skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I মুক্তির মহিমা

দৌড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার মহাকাব্যিক বাস্তবতা। অদম্য স্পৃহার জোরে নারীমুক্তির বৈচিত্র্যময় অগ্রদূতে পরিণত হওয়ার অনুকরণীয় আখ্যান

১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সিরাকিউস শহর। প্রবল তুষারঝড়ে প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় অন্ধকারাচ্ছন্ন পথঘাট। এরই মাঝে এক তরুণী দৌড়াচ্ছেন তো দৌড়াচ্ছেনই। বয়স ১৯। অ্যাথলেট হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি। তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন পঞ্চাশ বছর বয়সী এক রাগী প্রশিক্ষক।
দৌড়ের মাঝখানেই কোচের সঙ্গে তিক্ত ঝগড়া লেগে গেল ওই তরুণীর। নিজের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি তখন পড়তাম সিরাকিউস ইউনিভার্সিটিতে, জার্নালিজমে। সেখানে কিংবা বলা চলে সেভাবে কোথাও নারীদের কোনো রানিং টিম না থাকায় পুরুষদের ক্রস-কান্ট্রি টিমের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলাম। সেখানেই আর্নির সঙ্গে দেখা, যিনি বহু বছর ধরে ওই টিমকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। তিনি আসলে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ডাকপিয়ন। বোস্টন ম্যারাথনে ১৫ বার অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। কোনো নারীকে দৌড়াতে দেখা তার কাছে প্রথমত ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। আর আমাকে তার নিজের প্রশিক্ষণের অধীনে একটি গিনিপিগ হিসেবেই নিয়েছিলেন! আমাকে মিষ্টি কথায় কঠিন অনুশীলনগুলোর মধ্যে ঠেলে দিতে বোস্টন ম্যারাথনের নানা গল্প বারবার শোনাতেন। শুনতে বেশ ভালোই লাগত। কিন্তু সেদিন রাতে একপর্যায়ে খেপে গিয়ে বললাম, “বোস্টন ম্যারাথনের এসব ফালতু প্যাঁচাল বাদ দিয়ে চলুন বরং দৌড়ানো যাক!” তিনিও রেগে জবাব দিলেন, “বোস্টন ম্যারাথনে কোনো নারীর পক্ষে দৌড়ানো সম্ভব নয়।” “কেন নয়? আমি কি এক রাতে ১০ মাইল দৌড়াই না?” জবাবে আর্নি বলেছিলেন, ম্যারাথনের দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার পক্ষে নারীরা অতি দুর্বল!’
কোচের এমন অবমূল্যায়ন উসকে দিয়েছিল ওই তরুণীর স্পৃহা। এরপর তিনি যা করেছেন, তা রীতিমতো ইতিহাস।
১৯৬৭ সাল। বোস্টন ম্যারাথন। ছুটতে থাকা অ্যাথলেটদের একজনকে প্রাণপণে আটকানোর চেষ্টা করছেন আরেকজন। ওই অ্যাথলেটের জার্সিতে নম্বর সাঁটা—‘২৬১’। চারপাশে পুরুষ; তিনি একাই নারী। মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দী করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক দৈনিক সংবাদপত্র ‘বোস্টন হ্যারাল্ড’-এর আলোকচিত্র সংবাদিক হ্যারি এ ট্রাস্ক। যিনি আটলান্টিক মহাসমুদ্রে ইতালিয়ান ক্রুজ শিপ এসএস আন্দ্রিয়া দরিয়ার নিমজ্জনের ছবি তুলে এক দশক আগেই জিতে নিয়েছিলেন মর্যাদাপূর্ণ পুলিৎজার পুরস্কার।
বোস্টন ম্যারাথনের ছবিটি যতটা না এর প্রসিদ্ধ আলোকচিত্রীর জন্য, তার চেয়ে ঢের বেশি এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকা নারীটির জন্য সুপরিচিত। কেননা, ছবিতে থাকা নারীটিই সিরাকিউসের সেই তরুণী। নাম ক্যাথরিন সুইটজার।
ছবিতে তাকে আটকানোর চেষ্টারত লোকটির পরিচয়, তিনি ওই আয়োজনের অর্গানাইজার। নাম জক সেম্পল। কিন্তু ম্যারাথনের দৌড়ের ভেতর থেকে নম্বরধারী একজন অ্যাথলেটকে কেন এভাবে আটকানোর চেষ্টা? ঘটনা হলো, ম্যারাথনে নারীদের অংশগ্রহণ তখনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। স্বভাবতই বোস্টন ম্যারাথন আয়োজিত হতো শুধু পুরুষদের জন্য। সেই আসরে আয়োজকদের ফাঁকি দিতে নিজের নাম ‘কে.ভি. সুইটজার’ হিসেবে নিবন্ধন করেছিলেন ক্যাথরিন। ফলে সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারেননি, তিনি আদতে নারী। কিন্তু দৌড় শুরু হতেই আয়োজকদের চক্ষু চড়কগাছ! তাই তাকে আটকানোর এমন দৃষ্টিকটু যারপরনাই চেষ্টা। যদিও অন্য অ্যাথলেটদের বাধায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আর ক্যাথরিন ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন বোস্টন ম্যারাথনে অংশ নেওয়া প্রথম নারী হিসেবে।
ছবিটি প্রকাশের পর, ‘ক্যাথরিন সুইটজার ম্যারাথন’ শিরোনামে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণের বিরুদ্ধে ক্যাথরিনের দৌড় এক সুতীব্র কশাঘাত হিসেবে, নারীবাদী আন্দোলনের একটি অনন্য প্রতীকী আলোকচিত্রে পরিণত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লেখা ক্যাথরিন সুইটজারের এক কলাম থেকে জানা যায় মুহূর্তটির প্রেক্ষাপট। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৬৭ সালের বোস্টন ম্যারাথনে যখন আমি দুই মাইল পাড়ি দিয়েছি, আয়োজনটির একজন কর্মকর্তা আমাকে আটকানোর চেষ্টা চালালেন। এর কারণ স্রেফ, আমি একজন নারী। এ ঘটনা আমার তো বটেই, পরিণামে দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ নারীর জীবনকেও পাল্টে দিয়েছিল। সে সময় ম্যারাথন ছিল শুধুই পুরুষদের দৌড়। এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পক্ষে নারীদের দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু আমি ভীষণ কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। আর নিজের শক্তির ওপর আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। তবু দৌড়ের ময়দান থেকে আমাকে সরিয়ে দিতে আসা ওই লোককে ঠেকানোর জন্য প্রেমিককে আমার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়েছিলই।’ ওই ম্যারাথনের ২৬ মাইল ৩৮৫ গজের পথটুকু পাড়ি দিতে ক্যাটরিনের সময় লেগেছিল ৪ ঘণ্টা ২০ মিনিট।
‘১৯৬৭ সালে খুব কম মানুষই বিশ্বাস করতেন, ম্যারাথনের প্রতি লাখ লাখ নারীর আকৃষ্ট হওয়া সম্ভব,’ যোগ করেন সময়ের চেয়ে আগুয়ান এই রানার। এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওই দৌড় শুধুই একটি ম্যারাথনে অংশ নেওয়ার বিষয় ছিল না; বরং নারীমুক্তির প্রবল বার্তাবাহীও। শুধুই পুরুষের অংশগ্রহণমূলক একটি খেলার ময়দানে প্রথম নারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বোস্টন ম্যারাথন সম্পন্ন করে ক্যাথরিন রীতিমতো নারী অধিকার আন্দোলনের একজন বীরে পরিণত হয়েছিলেন।
আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তটিকে নিজের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘ম্যারাথন ওম্যান’-এ ক্যাথরিন বর্ণনা করেছেন, ‘দ্রুতই মাথা ঘুরিয়ে আমি ময়দানের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম মুখটির দেখা পেলাম। একজন বেশ বড়সড় লোক, দাঁত বের করে আমাকে ছোঁ মেরে ধরতে চাচ্ছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার কাঁধে খাঁমচে ধরে, আমাকে পেছনের দিকে টেনে চিৎকার দিয়ে উঠল: “আমার রেস থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যাও!” জানতাম, নারীদের পক্ষে এতটা দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার এবং বোস্টন ম্যারাথনে অংশ নেওয়ার যোগ্য ভাবার কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। তাদের কাছে আমাকে স্রেফ কোনো ক্লাউন মনে হয়েছিল। তারা ভেবেছিল, নারীদের আদতে কোনো সক্ষমতা নেই; এমন অনুষ্ঠানে নারীরা কেবলই ঝামেলা বাধাতে আসে।’
ক্যাথরিনের ভাষ্য থেকে জানা যায়, তার ওই অর্জন দৌড়সহ সার্বিক খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণের একধরনের সামাজিক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। এ ঘটনার পাঁচ বছর পর, ১৯৭২ সালে প্রথমবার বোস্টন ম্যারাথনে নারীরা অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক সম্মতি পান। অলিম্পিক গেমসের ম্যারাথনে নারীদের অংশগ্রহণের সূচনা ঘটতে লেগে যায় আরও কিছু সময়; ১৯৮৪ সালে তা অন্তর্ভুক্তি পায়। ১৯৪৭ সালের ৫ জানুয়ারি জার্মানির আমবার্গে জন্মগ্রহণকারী, বর্তমানে ৭৮ বছর বয়সী আমেরিকান ম্যারাথন রানার, লেখক ও টিভি ধারাভাষ্যকার ক্যাথরিন তার দীর্ঘ জীবনে ত্রিশটির বেশি ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন। বোস্টন ম্যারাথনের নিজের নম্বর অবলম্বনে, নারীদের রানিং ক্লাব ‘২৬১ ফিয়ারলেস’ও প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা নিবন্ধে নারী ম্যারাথন রানারদের এই অগ্রদূতের ভাষ্য, ‘আমরা জেনে গেছি, নারীদের কষ্টসহিষ্ণুতা ও মনোবলের কোনো ঘাটতি নেই; আর, দৌড়ানোর জন্য কোনো আলংকারিক সুযোগ-সুবিধা কিংবা যন্ত্রপাতিও আবশ্যক নয়।’

দায় স্বীকার:
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস; দ্য গার্ডিয়ান; ম্যারাথন ওম্যান: রানিং দ্য রেস টু রেভল্যুশনাইজ উইমেন’স স্পোর্টস/ক্যাথরিন সুইটজার, ২০০৭

 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top