skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I ফিঙ্কা ভিহিয়া সাহিত্য আস্তানা

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। নোবেলজয়ী কিংবদন্তি আমেরিকান সাহিত্যিক। তার একটি বিশেষ বসতবাড়ি লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্র কিউবায়। যে বাড়ির পরতে পরতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাসের অগুনতি গল্প। ঘুরে এসে লিখেছেন মহুয়া রউফ

একটি স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করছি। আবেগে কাঁপছি থরথর। হাভানার বাড়িগুলো স্প্যানিশ উপনিবেশের সময়কার। ঘরের প্রবেশমুখের দেয়ালের ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা চারের ঘরে; বাকি দুটি কাঁটা বারোটা বরাবর। মনে বিস্ময়, শরীর ক্লান্ত। পানামা থেকে হাভানায় পৌঁছেছি সাড়ে বারোটা নাগাদ; কিন্তু ইমিগ্রেশন বড্ড বেশি সময় নিল ছাড়তে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কণ্ঠ কর্কশ। জানালেন, প্রতিরাতের জন্য আমাকে রুম ভাড়া দিতে হবে ২০ ডলার। জানতে চাইলাম, ‘ইন্টারনেট ফ্রি তো?’ বললেন, ‘না, একেবারেই ফ্রি নয়। ইন্টারনেট চার্জ প্রতি ঘণ্টায় এক ডলার।’ এতক্ষণ মনে যে কৌতূহল চলেছে, সেটি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ক্রোধের দিকে। এমন পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে একেবারেই তৈরি ছিলাম না।
নিজের শারীরিক অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। এই ফোরপ্লেক্স বাড়ির চারতলায় আমার থাকার ব্যবস্থা। ব্যাগ রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম রেস্তোরাঁর খোঁজে। সারা দিন কিছু খাইনি; শেষবার খেয়েছিলাম আগের দিন সন্ধ্যায়। এ দেশের তিন কুলে ইংরেজি না বলা মানুষ। চট করে রাস্তায় কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে সদুত্তরও পাচ্ছি না। তারা না আমাকে বোঝেন, না আমি তাদের বুঝি।
এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ দাঁড়িয়ে সাইকেল হাতে, রাস্তার ধারে। বললাম, ‘একটা রেস্তোরাঁ দেখিয়ে দিতে পারো? আমি খুব ক্ষুধার্ত।’ দেখিয়ে দেওয়ার বদলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলল। বাপ রে! আমার এমন দুর্দিনে হাভানার রাস্তায় ইংরেজি জানা মানুষ পেয়ে স্বস্তি এলো।
কিউবান পিৎজা খেতে খেতে আলাপ জমে গেছে আমাদের। জানাল, ছয় বছর ধরে আছে সে এ দেশে। আফ্রিকা থেকে ডাক্তারি পড়তে এসেছে। নাম রোসা। আর এক বছর পাস দিলেই ডাক্তার।
‘গিয়েছ কখনো হেমিংওয়ের বাড়ি?’
‘না, যাইনি।’
‘আগ্রহ আছে? যেতে চাও আমার সঙ্গে?’
‘হুম, যাওয়া যেতে পারে। কাল আমার ছুটি।’
‘পড়েছ কি তার কোনো বই?’
‘নামই শুনিনি আগে। এই প্রথম শুনলাম, তোমার মুখে।’
রেস্তোরাঁয় বসে রোসা আমাকে তার মোবাইল হটস্পট দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ দিল। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে আর অন্যান্য যোগাযোগ শেষ করলাম তার বদান্যতায়। গুগল ঘেঁটে একবার দেখে নিলাম, কীভাবে, কোন বাস স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়িতে যাব। রোসাকে বললাম, ‘তবে চলে এসো লুয়ানো, কাল সকালে, সেখান থেকে বাস ছাড়ে।’ রোসা বিচলিত হয়ে বলল, ‘ভুলেও বাসে যাওয়ার চেষ্টা করো না! এখানকার পাবলিক সার্ভিসের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও দেখবে, বাস আসছে না। করোনা-পরবর্তী সময় থেকে কিউবার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ মন্দার দিকে। এর প্রভাব যাতায়াত ব্যবস্থাতেও পড়েছে।’
রোসা আরও জানাল, কিছু ট্যাক্সি পাওয়া যায়, যেখানে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে শেয়ারে যাওয়া যাবে। আমি বললাম, ‘তবে তাই হোক।’
একজন হেমিংওয়ের বাড়ি কত বিশাল হতে পারে, সে ব্যাপারে শূন্য-জ্ঞান নিয়ে হাজির হলাম তার হাভানার বাড়ি ফিঙ্কা ভিহিয়ায়। কোনো এক নথিতে পড়েছিলাম, সকাল থেকেই পর্যটকের ভিড় জমে যায় বাড়ির প্রধান ফটকে; তাই নির্ধারিত সময়ের আগে পৌঁছে গেছি।
কয়েকটি কিউবান ছাদখোলা ক্ল্যাসিক গাড়ি ঢুকে গেল প্রধান ফটক দিয়ে। আমি হাঁটছি। সোজা পথ ধরে হাঁটছি, দুপাশ বিস্তীর্ণ—গাছগাছালিতে ভরা। একি, পথ তো ফুরায় না! কত দূর! পাথুরে পাহাড়ি এলাকা, সে বোঝাই যাচ্ছে। বাড়ির গেট থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে মূল বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে দেখি, একটি বড় স্থায়ী ম্যাপ দাঁড়িয়ে আছে। এই ভিটেবাড়ির আয়তন এতই বিশাল, কোন দিক থেকে কোন দিকে যেতে হবে, তা স্পষ্ট করতে কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা রেখেছে।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি ডিঙিয়ে তবেই ঘরের অন্দর দেখতে হয়। সামান্য বিধিনিষেধ আছে; যেমন দরজায় বা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্দর দেখতে হবে, ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না।
ফিঙ্কা ভিহিয়া হাভানার অদূরে অবস্থিত। হেমিংওয়ে মার্কিন নাগরিক; কিন্তু বাড়ি কিনেছেন হাভানায়; ১৯৩৯ সালে। বিশ বছর বসবাস করেছেন এ বাড়িতে। এখানে তিনি তার দুটি বিখ্যাত উপন্যাস লিখেছেন, ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ ও ‘ফর হোম দ্য বেল টুলস’। প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ বাড়ি। এখনো কিউবান সরকার এটিকে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই অক্ষত রেখেছে। এই জায়গায় আর কোনো অবকাঠামো তৈরি করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকটি স্থাপনা এখানে—মেইন হাউস, টাওয়ার হাউস, গেস্টহাউস, পামহাউস, গ্যারেজ ইত্যাদি। প্রতি বাড়িতে আবার বেশ কয়েকটি কক্ষ। প্রতিটি বাড়ি ঘিরে বৈচিত্র্যময় গাছগাছালি; যেন রাজার বাগানবাড়ি!
প্রধান বাড়ির একটি বিশেষ কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়েছি। এখান থেকে পরপর দুটি কক্ষ দেখা যাচ্ছে। প্রশস্ত। দেয়ালে হরিণের মুণ্ডু গাঁথা, মেঝে থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে বুকশেলফ, অন্দরের আরও ভেতরে বেশ কখানা টেবিল-চেয়ার। দেয়ালে ঝুলছে বিভিন্ন দেশ থেকে আনা শিল্পকর্ম ও ফটোগ্রাফ। বসার সোফা দেখে মনে হয়, এটা এ বাড়ির প্রধান বৈঠকখানা। ভাবছি, কে না বসেছেন এখানে; ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ-পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বোভোয়ারসহ আরও অনেক বিখ্যাত জন। মতাদর্শগত কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সার্ত্র ছিলেন হেমিংওয়ের অনুরাগী।
ফিঙ্কা ভিহিয়া শুধু লেখালেখির কেন্দ্র ছিল না; ছিল বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার জায়গাও। বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা গ্যারি কুপার, যিনি ‘ফর হোম দ্য বেল টুলস’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ফিল্মের অভিনেতা ছিলেন, বেশ কয়েকবার এসেছেন এ বাড়িতে। এসেছেন স্পেনের বিখ্যাত ম্যাটাডর অ্যান্তোনিও ওর্ডোনেজ। ম্যাটাডর মানে বুলফাইটার। হেমিংওয়ে স্প্যানিশ বুলফাইটিং খুব পছন্দ করতেন এবং তার ‘দ্য ডেঞ্জারাস সামার’ বইতে এই বিখ্যাত ম্যাটাডরের কথা লিখেছেন। বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা স্পেন্সার ট্রেসি, যিনি ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, তিনিও এসেছেন এ বাড়িতে। এই বৈঠকখানায় তো বসেছেনই! আর যেখানে আমি দাঁড়িয়ে, এ পথেই তো প্রবেশ করেছেন এ কক্ষে। এসব ভেবে আমি শিহরিত!
বৈঠকখানা রেখে এগিয়ে গেলেই পরের কক্ষটি হেমিংওয়ের লেখার ঘর। একটি বিছানা পাতা আছে। দেখে অনেকে এটি তার শোয়ার ঘর মনে করে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। দায়িত্বরত কর্মকর্তা আমাকে শুধরে দিয়ে জানালেন, এটি তার লেখার ঘর। একটি টেবিল দেখা যাচ্ছে দূরে। সেটিতে তিনি লিখতেন। তার শোয়ার ঘর এখান থেকে দেখা যায় না। দেখতে গেলে অন্য কক্ষ ডিঙিয়ে যেতে হবে। কিন্তু প্রবেশের যেহেতু অনুমতি নেই, কক্ষ ডিঙিয়ে সে কক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। হেমিংওয়ের শোয়ার ঘর দেখার আশায় তাই গুড়ে বালি।
হেঁটে যেতেই এ বাড়ির পেছনে গিয়ে আরও দুটি কক্ষ পেলাম। একটি পাঠাগার এবং তার পাশে অতিথিকক্ষ। রোসা বলল, ‘তার পারিবারিক জীবন নিয়ে কিছু বলো আমায়। আমি তো কিছুই জানি না।’ বললাম, হেমিংওয়ের স্ত্রী ছিলেন চারজন; কিন্তু প্রেমিকার তালিকা দীর্ঘ। তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্ন এবং পরে চতুর্থ স্ত্রী মেরি ওয়েলশের সঙ্গে বসবাস করেছিলেন এ বাড়িতে। বাড়িটি যখন কিনছিলেন, তখন তার প্রেম ছিল সাংবাদিক ও লেখিকা মার্থা গেলহর্নের সঙ্গে। মার্থা লেখককে বিয়ে করেন ১৯৪০ সালেই, তার দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনকে ডিভোর্স দেওয়ার পর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তরুণ ডাক্তার বেশ হকচকিয়ে গেল এসব কথা শুনে। হাসল। ডাক্তার দেখছি লেখক-বাড়ি আর জীবন থেকে আনন্দ পেতে শুরু করেছে!
মার্থা ছিলেন একজন যুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কাভার করার জন্য প্রায়ই হাভানার বাইরে থাকতেন। এটা নিয়ে তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। মার্থা চেয়েছিলেন স্বাধীনভাবে নিজের সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে; হেমিংওয়ে চাইতেন মার্থাকে নিজের কাছে। ১৯৪৫ সালে তাদের ডিভোর্স হলে পরের বছর হেমিংওয়ে বিয়ে করেন মেরি ওয়েলশকে। মেরিও ছিলেন সাংবাদিক। টাইম ম্যাগাজিনে কাজ করতেন। তারা দীর্ঘদিন এ বাড়িতে একসঙ্গে থেকেছেন। এই সময় হেমিংওয়ে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ লেখেন, যা তাকে পুলিৎজার পুরস্কার এনে দিয়েছিল।
‘হেমিংওয়ে কি এ বাড়িতে মারা গিয়েছিলেন,’ রোসা জানতে চাইল। বললাম, ‘আরে না, ১৯৬০ সালে কিউবায় বিপ্লবের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেল। তত দিনে তিনি খানিকটা অসুস্থও হলেন। তারা কিউবা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।’
হবু ডাক্তারের আগ্রহ বাড়ায় আমি খানিকটা হালকা অনুভব করছি। একটা চাপ অনুভব করছিলাম কাল রাত থেকে এই ভেবে, আমি আবার তাকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিপদে ফেললাম না তো!
পাঠাগার কক্ষটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রকাণ্ড টেবিল। তার ওপর একটি বন্য প্রাণীর মুণ্ড। কর্তব্যরত কর্মকর্তা জানালেন, এ কক্ষে আড়াই হাজার বই আছে। এক পাশের দেয়ালে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত একটি ষাঁড়ের দেয়ালচিত্র। অন্য পাশের দেয়ালে ঝুলছে গোলাকার একটি খোদাই করা ষাঁড়ের চিত্র। পেছনে অবস্থানরত নারী কর্মকর্তা জানালেন, গোলাকার ষাঁড়ের ছবিটি পিকাসো পাঠিয়েছিলেন লেখককে। ‘পিকাসো কি কখনো এসেছিলেন এ বাড়িতে?’ জানতে চাইলাম। তিনি উত্তরে ‘না’ বললেন।
রোসা জানতে চাইল, ‘পিকাসো ও হেমিংওয়ে কি বন্ধু ছিল?’ বললাম, ‘না, ঠিক তা নয়; আবার ঠিক তা-ও!’ ‘কী রকম?’ বললাম, ‘দুজনেরই স্প্যানিশ সংস্কৃতির ওপর বিশেষ আকর্ষণ ছিল; বিশেষ করে স্পেনের ষাঁড়ের লড়াইয়ের ওপর। দেখছ না এই পাঠাগারে কেমন ষাঁড়ের ছবি!’
আরও বললাম, ‘হেমিংওয়ের বিখ্যাত বই ডেথ ইন দ্য আফটারনুন-এ এই ষাঁড়ের লড়াইয়ের কথা আছে। আবার পিকাসোও ষাঁড়ের লড়াই আঁকতে পছন্দ করতেন। তার বিখ্যাত বুলফাইটিং সিরিজে স্প্যানিশ সংস্কৃতি ষাঁড়ের লড়াই ফুটিয়ে তুলেছেন। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে (১৯৩৬-১৯৩৯) দুজনেই রিপাবলিকানদের সমর্থক ছিলেন। পিকাসো এই সময় তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম গুয়ের্নিকা এঁকেছিলেন, যা স্পেনে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। সে সময় হেমিংওয়ে স্পেনে যুদ্ধ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছিলেন এবং ফর হোম দ্য বেল টুলস উপন্যাসটি লিখেছিলেন, যা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। স্পেনে তাদের দেখা হয়েছিল কি না, জানি না; তবে ফ্রান্সে একাধিকবার দেখা হয়েছে। ১৯৪৪ সালে প্যারিস মুক্ত হওয়ার সময় হেমিংওয়ে ওখানে ছিলেন। পিকাসোও সে সময় ফ্রান্সে ছিলেন। একটি মজার তথ্য দিই তোমাকে। সে সময় একদিন হেমিংওয়ে প্যারিসে নাৎসিদের দখল করা একটি হোটেল বার লারোতনদেতে গিয়ে বলেছিলেন, হোয়ার ইজ পিকাসো?’
রোসা জোরে জোরে হাসছে। প্রথম দিকে সে একেবারেই আগ্রহ পাচ্ছিল না, মনে হয়েছে আমার। তাকে কক্ষের দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘দেখো, ওই দেয়ালে ঝুলে থাকা গোলাকার ষাঁড়ের ছবিটি পিকাসো উপহার দিয়েছেন লেখককে।’ ‘ইন্টারেস্টিং। হেমিংওয়ের প্রতি তোমার অনুরাগ দেখে আমি ভীষণ অবাক হচ্ছি’, বলল রোসা। আমি হাসলাম। প্রসঙ্গ ফিরিয়ে নিয়ে তাকে বললাম, ‘ওই যে দেয়ালে ঝুলছে ষাঁড়ের মাথা, এটি দুজনের প্রতি দুজনের ভালোবাসার প্রতীক নয়; বরং স্প্যানিশ সংস্কৃতির প্রতি তাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন।’
পাঠাগারের পাশের কক্ষটি অতিথিশালা। এ কক্ষে দুটি বিছানা পাতা। কর্তব্যরত নারী কর্মকর্তা সেধে এসে আমাকে জানালেন, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির রাত কাটানোর কক্ষ এটি। বিখ্যাত অভিনেতা গ্যারি কুপার, স্পেন্সার ট্রেসি, বিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রী এভা গার্ডনার এ কক্ষে থেকেছেন। আমেরিকান লেখক ও সাংবাদিক জন ডস প্যাসোস, যিনি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় হেমিংওয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, তিনিও। আরও থেকেছেন জার্মান-আমেরিকান অভিনেত্রী ও গায়িকা মার্লেন ডিট্রিশ। হেমিংওয়ে ও মার্লেনের মধ্যে নাকি প্লেটোনিক সম্পর্ক ছিল এবং মার্লেন এ বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়েছেনও। বিখ্যাত আমেরিকান লেখক ও সাংবাদিক নর্মান মেইলার, যিনি ছিলেন হেমিংওয়ের সাহিত্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী, তিনিও রাত কাটিয়েছেন এ কক্ষে।
এই মেইন বাড়ির পাঁচ হাত ব্যবধানে একটি টাওয়ার হাউস। সরু চিকন উঁচু তিনতলাবিশিষ্ট বাড়ি। টাওয়ারের মতো গড়ন, তাই এমন নাম। যত ওপরে উঠছি, দেখছি প্রতি তলায় কেবল একটি করে কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই হেমিংওয়ের শিকার জীবনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আছে মাছশিকারের লম্বা লম্বা বড়শি, জন্তু শিকারের সরঞ্জাম, পশুর মাথার ট্রফি, হরিণের চামড়া, নাম না জানা আরও কত কী। মনে হচ্ছে, আমি আফ্রিকায় সাফারি করতে ঢুকে পড়েছি। জানলাম, আফ্রিকা থেকে তিনি নিয়ে এসেছেন এসব। শিকার থেকে আনা হাতির দাঁত, হরিণের শিং এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর চামড়া দিয়ে ঘরগুলো সাজানো। স্ত্রী মেরি উদ্যোগী হয়ে এই টাওয়ার হাউস নির্মাণ করিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, হেমিংওয়ে এখানে লিখবেন আর একাকী সময় কাটাবেন। তবে হেমিংওয়ে নাকি এখানে খুব একটা বসতেন না। মূল ভবনের লাইব্রেরিতেই সময় কাটাতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন।
সিঁড়ি বেশ সরু। একজনের ওঠানামায় আরেকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তিনতলার ওপর দাঁড়িয়ে হাভানা শহরের সমস্তটা দেখছি আর ভাবছি, আহা, এটা রাজার জীবন, লেখকের নয়! তিনি লেখক ছিলেন জানতাম; কিন্তু তিনি যে রাজা ছিলেন, সেটি জানা ছিল না আমার। রোসাকে বললাম, লেখালেখির বাইরে লেখকের ছিল তিন নেশা—শিকার, মদ ও প্রেম। দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনকে নিয়ে লেখক প্রথম আফ্রিকায় যান ১৯৩৩ সালে। সে অভিজ্ঞতায় লিখেছেন ‘গ্রিন হিলস অব আফ্রিকা’, ‘দ্য শর্ট হ্যাপি লাইফ অব ফ্রান্সিস মাকোমবার’। সেই সব সাহিত্যে উঠে এসেছে শিকারকাহিনি। তার একটি ট্রেলার পাচ্ছি এই টাওয়ার হাউসে।
লেখক ফারুক মঈনউদ্দীনের ‘গোয়েন্দা হেমিংওয়ে ও তার প্রেমিকাদের খোঁজে’ বই থেকে জানতে পেরেছি, প্রথমবার আফ্রিকায় শিকারে হেমিংওয়ে কেবল ব্যর্থ হচ্ছিলেন। সেযাত্রায় তার বন্ধু কার্ল বেশি পশু শিকার করছিলেন কেনিয়ার জঙ্গলে, যাকে বারবার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছেন হেমিংওয়ে। শিকারে পেরে উঠছিলেন না বন্ধুর সঙ্গে। এক অঘোষিত ও গোপন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। প্রথম দিকে শিকারে ব্যর্থ হলেও শেষ দিকে প্রায় ৭০টি প্রাণী শিকার করতে পেরেছিলেন। আমি ভাবছি, আছে নাকি এই টাওয়ার হাউসের মুণ্ডুগুলোতে সে সময়কার কিছু! মন বলছে, নিশ্চয়ই আছে।
হেমিংওয়ের প্রেমিকা জেন মেসন আফ্রিকা সাফারিতে গিয়ে হেমিংওয়ের বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। সে কারণে সেই ২২ বছর বয়সী সোনালি চুল আর নীল চোখের প্রেমিকার সঙ্গে চার বছরের প্রেমে ছেদ পড়ে লেখকের। সেই প্রেমিকাই একদা পন্ডস ক্রিমের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। হেমিংওয়ে তার আত্মজীবনীমূলক গল্পে বলেছেন, প্রথম সাফারির অর্থ সরবরাহ করেছিলেন তার স্ত্রী পলিনের চাচা। সেই প্রথম সাফারির পর পাঁচ বছর তিনি লেখেননি। লিখতে পারেননি; এটি লেখকের জীবনের বন্ধ্যা সময়।
দ্বিতীয়বার তিনি আফ্রিকায় গিয়েছিলেন ১৯ বছর পর। পলিনের গর্ভে জন্ম নেওয়া প্রথম ছেলে প্যাট্রিক সে সময় তানজানিয়ায় জমি-জিরাত কিনে অবস্থান করছিলেন। ছেলের আমন্ত্রণে আফ্রিকা ভ্রমণ। তত দিনে পলিন মারা গেছেন। সে সময় হেমিংওয়ের সঙ্গে ছিলেন চতুর্থ স্ত্রী মেরি। অনেকে লেখকের এই পশুশিকার নেশার সমালোচনা করেছেন। দ্বিতীয় দফায় শিকারে অবশ্য তিনি বেশ নিয়ম মেনেছিলেন। তত দিনে কেনিয়ায় কিছু নীতিমালাও তৈরি হয়েছিল; যেমন সেখানকার কৃষি ও মানুষের ক্ষতি করে—শুধু এমন পশুই শিকার করা যাবে। তিনি তা মেনেছিলেন।
হেমিংওয়ে মাত্রাতিরিক্ত মদ পান করতেন। অতিরিক্ত মাদকাসক্তিও তার শেষ জীবনের অসুস্থতার অন্যতম কারণ। সাফারিতেও বেশির ভাগ সময় নেশাগ্রস্ত থাকতেন। ছেলে প্যাট্রিক একবার বলেছিলেন, হেমিংওয়ে ছিলেন চার্চিলের মতোই দৈনিক পাঁচ বোতলের মানুষ!
দ্বিতীয় দফায় পূর্ব আফ্রিকা ভ্রমণে কেনিয়ায় খুঁজে পেয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ডেবাকে, প্রেমিকা রূপে। ভ্রমণ শেষে দুবার বিমান দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাভানায় ফিরেছেন এবং এই বাড়িতে লিখেছেন ‘দ্য আফ্রিকান বুক’ শিরোনামের পাণ্ডুলিপি। আফ্রিকা থেকে ফেরার পরের বছর নোবেল পান; কিন্তু অসুস্থতায় পুরস্কার গ্রহণের জন্য সেখানে যেতে পারেননি, এ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন।
রোসাকে বললাম, ‘কেমন বুঝলে আমার প্রিয় লেখককে?’ জবাবে বলল, ‘আমি ছয় বছর ধরে এ দেশে আছি; কিন্তু কিছুই জানতাম না।’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললাম, ‘তিনি কিন্তু আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। অবাক করা তথ্য হলো, আত্মহননের আগে দ্য আফ্রিকান বুক বইয়ের পাণ্ডুলিপি তিনি হাভানার একটি ব্যাংকের ভল্টে রেখে গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর কিউবা থেকে উদ্ধার করা অন্যান্য পাণ্ডুলিপির সঙ্গে এই অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিও বোস্টনের কেনেডি পাঠাগারে দান করে দিয়েছিলেন স্ত্রী মেরি।’
টাওয়ার হাউস থেকে নামতে নামতে আমার মাথায় ভর করল লেখকের আফ্রিকান প্রেমিকা ডেবা। ডেবার কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন তার লেখায়। ডেবার কারণেই ওয়াকাম্বা জাতিগোষ্ঠীর প্রতি লেখকের মমত্ববোধ তৈরি হয়। লেখকের বয়স তখন ৫৩; ডেবার ১৬। ডেবার প্রেমে পড়ে ওয়াকাম্বাদের একজন হওয়ার জন্য হেমিংওয়ে নানা কাণ্ড শুরু করেছিলেন; যেমন মাথা কামিয়ে ফেলা, নিজের শার্ট, জ্যাকেট রঙিন করা, আরও কত কী!
কোনো কিছু না বুঝেই পর্যটকের জনস্রোত যেদিকে যাচ্ছে, আমিও রোসাকে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার দুপাশের বৃক্ষরাজি পেরিয়ে দূরে লেখকের সুইমিংপুলের দেখা পেলাম। শুষ্ক পুলটা আছে, পানি নেই। বিখ্যাত অভিনেত্রী এভা গার্ডনার এই পুলে নগ্ন হয়ে সাঁতার কেটেছিলেন, সেটা নাকি সে সময়ে হেমিংওয়ের বন্ধু মহলে বেশ খোশগল্পের বিষয় ছিল। পুল অতিক্রম করলেই চারটি সমাধি। লেখকের কুকুরের সমাধি। এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে সেই নৌকা-পিলার। এখনো অক্ষত। এটি দিয়েই মাছ ধরতেন। এটি হাভানার বাইরে, কহিমারে ছিল। পরে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে সংরক্ষণের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হেমিংওয়ে তার মাছ ধরার এই নৌযানকে একটি গোয়েন্দা নৌযান হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন সাগরে। সে সময় ক্যারিবিয়ান সাগরে জার্মান ইউ-বোটগুলো মিত্রবাহিনীর জাহাজ ডুবিয়ে দিচ্ছিল। হেমিংওয়ের পরিকল্পনা ছিল, তিনি তার নৌকায় মাছ ধরার ভান করবেন এবং জার্মান ইউ-বোট বা সাবমেরিনগুলো কাছে এলেই আক্রমণ করবেন। শেষে কিচ্ছুটি করতে পারেননি! এ কি সম্ভব নাকি? সাবমেরিনের সামনে তো লেখকের এই নৌকা নস্যি! জার্মান সাবমেরিন ধ্বংসের এমন আকাশকুসুম কল্পনায় স্ত্রী মার্থা মন্তব্য করেছিলেন, এটি লেখার টেবিলে না বসার অজুহাত আর সমুদ্রে বসে মদ পানের মহড়া ছাড়া আর কিছুই নয়!
ফেরার পথে বিদায়বেলায় রোসাকে বললাম, ‘পড়ে দেখবে একবার দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি?’ সে বলল, ‘আমি গল্প-উপন্যাস পড়িনি কখনো। শুধু মেডিকেলের বই পড়ি। মা খুব কষ্ট করে আমার পড়ার খরচ চালাচ্ছেন। আপাতত ডাক্তার হয়ে পরিবারের হাল ধরাই জীবনের প্রধান ব্রত। সাহিত্যচর্চা আপাতত বালখিল্য আমার জীবনে।’
আমি দেখছি অদম্য এক ভবিষ্যৎ ডাক্তার আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমিও পা বাড়ালাম হাভানায় আমার অস্থায়ী আবাসের দিকে।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top