যাপনচিত্র I স্বপ্ন ও স্বচ্ছতা
ফারিয়া হক। করপোরেট ব্যক্তিত্ব। নারী দিবস ঘিরে জানা যাক সফল এই ব্যাংকারের জীবনযাপনের গল্প
ফারিয়া হক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেছেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে, ২০০২ সালে। ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। এইচএসবিসি ব্যাংকের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে। তিন মাসের সেই ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম তাকে ব্যাংকিংকে একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে, সময়টা ২০০২ সাল। সেখানে প্রায় এক দশকের কর্মজীবনে হয়েছেন এইচএসবিসি প্রায়োরিটি ব্যাংকিং সিলেক্টের প্রধান কর্মকর্তা। ২০১১ সালে মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটানোর পর পুরোনো কর্মস্থলে আর ফেরেননি। ২০১৩ সালে যোগ দেন সিটি ব্যাংক লিমিটেডে, সিটিজেম প্রায়োরিটি ব্যাংকিং সেগমেন্টে। তার নেতৃত্বে সিটিজেম বাংলাদেশের প্রায়োরিটি ব্যাংকিংয়ের শীর্ষে এবং ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সাল থেকে তিনি সিটিজেমের পাশাপাশি সিটি ব্যাংক পিএলসির নারী সেগমেন্ট সিটি আলোর প্রধান হিসেবে কর্মরত। নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছেন তিনি।
কর্মব্যস্ত সপ্তাহের পর ছুটির দিনে পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য অনেকটাই মুখিয়ে থাকেন ফারিয়া হক। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স করেন ছুটির দিনেই। সপ্তাহজুড়ে ব্যস্ত থাকায় এমন অবসর দিনে সকালে একটু দেরিতেই বিছানা ছাড়েন। প্রাতরাশ ও মধ্যাহ্নভোজ পরিবারের সঙ্গেই। সাধারণত সুষম পুষ্টিকর খাবারকে গুরুত্ব দিলেও এদিন পরিবারের সবাই মিলে তাদের পছন্দের খাবার গ্রহণ করেন। নৈশভোজ বেশির ভাগ সময় বাইরে করা হয়। সন্তানেরা জাপানিজ ও ইতালিয়ান ফুড বেশ পছন্দ করে বলে সেগুলোই পায় অগ্রাধিকার। তবে মসলাদার ও টক স্বাদের মিশ্রণের জন্য ফারিয়ার পছন্দ থাই ফুড। ছুটির দিনে, বিশেষ করে শুক্রবার নেটফ্লিক্সে পছন্দের মুভি দেখেন।
বই পড়তে ভালোবাসেন; তবে নির্দিষ্ট ধরন বা লেখকে আটকে থেকে নয়। অবশ্য হোম ডেকর, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ট্রাভেল বুক, নেচারবিষয়ক বইয়ে আগ্রহ বেশি। গান তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। আশি ও নব্বইয়ের দশকের গান, শিল্পী ও গ্রুপগুলো বিশেষ পছন্দের তালিকায়। নিজের বাসা সমকালীন, নিগূঢ় ও আর্দি প্যাস্টেল শেডে সাজিয়েছেন। আছে চিত্রকর্ম সংগ্রহের শখ। বিমূর্ত চিত্রকর্ম বিশেষ পছন্দের, যেখানে আছে চিন্তার স্বাধীনতা। কিছু চিত্রকর্ম দেশের বাইরে ঘুরতে গিয়ে সংগ্রহ করেছেন। অন্দরমহলে আলো নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন।
ভ্রমণের জন্য মুখিয়ে থাকেন। ভ্রমণকে নিজস্ব কোয়ালিটি টাইম মনে করেন। ঘুরেছেন বিভিন্ন দেশ। সেসব দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মানুষের জীবনযাপনে মোহিত তিনি। বেশি মুগ্ধ করেছে মালদ্বীপ। কাশ্মীরের পাশাপাশি মালদ্বীপও তার কাছে ভূস্বর্গ মনে হয়। দেশটির প্রকৃতি, নীল পানি, সূর্যাস্ত তাকে বিমোহিত করে। নতুন জায়গা ও খাবার অন্বেষণে এই করপোরেট ব্যক্তিত্বের আগ্রহ বেশ।
ব্যক্তিজীবনে ফারিয়া হক বেশ অন্তর্মুখী। ব্যাংকিং পেশায় শীর্ষস্থানীয় পদে থাকায় এ থেকে হরদম বেরিয়ে আসতে হয়। তবে তাকে বহির্মুখী বলা যাবে না কিছুতেই! বরং ইন্ট্রোভার্ট ও এক্সট্রোভার্টের মাঝামাঝি বলা যেতে পারে। কাজের খাতিরে অনেক কথা বললেও ব্যক্তিজীবনে রিজার্ভ এবং লো প্রোফাইল থাকেন। সময় পেলেই হাঁটেন।
পরিবেশ, পরিস্থিতি ও লোকেশন বুঝে পরিধেয় নিয়ে নিরীক্ষা পছন্দ তার। অবশ্য যা-ই পরেন, তাতে মার্জিতবোধের উপস্থিতি থাকে। পছন্দের পোশাক সালোয়ার-কামিজ। প্রিয় রং সাদা। পোশাকের রঙের ক্ষেত্রে অবশ্য প্যাস্টেল শেডের প্রতি বিশেষ টান। অ্যাকসেসরিজ হিসেবে থাকে পার্ল নেকলেস। হালকা গন্ধের ফ্লোরাল সুগন্ধি ভালোবাসেন। সবচেয়ে প্রিয় অরেঞ্জ ব্লোজম ব্র্যান্ডের সুগন্ধি। জুতার ক্ষেত্রে পছন্দ প্ল্যাটফর্ম শু; কারণ, এটি তাকে আত্মবিশ্বাস, ভারসাম্য ও আরামের অনুভূতি দেয়।
ফ্যাশন ও স্টাইল প্রসঙ্গে ফারিয়া বলেন, ‘আমার জন্য এ এমন এক ব্যাপার, যা আত্মবিশ্বাস জোগায় এবং দেখতে ভালো লাগে। পাশাপাশি এটি আমাকে ভালো লাগা ও ইতিবাচক অনুভূতি দেয়।’
সময় পেলে রান্না করতে পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে পছন্দের তালিকায় থাকে বিদেশি খাবার। রান্না তার কাছে সময় কাটানোর একটি ভালো পন্থা। ব্রাউনি, চিজ কেক থেকে শুরু করে যেকোনো ডেজার্ট তার হাতে ভালো হয় বলে কাছের মানুষদের অভিমত। করোনা অতিমারির সময় সন্তানদের আবদার মেটাতে বাসায় একটি কুকুর পোষা শুরু করেন। নাম স্পার্কেল।
‘জীবনে যা-ই করি, তা উপভোগের চেষ্টা থাকে। ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে চলার পথে শুধু ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার নয়; বরং সমাজ ও সম্প্রদায়ের জন্য অবদান রাখতে চাই। আমার টিম নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। অন্যদের জীবনে ভ্যালু ক্রিয়েট করতে পারাটাও গুরুত্বপূর্ণ।’—এমনটাই জীবনদর্শন তার।
বললেন, শুরুর দিকে ক্যারিয়ার নিয়ে তেমন পরিকল্পনা ছিল না। প্রথম কর্মস্থল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে হওয়ায় সেখানে অনেক নারী কর্মী পেয়েছিলেন, যা তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার মা লতিফা হক একজন স্বনামধন্য নারী উদ্যোক্তা; যিনি ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে বিউটি স্যালন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে শতাধিক নারী কাজ করতেন। অন্যদিকে বাবা শফিকুল হক হীরা ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক। মা-বাবা তাকে নানাভাবে প্রেরণা জুগিয়েছেন। পৈতৃক ভিটা সিলেটে হলেও ফারিয়া বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে; পড়েছেন চিটাগাং গ্রামার স্কুলে (সিজিএস)।
নারী ব্যাংকিং প্রধান হিসেবে নারীদের জন্য ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলেন, ‘ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য কয়েকটি গুণ আবশ্যক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেকে বিশ্বাস করা, নিজের চাওয়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা, কাজের প্রতি আবেগ ও আন্তরিকতা। সর্বোপরি, বড় স্বপ্ন দেখা চাই; তবেই তা বাস্তবে রূপ নেবে। কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। অন্যদের দেখেও শিখতে হবে।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন