skip to Main Content

দেহযতন I নারী নৈপুণ্য

সামগ্রিকভাবে শরীরচর্চা নারী-পুরুষনির্বিশেষে অভিন্ন রকমের উপকারী হলেও ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ব্যায়াম নারীদের জন্য একান্ত সহায়ক। সুস্থ থাকতে, সুনিপুণ দেহ ধরে রাখতে

শারীরিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে শরীরচর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে নারীদের জন্য। কেননা, পুরুষের তুলনায় তাদের জীবনজুড়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন বেশি ঘটতে থাকে। নিয়মিত শরীরচর্চা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, মুড ভালো ও এনার্জি বুস্ট করার পাশাপাশি ক্রনিক ডিজিজের ঝুঁকি কমাতে কাজে দেয়। নারীদের বিশেষ কিছু ব্যায়ামের পরামর্শ জানা গেল সার্টিফাইড ফিটনেস কোচ সাদিয়া শীলার কাছ থেকে।
কার্ডিওভাসকুলার
কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে হায়ার লেভেল ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি, এক্সারসাইজ ট্রেনিং ও সার্বিক কার্ডিও রেসপিরেটরি ফিটনেসের গুরুত্ব অনেক। শীলা বলেন, কার্ডিওভাসকুলার এক্সারসাইজ, যা অ্যারোবিক এক্সারসাইজ নামেও পরিচিত, হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি সামগ্রিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। এই দেহচর্চা হৃৎস্পন্দন, রক্তসঞ্চালন ও ফুসফুসের সক্ষমতা বাড়ায়। এমন কিছু কার্যকর কার্ডিও এক্সারসাইজের প্রতি জোর দিয়েছেন এই ফিটনেস এক্সপার্ট।
 রানিং ও জগিং: সাদিয়া শীলার মতে, দৌড়ানো হলো উচ্চ স্তরের শারীরিক ক্রিয়াকলাপের একটি জনপ্রিয় রূপ, যা শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। ক্যালরি বার্ন করা, কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো এবং পায়ের পেশি শক্তিশালী করতে রানিং ও জগিং বেশ কাজে দেয়। এ ক্ষেত্রে আউটডোরে কিংবা ট্রেডমিলে ইচ্ছামাফিক দৌড়াতে ও জগিং করতে পারেন। মেয়েদের জন্য এসব এক্সারসাইজ মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ ও পিএমএস (প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম) জনিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
 সাইক্লিং: জয়েন্টগুলোতে মৃদু চাপ ফেলতে এই লো-ইম্প্যাক্ট এক্সারসাইজ সক্ষম। শরীরের নিচের অংশের পেশি, বিশেষ করে কোয়াড্রিসেপ, হ্যামস্ট্রিং ও কাফগুলোকে শক্তিশালী করে। স্টেশনারি বাইক কিংবা আউটডোর সাইক্লিং—যেকোনোটিই হতে পারে দারুণ অপশন। পরিবার ও পারিবারিক কাজ সামলানোর পাশাপাশি সাইকেল চালানো একজন নারীর জন্য ফিট থাকার বেশ সুবিধাজনক উপায় হিসেবে বিবেচিত। শীলা জানান, হার্ট ফেইলিওর রোগীদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, তিন বছরের বেশি সময় ধরে প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচবার অ্যারোবিক এক্সারসাইজ (হাঁটা কিংবা সাইকেল চালানো) করলে হার্টের সমস্যা ৬০-৭০ শতাংশ রিকভার হতে পারে, যা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের সম্ভাবনা অনেকাংশে বাড়ায়।
 সুইমিং: এটি ফুল বডি ওয়ার্কআউট, যা কার্ডিও ও স্ট্রেন্থ ট্রেনিংয়ের একটি সুন্দর সমন্বয়। যেসব নারীর জয়েন্টের প্রবলেম আছে, তাদের জন্য বিশেষ উপকারী। কারণ, সুইমিং জয়েন্টের ওপর চাপ কমাতে কাজে দেয়। এ ছাড়া কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি শরীরে নমনীয়তা তৈরি এবং মাসল টোন করে। অন্যান্য এক্সারসাইজের তুলনায় সুইমিং শরীরের ওপর খুব বেশি প্রেশার ক্রিয়েট করে না এবং এটি ছেলে-মেয়েনির্বিশেষে যে কারও জন্য পারফেক্ট। গর্ভবতী থাকা অবস্থায় নারীদের এ-সম্পর্কিত অস্বস্তি কমানোর জন্য সাঁতারকে একটি দুর্দান্ত অপশন হিসেবে গণ্য করা হয়।
স্ট্রেন্থ ট্রেনিং
সার্বিক মাসল তৈরি এবং তা বজায় রাখার জন্য স্ট্রেন্থ ট্রেনিং ভীষণ গুরুত্ববহ। এটি মেটাবলিজম ও বোন ডেনসিটি বাড়াতে এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমাতে কাজ করে। নারীদের কিছু কার্যকর স্ট্রেন্থ ট্রেনিং এক্সারসাইজের পরামর্শ দিয়েছেন সাদিয়া শীলা।
 ওয়েট লিফটিং: সামগ্রিক মাসল তৈরি করতে এবং স্ট্রেন্থ বাড়াতে এটি কার্যকরী। অনেক নারীই বাল্কিং আপ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন, যেখানে ওয়েট লিফটিং একটি লিন ও টোনড বডি পেতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে হালকা ওয়েট দিয়ে চর্চা শুরু করা এবং স্ট্রেন্থের বৃদ্ধি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে ওজন বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। স্কোয়াট, ডেডলিফট এবং বেঞ্চ প্রেসের মতো কম্পাউন্ড এক্সারসাইজের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন, যা একই সঙ্গে একাধিক মাসল গ্রুপের জন্য কাজ করে। ওয়েট লিফটিংয়ের সঙ্গে স্ট্রেন্থ ও রেজিস্ট্যান্স এক্সারসাইজ করা যায়।
 বডিওয়েট: পুশ-আপ, পুল-আপ ও স্কোয়াটের মতো বডিওয়েট এক্সারসাইজ কোনো ধরনের ইক্যুইপমেন্টের প্রয়োজন ছাড়াই শরীরের স্ট্রেন্থ বাড়ানোর জন্য বেশ কাজের। যেকোনো স্থানে ও পরিমাণে এর চর্চা করা সম্ভব। বিশেষত বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত নারীদের শরীর ফিট রাখতে এই চর্চাগুলো উপযুক্ত। প্রচলিত এক্সারসাইজের তুলনায় বডিওয়েট এক্সারসাইজগুলো সেন্সরি-মোটর ফাংশন এবং প্যারাপ্লেজিক স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকর হিসেবে ইতিমধ্যে প্রমাণিত।
 রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড: এ হলো বিভিন্ন টুলস, যা বিশাল পরিসরে মোশন রেজিস্ট্যান্স তৈরি এবং স্ট্রেন্থ ট্রেনিংয়ের জন্য শরীরকে উপযোগী করে তোলে। সহজে বহনযোগ্য এই টুলগুলো বিভিন্ন মাসলগ্রুপ; যেমন গ্লুটস, থাই ও আর্মসের স্ট্রেন্থ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইলাস্টিক রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড এক্সারসাইজ নারীদের জেশ্চার, পশ্চার ও বডি কম্পোজিশন ঠিক করতে পারে। গবেষণা অনুসারে, এই ট্রেনিং মাসল মাস বাড়িয়ে শরীরের চর্বি কমাতে সহায়ক।
 পালাটেস: শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে একটি জনপ্রিয় ব্যায়াম। মূলত স্ট্রেন্থ, ফ্লেক্সিবিলিটি ও সামগ্রিক বডি কন্ডিশনের ওপর জোর দেয়। এই দেহচর্চা নারীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী; কারণ, এটি পেলভিক ফ্লোর স্ট্রং ও পশ্চার ঠিক করার পাশাপাশি বডি অ্যাওয়ারনেস বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, যা ওভারঅল হেলথ বেনিফিট এনে দেয়। তা ছাড়া শরীরব্যথা কমানোর সঙ্গে সঙ্গে লোয়ার বডি এন্ডুরেন্স এবং উন্নত জীবনধারা পেতেও সহায়তা করে।
ফ্লেক্সিবিলিটি ও ব্যাল্যান্স
মোবিলিটি ও ইনজুরি প্রিভেনশনের জন্য প্রত্যেকের ফ্লেক্সিবিলিটি ও ব্যাল্যান্স এক্সারসাইজ অপরিহার্য। শীলা মনে করেন, এই এক্সারসাইজগুলো রেঞ্জ অব মোশন বাড়ায়, বেটার পশ্চারের নিশ্চয়তা দেয় এবং রিলাক্সেশন প্রমোট করে।
 স্ট্রেচিং: নিয়মিত স্ট্রেচিং ফ্লেক্সিবিলিটি বজায় রাখতে এবং মাসলের টাইটনেস দূর করতে সহায়ক। এ ক্ষেত্রে রুটিনে ডাইনামিক স্ট্রেচিং (ওয়ার্কআউটের আগে) এবং স্ট্যাটিক স্ট্রেচিং (ওয়ার্কআউটের পরে)—উভয়ই অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। হ্যামস্ট্রিং, কোয়াড্রিসেপস ও কাঁধের মেইন মাসলগুলোকে স্ট্রেচিংয়ের সময় বেশি গুরুত্ব দেওয়া চাই। নারীরা মেনস্ট্রুয়াল ক্র্যাম্প ও ব্যাক পেইন দূর করার জন্য স্ট্রেচিং রুটিন করে উপকার পেতে পারেন। স্নায়ুতন্ত্রের ওপরও স্ট্রেচিংয়ের বেশ প্রভাব রয়েছে।
মাইন্ড-বডি
মাইন্ড-বডি এক্সারসাইজ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এগুলো রিলাক্সেশনে সহায়ক; শারীরিক ও মানসিক স্ট্রেস কমানোসহ সামগ্রিক সুস্থতায় ভূমিকা রাখে।
 মেডিটেশন: যদিও এটি ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ নয়, তবে মন-শরীর—উভয়ের জন্যই অপরিহার্য। রুটিনে মেডিটেশন অন্তর্ভুক্ত করা থেকে উঠতে পারে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের কমপ্লিমেন্ট। কেননা, মেডিটেশনের উপকারিতার মধ্যে রয়েছে স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন ও পেইন কমানো এবং মেমোরি ও এফিশিয়েন্সি বাড়ানো। শারীরবৃত্তীয় সুবিধার মধ্যে রয়েছে ব্লাড প্রেশার, হৃৎস্পন্দন, ল্যাকটেট, কর্টিসল এবং এপিনেফ্রিন, মেটাবলিজম, ব্রেথিং প্যাটার্ন, অক্সিজেন ইউটিলাইজেশন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ইলিমিনেশন, মেলাটোনিন, স্কিন রেজিস্ট্যান্স এবং ব্রেনে ব্লাড ফ্লো প্রভৃতিতে ইতিবাচক উন্নতি ঘটানো।
 ব্রিদ ওয়ার্ক: এটি ব্রিদিং প্রসেস নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে মানসিক, আবেগাত্মক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
সাবধানে সামাল
সাদিয়া শীলা বলেন, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যায়ামকে বিবেচনা করা চাই। নারীদের ফিটনেসের চাহিদা তাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে।
 বয়ঃসন্ধিকাল: এ সময়েই হেলদি এক্সারসাইজের অভ্যাস গড়ে তোলা শ্রেয়। কার্ডিও, স্ট্রেন্থ ট্রেনিং ও ফ্লেক্সিবিলিটি এক্সারসাইজের সংমিশ্রণ গুরুত্বপূর্ণ। গ্রুপ ওয়ার্ক এবং সেলফ কনফিডেন্সকে উৎসাহিত করে, এমন খেলাধুলা ও শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া চাই।
 গর্ভাবস্থা: গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস পার হলে তুলনামূলক হালকা এবং প্রেশার কম পড়ে—এ ধরনের এক্সারসাইজ বেছে নেওয়া মঙ্গল। হাঁটা, সাঁতার কাটা এবং প্যারেন্টাল ইয়োগা হতে পারে চমৎকার বিকল্প। নিয়মিত ব্যায়াম গর্ভবতী নারীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা বাড়ায়।
 প্রসব-পরবর্তী: এ সময়ে এক্সারসাইজ নারীদের স্ট্রেন্থ ফিরে পেতে কাজে দেয়। হাঁটা ও পেলভিক ফ্লোর মতো হালকা এক্সারসাইজ দিয়ে শুরু করা উত্তম। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর, ধীরে ধীরে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং ও কার্ডিও এক্সারসাইজ শুরু করা যেতে পারে। প্রসব-পরবর্তী এক্সারসাইজ শুরু করার আগে একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া আবশ্যক।
 মেনোপজ: এ সময়ে নারীরা মেটাবলিজম, বোন ডেনসিটি এবং মাসল পরিবর্তন অনুভব করতে পারেন। বোন হেলথ বজায় রাখতে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং ও ওয়েট লিফটিং এক্সারসাইজ গুরুত্বপূর্ণ। ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং সামগ্রিক সুস্থতা বজায় রাখতে কার্ডিও ও ফ্লেক্সিবিলিটি এক্সারসাইজ করা চাই। মেনোপজ পরিবর্তন এবং মেনোপজ-পরবর্তী ওয়ার্কআউট ওজন বৃদ্ধি প্রতিরোধ, হাড়কে শক্তিশালী করা এবং মাসল বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমানোর সুবিধা দেয়।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top