ফিচার I সেহরির টেবিলসজ্জা
পবিত্র রমজান মাসে সেহরি শুধু খাবারের আয়োজন নয়, এটি এমন একটি মুহূর্ত; যখন পরিবার-পরিজন একত্র হয়ে রোজার প্রস্তুতি নেন। এই প্রশান্তিময় মুহূর্তকে আরও সুন্দর ও স্মরণীয় করে তুলতে টেবিলের সঠিক সজ্জা গুরুত্বপূর্ণ। সেহরির সময়ের সঠিক পরিবেশ ও টেবিলসজ্জা শুধু চোখের আরামই নয়, বরং এটি ইবাদতের প্রতি মনোযোগ ও প্রশান্তি বাড়ায়
রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক পবিত্র সময়, যখন সেহরি ও ইফতারের আয়োজন বিশেষ গুরুত্ব পায়। সেহরি শুধু খাবারের সময় নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও প্রশান্তির মুহূর্তও বটে। এই সময়কে আরও অর্থবহ করে তুলতে সুন্দর ও পরিকল্পিত টেবিলসজ্জার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চমৎকারভাবে সাজানো একটি সেহরির টেবিল শুধু চোখের আরাম নয়, খাবারের প্রতি আগ্রহও বাড়িয়ে দেয়।
আলোর মৃদু ছোঁয়া, পরিপাটি ক্রোকারিজ এবং পরিমিত ফুলের সুবাস মিলিয়ে যদি টেবিলটি সাজানো যায়, তবে সেহরির পরিবেশ হয়ে উঠতে পারে আরও মনোমুগ্ধকর ও প্রশান্তিদায়ক। সুন্দরভাবে সাজানো সেহরির টেবিল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্প্রীতি ও আনন্দের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, যা রমজানের পবিত্রতা ও মহিমাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। জেনে নিতে পারেন কীভাবে সেহরির টেবিলকে সৃজনশীলভাবে সাজানো সম্ভব।
সঠিক পরিবেশ তৈরি
সেহরির পরিবেশ হওয়া চাই শান্ত ও প্রশান্তিকর। তাই ঘরে উষ্ণতা ও প্রশান্তির ছোঁয়া আনতে পারেন। হালকা সুগন্ধি মোমবাতি, ধূপ বা এসেনশিয়াল অয়েলের সুবাস পরিবেশকে আরও স্নিগ্ধ করে তুলতে পারে। কোনো সাউন্ড সিস্টেমে কোরআন তিলাওয়াত মৃদু ভলিউমে বাজিয়ে রাখতে পারেন, যা সেহরির আবহকে আরও নিগূঢ় করে তুলবে।
টেবিল ক্লথ ও রানার নির্বাচন
সেহরির টেবিল সাজানোর প্রথম ধাপ হলো একটি উপযুক্ত টেবিল ক্লথ নির্বাচন করা। হালকা রঙের সুতির বা লিনেনের টেবিল ক্লথ ব্যবহার করলে টেবিলে একটি পরিপাটি ও প্রশান্তিময় আবহ সৃষ্টি হয়। সাদা, প্যাস্টেল বা হালকা নীল রঙের টেবিল ক্লথ বেশ মানানসই। এ ছাড়া একটু ভিন্নতা আনতে চাইলে ইসলামিক মোটিফ বা ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনের টেবিল রানার যোগ করতে পারেন।
পাত্র ও ক্রোকারিজের সমন্বয়
সেহরির খাবার হালকা হলেও পরিবেশনের মধ্যে সৌন্দর্য থাকা জরুরি। সাদা সিরামিক বা পোরসেলিনের প্লেট, কাপ ও বোল ব্যবহার করলে খাবারের সৌন্দর্য আরও ফুটে ওঠে। খেজুর বা ফল সাজানোর জন্য কাঠের বা কাচের পাত্র ব্যবহার করুন, যা খাবারের স্বচ্ছন্দ ও শৈল্পিকতা বাড়াবে। মেটালিক ফিনিশের ট্রে বা ব্রাসের পাত্র ব্যবহার করলে আরও অভিজাত লুক দেবে। পরিবার বা অতিথিদের জন্য আলাদা সেট থাকলে তা পরিবেশনকে আরও মার্জিত করে তুলবে।
আলোকসজ্জা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি
সেহরির সময়টাতে হালকা আলো থাকা বাঞ্ছনীয়। খুব বেশি উজ্জ্বল আলো ব্যবহার না করে কোমল আলো ব্যবহার করুন, যা ঘরের পরিবেশ স্নিগ্ধ রাখবে। ছোট ছোট টেবিল ল্যাম্প, ল্যান্টার্ন বা কিছু মোমবাতি ব্যবহার করতে পারেন। আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী সাজের জন্য মোমবাতি হতে পারে দারুণ এক সংযোজন। চাইলে ফেইরি লাইটও ব্যবহার করা যেতে পারে, যা টেবিলের চারপাশে একটি মায়াবী পরিবেশ তৈরি করবে।
ফুল ও প্রাকৃতিক উপাদান
টেবিলে কিছু তাজা ফুল রাখলে পুরো পরিবেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা বা জারবেরা ফুলের ছোট ছোট তোড়া ব্যবহার করতে পারেন। চাইলে ছোট পটেড প্ল্যান্টও রাখতে পারেন টেবিলের এক কোণে, যা সবুজের এক ঝলক এনে দেবে।
ঐতিহ্যবাহী থিম
সেহরির টেবিলের সাজ থিমভিত্তিক হলে মন্দ হয় না। এর শৈল্পিক ছোঁয়া মনে এনে দেবে বাড়তি প্রশান্তি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে মাটির তৈরি প্লেট, পিতলের গ্লাস এবং নকশা করা কাপড়ের টেবিলম্যাট ব্যবহার করতে পারেন। জামদানি কাপড়ের রানার ব্যবহার করলে এটি আরও দৃষ্টিনন্দন লাগবে। এটি সেহরির সময় একটি দেশীয় আবহ তৈরি করবে।
মিনিমালিস্ট থিম
সাদা বা ধূসর রঙের ক্রোকারিজ, মার্বেল টেক্সচারের ট্রে ও হালকা রঙের কাপড়ের টেবিল ম্যাট ব্যবহার করতে পারেন। কম উপকরণ দিয়ে সাজানো একটি টেবিলও অত্যন্ত নান্দনিক হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের ছোঁয়া
যদি মধ্যপ্রাচ্যের আভিজাত্য আনতে চান, তাহলে সোনালি বা রুপালি ডিজাইনের ক্রোকারিজ, জ্যামিতিক নকশার টেবিল ক্লথ এবং ল্যান্টার্ন ব্যবহার করতে পারেন।
ইসলামিক মোটিফের সজ্জা
রমজান মাসের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে চাইলে টেবিলে ইসলামিক মোটিফের কিছু শোপিস রাখতে পারেন, যেমন আরবি ক্যালিগ্রাফি সংবলিত মোমবাতি হোল্ডার কিংবা একটি ছোট কোরআন স্ট্যান্ড। এটি শুধু পরিবেশকে পবিত্র করার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের মাঝেও একটি আধ্যাত্মিক অনুভূতি তৈরি করবে।
খাবার পরিবেশনের সৃজনশীলতা
সেহরির টেবিল সাজানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো খাবার পরিবেশন। বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার সুন্দরভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করুন। খেজুর, বাদাম, টক দই, ফলমূল, রুটি ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপকরণ সুন্দর বাটিতে পরিবেশন করা শ্রেয়। মাল্টিলেয়ার্ড সার্ভিং ট্রে ব্যবহার করতে পারেন, যাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার একসঙ্গে পরিবেশিত হয় এবং টেবিলটিও নান্দনিক দেখায়।
পরিবার অনুযায়ী ভিন্নতা
পরিবারের সদস্যদের পছন্দ অনুযায়ী টেবিল সাজানো হলে সেহরির পরিবেশ আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। শিশুদের জন্য রঙিন প্লেট ও আকর্ষণীয় খাবার রাখা যেতে পারে। প্রবীণদের জন্য সহজে খাওয়ার উপযোগী খাবার এবং আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উত্তম। বিশেষত যেসব সদস্যের ডায়াবেটিস বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা আছে, তাদের জন্য পুষ্টিকর ও স্বল্প চর্বিযুক্ত খাবারের ব্যবস্থা রাখা চাই। এ ছাড়া অতিথিদের জন্য বাড়তি একটি সার্ভিং ট্রে ও সুন্দর গ্লাস সেট রাখতে পারেন।
ব্যক্তিগত স্পর্শ
পরিবারের সবার জন্য ব্যক্তিগত স্পর্শ যোগ করলে সেহরি আরও আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, মাঝেমধ্যে প্রত্যেক সদস্যের জন্য একটি ছোট্ট কার্ড রাখতে পারেন, যেখানে শুভেচ্ছা বার্তা লেখা থাকবে। পরিবারের জন্য একটি বিশেষ মেনু তৈরি করতে পারেন, যেখানে প্রতিদিন একটি নতুন আইটেম যোগ করা হবে। এতে সেহরির পরিবেশ আরও উপভোগ্য হয়ে উঠবে।
সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা
সেহরির টেবিল সুন্দর রাখার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন রাখাও জরুরি। খাবার গ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই টেবিল পরিষ্কার করা এবং সবকিছু যথাস্থানে গুছিয়ে রাখা চাই। এতে প্রতিদিন সেহরির টেবিল সাজাতে বাড়তি ঝামেলায় পড়তে হবে না এবং পরদিনও একই প্রশান্তিময় পরিবেশ বজায় থাকবে। প্রতিদিন টেবিল ক্লথ ও রানার ধুয়ে রাখলে টেবিল আরও পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয় থাকবে।
একটু যত্ন ও পরিকল্পনা করলেই সেহরির টেবিলকে পরিণত করা যায় একটি আনন্দময় ও প্রশান্তিময় আবহে।
স্বুর্ণা মেহজাবীন
ছবি: ইন্টারনেট