skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I সৌদিতে সিনেমার মজমা-বিধান রিবেরু

[তৃতীয় কিস্তি] গুগলে আমার দেওয়া ঠিকানা দেখে গাড়ি আমাদের নিয়ে নামাল জারির বুকস্টোরে। দোতলা দোকান। প্রথম তলায় শুধু স্টেশনারি নয়, রয়েছে ইলেকট্রনিক পণ্যও। দোতলার পুরোটাই বই আর বই। পুরো ভবন কম করে হলেও দশ হাজার বর্গফুট হবে। এমাথা থেকে ওমাথা দেখা যায় না, এত বড়। আমি গিয়ে প্রথমে খোঁজ করলাম ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ কোথায়, আর তাতে সিনেমাবিষয়ক বই আছে কি না। আমার সঙ্গে থাকা পাওলাও একই খোঁজ করলেন। মারসেলোও তা-ই। আমরা তিনজনই হতাশ হলাম ওদের ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ দেখে। চার-পাঁচ তাক ইংরেজি বই, তা-ও খুবই বাজার কাটতি এলেবেলে বই। ফিকশনই বেশি। আর সিনেমার বই যা-ও দু-চারটি রয়েছে, সেগুলো আরবিতে লেখা। কাজেই মারসেলো ওর ৯ বছর বয়সী ছেলের জন্য পিজে মাস্কসের বই কিনলেন। আমিও চলে গেলাম বাচ্চাদের অঞ্চলে। মনের বয়সও ৯ ছুঁই ছুঁই। ছোটদের বইয়ের সংগ্রহ দেখে চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। এত এত বই। তা-ও আবার বয়স অনুসারে ভাগ ভাগ করে থরে থরে সাজানো ইংরেজি বই। আমার কোনো অসুবিধাই হলো না মনের জন্য বই খুঁজে বের করতে। প্রথমেই যে বইয়ের ওপর চোখ পড়ল, সেটি ফুটবলার রোনালদোর ওপর একটি পরিচিতিমূলক বই। ছবি আর তথ্য দিয়ে সাজানো। একেবারে মনের উপযোগী। আমি বইটি হাতে নিয়েই জানতে পারলাম, রোনালদো নাকি রিয়াদেই অস্থায়ী নিবাস গড়েছেন। শুধু রোনালদো নন, এই সিরিজের মেসির ওপর বইটিও কিনলাম। আর মনের উছিলায় আমার জন্য কিনলাম চ্যাপলিন, ব্রুস লি, স্ট্যান লি ও হলিউডের ইতিহাস নিয়ে চারটি শিশুতোষ বই। আমি জানি, এগুলো মনের পড়ার সম্ভাবনা কম; তবে আমি যে পড়ব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

রিয়াদের সিটিস্কেপ

বইগুলোর পাশেই দেখি খেলনাপাতি রাখা। একটি ইয়োইয়ো নিয়ে চিন্তা করলাম বড়দের সেকশনে গিয়ে দেখি কিছু নেওয়া যায় কি না। অন্ততপক্ষে একটি আরব্য রজনী তো কিনে নিই স্মৃতিস্মারক হিসেবে। কিন্তু ওদিকে দেখি, সকলে দাঁড়িয়ে আছেন আমার জন্য। বেচারারা বোধ হয় বোর ফিল করছিলেন। আমার আবার বইয়ের দোকানে ঢুকলে ঘড়ি সময় দেওয়া বন্ধ করে দেয়! এ খুব পুরোনো অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। একবার সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে বইয়ের দোকানে ঢুকে আমার স্ত্রীর হার্ট ফেল করার দশা করে দিয়েছিলাম! বিমান ছাড়ার পনেরো মিনিট বাকি, আমার হুঁশ নেই। আমি বই দেখছি দোকানে। পরে আমাকে সে খুঁজে বের করেছে। যাহোক, এ বেলা অবশ্য এদের হৃৎপিণ্ড ঠিকঠাকই ছিল! ওদের তাড়ায় তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসি। ফিরে যাচ্ছি ভেন্যুতে। আন্তোনিওনির ছবি দেখব।
ভেন্যুতে ফিরে লাউঞ্জে ঢুকলাম সবাই। ক্ষুধার্ত অবস্থা। ওখানে ঢুকলেই মোটামুটি খাবার পরিবেশনের ধুম লেগে যায়। সারি বেঁধে খাবার আসতে থাকে। আমরাও গোগ্রাসে গিলতে থাকি। পেট পুরে খেয়ে রাত নয়টায় গিয়ে বসলাম মরুর খোলা আকাশের নিচে। একটু পরপর কনকনে ঠান্ডা হাওয়া কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে গায়ের কোট খুলে মাথায় দিলাম। শুরু হলো ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া সাইকোলজিক্যাল ড্রামা ফিল্ম ‘রেড ডেজার্ট’। ইতালির উত্তরাঞ্চলে এক কারখানার কর্মকর্তার স্ত্রীকে নিয়ে ছবির কাহিনি। দুর্ঘটনার পর সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এরপর হৃদয়ঘটিত সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ধরা দেয়। মানুষের তৈরি কারখানার বর্জ্যরে সঙ্গে মানুষের মনের ভেতর জমে থাকা জঞ্জালের এক সমান্তরাল রেখা আমরা অঙ্কিত হতে দেখি।
এই ছবি দেখতে বসে বেশ মজার অভিজ্ঞতা হলো। ছবি শুরুর দশ মিনিট পরেই হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো ঠান্ডা পানির বোতল আর গরম খইভাজার বিশাল ঠোঙা। এই পপকর্ন দুজন মিলে খেলেও দেড় ঘণ্টায় শেষ করা মুশকিল! যাহোক, খেতে খেতে সিনেমা দেখছি। ওমা, যেখানেই অন্তরঙ্গ ও চুম্বনদৃশ্য, সেখানে কালো স্ক্রিন! দৃশ্যকর্তন। আমরা প্রথম কয়েক সেকেন্ড একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম; বিশেষ করে ইউরোপীয়রা। পরে আমাদের সকলেরই বোধোদয় হলো, এটি সৌদি আরব। যদিও সেই লেট নাইট শোতে অনেক বোরকা পরা নারীকে আমি দেখেছি, যারা দল বেঁধে এসেছেন সিনেমা দেখার জন্য। তারা এখন নিজেরাই গাড়ি চালিয়ে চলে যেতে পারেন যেকোনো জায়গায়। এর জন্য তাদের কারও অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না।

তাহিনিতে ডুবিয়ে খেজুর খাওয়ার চল রয়েছে সৌদিতে

সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। কিন্তু ২০১৭ সালে বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল-আজিজ আল সৌদের এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে ২০১৮ সাল থেকে সৌদি নারীরা গাড়ি চালাতে পারেন। নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ আসলে নেওয়া হয়েছে বাদশাহ সালমানের সপ্তম পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদের কারণেই। ২০১৭ সালে ক্রাউন প্রিন্সের উপাধি পাওয়ার পরপরই আসলে দেশটির ডি-ফ্যাক্টো শাসক হয়ে উঠেছেন প্রিন্স সালমান। তিনিই নারীদের গাড়ি চালানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝোলা কম ভারী নয়। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পেছনে সালমানের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে, ২০২১ সালে। এ ছাড়া নানাবিধ একনায়কতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি, সৌদি আরব আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করেছে তার হাত ধরেই। এ জন্য তিনি তরুণদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়।
আন্তোনিওনির চলচ্চিত্র শেষ হতে হতে বেজে গেল রাত ১১টা। ঢাকায় তখন রাত দুটো। আমার চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু দেখলাম, ছবিটি নিয়ে আলাপ করতে মঞ্চে এলেন সৌদি চলচ্চিত্র সমালোচক আহমেদ আলহোকালি। তার আরবি ভাষার বক্তব্য অনুধাবনের জন্য আমাদের দেওয়া হলো হেডফোন, সেখানে ইংরেজি অনুবাদ সম্প্রচার হচ্ছে সরাসরি। আমরা কিছুক্ষণ শুনলাম। কিন্তু আলাপ অতটা উপভোগ্য মনে হলো না। আমরা সবাই উঠে পড়লাম।
৯ নভেম্বর ২০২৪। সিম্পোজিয়ামে আমার বক্তব্য রাখার পালা। সকাল সকাল উঠে বক্তৃতাটি আরও একবার দেখে নিলাম; পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন চেক করলাম। এরপর গেলাম নাশতা করতে। টেবিলে সবাই ঠিক করল সিটি ট্যুরে যাবে। একটু কেনাকাটা করবে। কিন্তু আমি বললাম, আমার ফিরতে হবে দ্রুত, যেহেতু প্রেজেন্টেশন আছে। আগেভাগে ভেন্যুতে গিয়ে ড্রাই রান করতে হবে। সবাই ভরসা করে আছে মিসরীয় ফিল্ম ক্রিটিক হোশেমের ওপর। কারণ, তার এক বন্ধু আমাদের রিয়াদ ঘুরিয়ে দেখাবেন। আমরা নাশতা সেরে বেলা ১১টায় দুই গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম। প্রথম হোশেমের বন্ধুকে তার বাসা থেকে তুলতে হবে। আমরা যতই সেই বন্ধুর বাসার দিকে যাচ্ছি, ততই অনুভব করতে শুরু করলাম, সত্যিকারের লোকালয়ে প্রবেশ করছি। বাসাবাড়ি, মুদিদোকান, নানা ধরনের খাবারের দোকান, বাহারি পোশাকের দোকান। মানুষের আনাগোনা আছে। আমরা যে অঞ্চলে উঠেছি, সেটি ওদের নিউ টাউন। শহর কেবল সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই আমাদের হোটেল অঞ্চল কিছুটা জনমানবশূন্য। এসব আলাপ করতে করতে মোটামুটি আধঘণ্টার ভেতর আমরা পৌঁছে গেলাম হোশেমের বন্ধুর ঠিকানায়।
হোশেমের বন্ধুর নাম ফাতিমা। ঢিলেঢালা কালো ট্রাউজার ও সাদা শার্ট পরা। চুল পেছনে টেনে বাঁধা। মাথায় হ্যাট। ছোটখাটো শ্যামা মেয়েটি আমাদের গাড়িতেই উঠলেন। ব্রেস পরা দাঁতে মিষ্টি হেসে সবার সঙ্গে পরিচিত হলেন। আরবি উচ্চারণে ইংরেজি বলেন। বেশ চটপটে। কথায় কথায় জানা গেল, ফাতিমার জন্ম ইয়েমেনে, ওর বাবা-মা থাকেন জেদ্দায়। আর তিনি থাকেন রিয়াদে। স্থাপত্যবিদ্যায় পড়ালেখা। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থায় ফ্রিল্যান্সিং করেন। তিনি আমাদের কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছেন। যেতে যেতে সৌদি আরবের জাতীয় গ্রন্থাগার দেখালেন। ভবনটা এত সুন্দর, যেন সহস্র পাল তুলে আকাশের পানে রওনা দেবে। ফাতিমা যেহেতু স্থাপত্যবিদ্যায় পারদর্শী, তাই ভবনের নকশার প্রশংসা করতে লাগলেন। আমি বললাম, ‘তোমাদের সিটিস্কেপ আর রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিং আলাদা। নগরের বাণিজ্যিক ভবনগুলো যেন ইউরোপীয় সুউচ্চ ভবনগুলোরই অনুকরণ। নকশা ও উচ্চতায় একটি আরেকটিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আবাসিক ভবনগুলো দোতলা, বেশি হলে আড়াইতলা। চৌকোনো। রং বেশির ভাগেরই মেটে বা গেরুয়া। মরুর সঙ্গে কোথায় যেন এই বাসাগুলো সাযুজ্য আছে। মনে হয় একই সুরে বাঁধা। প্রচুর খেজুরগাছ। ঝিরঝির বাতাসে একটা মিহি শব্দ তোলে।’ ফাতিমা জানালেন, তারা আবাসিক ভবনগুলোতে ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। আমি বললাম, ভুটানের থিম্পুতেও দেখেছিলাম এই চর্চা।
কথা বলতে বলতে আমরা এসে এক জায়গায় থামলাম। গাড়ি থেকে নেমে দেখি উঁচু মিনার, আর ঐহিত্যবাহী ভবন; কিন্তু এই ভবনগুলো টানা। মাঝে বিশাল বড় জায়গা। খোলা চত্বর। ফাতিমা জানালেন, জায়গাটির নাম আল হুকুম প্যালেস। এখানে মসজিদ আছে। বেশ সুন্দর। আর পাশের ভবনগুলোতে দোকান। পাবলিক স্কয়ার নামেও পরিচিত জায়গাটি। ফাতিমাকে বললাম, বাংলায় হুকুম শব্দটা রয়েছে। আরবি থেকে অনেক শব্দ প্রবেশ করেছে বাংলার ভান্ডারে। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন বিশাল কমপ্লেক্সের ভেতরেই সুগন্ধির রাজ্যে। পারফিউম ছাড়াও সেখানে রয়েছে আতর বা পারফিউমড অয়েল; রয়েছে চন্দনকাঠসহ বিভিন্ন কাঠের জ্বালানি, ধূপের জন্য। আরবরা দেখলাম এই ধূপের সংস্কৃতিটা খুব মানে। সম্মেলনের মাঝেও এই ধূপ নিয়ে ওরা অতিথিদের কাছে গিয়ে আহ্বান করেছে সুগন্ধি ধোঁয়াটা যেন নিজের দিকে টেনে নেয়।
একটি দোকানে ঢুকে পাওলা প্রথমে ধরলেন একটি আতর। আমার মনে হলো, সৌদি এসে যদি আতর না নিই, তাহলে কি হয়! ফাতিমাকে বললাম, আমিও নেব আতর। অবশ্য ওরা আতর বোঝে না। বলতে হলো পারফিউমড অয়েল। সুগন্ধি তেল। পাওলা নিলেন এক শিশি। আমি নিলাম দুই শিশি। এরপর হাঁটতে হাঁটতে খোলামেলা চত্বরে এলাম। জায়গাটি কিন্তু রিয়াদের জনপ্রিয় কালচারাল হেরিটেজ ল্যান্ডমার্ক। ভবন ও চত্বরটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৪৭ সালে। নগরের নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘ দেয়াল তুলে এই স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তবে শত বছরের পুরোনো নগর তো আর নেই। সম্প্রসারণ ঘটেছে। পাওলা একটা ধূপদানি কিনলেন কাঠের। বেশ নকশাকাটা। তবে পাশে থাকা ডিয়ানা বেশ সন্দেহ পোষণ করতে লাগলেন, বিদেশি বলে দামটাম বেশি রাখছে না তো? তাদের আরমেনিয়াতে এমন ঠকবাজি নাকি আকসারই হয়। ফাতিমা আশ্বস্ত করলেন, এমনটা এখানে হবে না। মারসেলো বললেন, ব্রাজিলে সুযোগ পেলেই বিদেশিদের ঠকায় দোকানিরা। আর আমি চুপ করে রইলাম। বাংলাদেশের কথা বলে তার গৌরব আর বৃদ্ধি করতে চাইলাম না!

হুকুম প্যালেসের একটি প্রবেশপথ

সবাই ঠিক করল, শুরুর দিকটায় সারি সারি চায়ের দোকানের সামনে পাতা টেবিল চেয়ারে বসে একটু চা বা কোমল পানীয় খাবে। আমরা গিয়ে বসলাম। অর্ডার নিতে যে লোক এলো, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তার বাড়ি বাংলাদেশে। সবার অর্ডার নেওয়া শেষ। আমি বললাম, ‘চা খাব, কোনটা ভালো হবে? কাড়াক টি?’ লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাংলাদেশ থেকে এসেছি কি না! বললাম, ‘জি ভাই। বাড়ি কোথায় আপনার?’ জানালেন, কুমিল্লার চান্দিনায়। আমাকে বাংলায় কথা বলতে দেখে বাকিরা বেশ আমোদিত হলো। মারসেলো বললেন, ‘এই তো বিধান দেশি ভাই পেয়ে গেছে। এখন আর ওকে পায় কে!’
অন্যরা ফলের রস আর কফি নিয়েছেন। আমি কাড়াক টি, মানে মসলা চা আরকি। চা-টা খাওয়া শেষে, বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলে একটু বাড়তি খাতির করলেন লোকটি। সবাইকে একটি বাটিতে খেজুর খেতে দিলেন। আর ভিন্ন বাটিতে দিলেন হালকা খয়েড়ি ধরনের ঘন তরল। ফাতিমা বললেন, এতে ডুবিয়ে খেজুরটা খেতে হয়। এই ড্রেসিং বা সসের নাম সুইট তাহিনি বা তাহিনা সস। আমরা ডিপ করে খেজুর খেলাম। দুর্দান্ত স্বাদ। এভাবে কখনো খেজুর খাওয়া হয়নি। তাহিনি নানা জিনিস দিয়েই বানানো যায়। সেটার রেসিপি আর দিচ্ছি না। ফাতিমাকে বললাম, দেশে প্রচুর খেজুর নিয়ে যেতে হবে। লোকজন অপেক্ষা করছে সৌদি খেজুরের জন্য। ফাতিমা বললেন, ‘চলো তাহলে নিয়ে যাই খেজুরের মার্কেটে।’
যারা যারা খেজুর ক্রয়ে আগ্রহী, তারা একটি গাড়িতে উঠলেন। বাকিরা গাড়ি করে রওনা দিলেন হোটেলের উদ্দেশে। আমার সঙ্গে উঠলেন হোশেম, মারসেলো আর ফাতিমা। ফাতিমা জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী করি, পেশা কী। বললাম, ‘লিখি, ঘোরাঘুরি করি আর সিনেমা দেখি।’ শুনে তিনি ভীষণ আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘আরে, এমন জীবনই তো আমার প্রত্যাশিত! তুমি দেখি আমার জীবন যাপন করছ!’ বললাম, ‘নদীর ওপারের ঘাস সর্বদাই অধিক কচি।’ ফাতিমা হাসলেন। নিজের সম্পর্কে বললেন, কীভাবে রিয়াদে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন নিজ প্রচেষ্টায়। আমি যেহেতু বই ভালোবাসি, আমাকে নিয়ে তিনি রিয়াদের জাতীয় গ্রন্থাগারে নিয়ে যাওয়ার বাসনা পোষণ করলেন। কিন্তু আপাতত আমরা খেজুরের খনিতে নামলাম। নেমে খুব অল্প সময়ের ভেতরেই একখানা তিন কেজির বক্স আর ছয়টি আধা কেজির বক্স কিনলাম। সঙ্গে নিলাম ডিপ করে খাওয়ার জন্য তাহিনির একখানা ছোট বোতল।
মারসেলো আর হোশেমও নিলেন অল্পসল্প। গাড়িতে উঠে হোশেমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত কাছে এসেছ, বাড়ি যাবে না? লোহিত সাগর পাড়ি দিলেই তো মিসর।’ হোশেম যেহেতু একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জার্মানিতে ওর অনেক রোগী আছে, পরিবারের কাছে গেলে তিন সপ্তাহের আগে ছাড় পাবেন না। বিশাল পরিবার। দিনসাতেকের ছুটি নিয়ে রিয়াদে এসেছেন। আলাপে আলাপে জানলাম, ২০২৪ সালের কায়রো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অফিশিয়াল ছবির প্রোগ্রামার ছিলেন হোশেম। আরও জানলাম, তিনি এবার বাংলাদেশের দুটি ছবি দেখেছেন বাছাইকালে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবার তো কায়রো উৎসবে “প্রিয় মালতী” অফিশিয়াল সিলেকশনে রয়েছে। তুমি নিশ্চয় সেটাই দেখেছ?’ হোশেম বললেন, ‘এত ছবি দেখেছি, নাম মনে নেই; কিন্তু নারীনির্ভর ছবি, সেটা মনে আছে।’

[চতুর্থ কিস্তি আগামী সংখ্যায়] ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top