্তত হাজার বছর সময় লাগবে সম্পূর্ণরূপে মাটিতে মিশে যেতে।
স্থায়িত্ব
টেকসই তত্ত্ব মেনে তৈরি জুতা দীর্ঘদিন ব্যবহারের উপযোগী। বারবার পরিবর্তন এবং নতুন জুতা কেনার প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। উচ্চ মানসম্পন্ন উপাদান ব্যবহারে দক্ষ শ্রমিকেরা পণ্য উৎপাদন করে বলে অল্পতেই আয়ু ফুরায় না। সাসটেইনেবল ফুটওয়্যার কোম্পানির অন্যতম কর্তব্য এ বিষয়ে তথ্য উল্লেখ করা। কারণ, ক্রেতা যখন জানতে পারেন, তার জুতাটি কত দিন টিকবে, তখন তার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়।
নিষ্ঠুরতার প্রশ্নে বিগ নো
ক্রুয়েলটি ফ্রি ট্যাগ সাসটেইনেবল ফুটওয়্যারের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। পশুর জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ার বিষয়ে ক্রেতাকে নিশ্চিত করার চেষ্টায় বিষয়টি উল্লেখ করেন তারা। লেদার, ফার এবং উলের বিকল্প বর্তমানে ক্রেতাদের কাছে দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রেক্ষাপট: বিশ্ববাজার
ভয়েজ অব ফ্যাশনের মতে ২০২৭ সালের মধ্যে এই পরিবেশপ্রেমী বাজার স্পর্শ করবে ১০ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে ৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন আসবে নন-অ্যাথলেটিক জুতা থেকে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে এ বিষয়ে। জার্মানিতে তৈরি হচ্ছে অ্যাডিডাস এবং পুমার টেকসই জুতা। ফ্রান্সে বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ব্র্যান্ড ভেজা তৈরি করছে সাসটেইনেবল স্নিকারস। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত নাইকি চেষ্টা চালাচ্ছে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সচেতনতা। ইথিওপিয়ান ব্র্যান্ড সোল রেবেলস পুনর্ব্যবহারযোগ্য টায়ার ব্যবহারে দেখিয়েছে মুনশিয়ানা। পর্তুগালে আপসাইক্লিং নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে গেল কয়েক বছর ধরে।
শেষ ছন্দ
বেশির ভাগ ব্যবহারকারীই চান না প্রিয় জুতা জোড়াকে আবর্জনার স্তূপে দেখতে। পুনর্ব্যবহার তাই খুব জরুরি। নয়তো পুরোনো পাদুকার পাহাড় পরিবেশের দফারফা করতে ছাড়বে না। অন্তত এক শ বছর প্রয়োজন হয় এক পাটি জুতা সম্পূর্ণভাবে মাটিতে মিশে যেতে। পুনরুৎপাদন এখানে দিতে পারে সমাধান। ধরণীর প্রতি ভালোবাসা থেকে পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর রাখতে টেকসই তত্ত্ব জরুরি। ক্ষতিপূরণ যেহেতু অসম্ভব, তাই সাবধানতাতেই জয়।

 সারাহ্ দীনা
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top