skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I নাজাতের তাৎপর্য

অবিশ্বাসীরা দুনিয়াতে যতই ভোগ-বিলাস ও বিত্ত-বৈভবের মধ্যে জীবনযাপন করুক, তারা হৃদয়ের প্রশান্তি অর্জন থেকে সব সময় বঞ্চিত থাকে

রোজা বা রমজান। আরবি ‘রমাদান’ শব্দ থেকে উৎপত্তি। ইসলাম ধর্মের তৃতীয় স্তম্ভ। সূর্যোদয়ের বেশ আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনাহারে থাকা এবং যেকোনো পাপাচার থেকে বিরত থাকা—ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ভীষণ কাঙ্ক্ষিত এ মাস। হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব’ [মুসলিম ২৭৬০]। রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস। পবিত্র এ মাসে যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন না, তার রোজা পালন অর্থহীন হিসেবে গণ্য হয়। আরবি ‘তাযকিয়াতুন নুফুস’-এর বাংলা পরিভাষা আত্মশুদ্ধি। এই আত্মশুদ্ধিকে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অভিহিত করা হয়েছে ‘ইহসান’ ও ‘ইখলাস’ নামেও। সহিহ হাদিসে এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি এটা সম্ভব না হয়, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে দেখছেন, এ কথা মনে করবে’ [সহিহ মুসলিম-১০২, বোখারি-৫০]। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘এটি (রমজান) সংযমের মাস আর সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত’ [মিশকাত]। সার্বিকভাবে, রমজান মাস হলো রহমত, বরকত, সৌভাগ্য, সংযম, আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য এবং মানুষের সঙ্গে সহানুভূতি ভাগ করে নেওয়ার মোক্ষম সময়। একে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস হিসেবেও গণ্য করা হয়।

দুই
নাজাত মানে মুক্তি। সরল ব্যাখ্যায়, মুক্তি পাওয়া, মুক্তি দেওয়া, মুক্ত হওয়া এবং মুক্ত করা। রমজানের নাজাতের অর্থ, এ মাসে পাপ-পঙ্কিলতা, গুনাহ ও আবিলতা থেকে মানুষ মুক্ত হবে। আরও মুক্ত হবে জাহান্নাম এবং পাপের আকর্ষণ থেকে। ইসলাম ধর্ম অনুসারে, পবিত্র রমজান মাসে জিন, শয়তানকে বন্দী রাখা হয়। কিন্তু মানুষের অন্তস্তলের শয়তান সত্তা এবং নফস অর্থাৎ ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) তখনো সক্রিয় থাকে। এর ফলে পাপাচার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া মানুষের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভের জন্য শুরুতেই ষড়রিপুর তাড়না থেকে নিজেকে মুক্ত করা চাই। অন্যদিকে, অন্তস্তলের শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে সৎ সঙ্গ আবশ্যক। আল কোরআনে সুরা ‘আত-তাওবা’য় মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’

তিন
রিপুর সমন্বয়ে গঠিত মানবসত্তার অবস্থা তিনটি। নাফসে আম্মারা তথা পাপাকৃষ্ট সত্তা, নাফসে লাউওয়ামা তথা অনুতপ্ত সত্তা এবং নাফসে মুতমাইন্না তথা প্রশান্ত আত্মা। প্রথমটি এমন সত্তা, যা পাপে অনুরক্ত এবং পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। আল কোরআনে সুরা ‘ইউসুফ’-এর ৫৩ নং আয়াতে রয়েছে, ‘আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না। মানুষের মন অবশ্যই মন্দকর্মপ্রবণ। কিন্তু সে নয়, যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ অর্থাৎ, যার প্রতি আল্লাহর রহমত ও অনুকম্পা রয়েছে, মনের কুপ্রবণতা থেকে তিনিই সুরক্ষিত থাকেন; যেমন ইউসুফ (আ.)-কে সুরক্ষিত রেখেছেন আল্লাহ। অন্যদিকে, দ্বিতীয় সত্তাটি শয়তানের ধোঁকা কিংবা রিপুর তাড়না অথবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে সাময়িক পাপ করলেও লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সুরা ‘কিয়ামাহ’র দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আরও শপথ করি সেই মনের, যে নিজেকে ধিক্কার দেয়।’ সরল ব্যাখ্যায়, এমন মানুষ ন্যায় ও ভালো কাজ করলেও নিজেকে তিরস্কার করেন, তেমন কাজ আরও বেশি করেননি বলে। আবার, কোনো অন্যায় ও মন্দ কাজ করলেও তিরস্কার করেন, তা থেকে বিরত থাকেননি বলে। দুনিয়াতে যাদের বিবেক সচেতন, তাদের আত্মাও তাদেরকে তিরস্কার করে। অন্যথায় আখেরাতে তো সকলের আত্মাই তিরস্কার করবে। তৃতীয় ও শেষ সত্তাটি পাপের প্রতি বিরাগ এবং নেকির প্রতি অনুরাগের অধিকারী। এ প্রসঙ্গে সুরা ‘আল-ফাজর’-এর ২৭ থেকে ৩০ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। সুতরাং তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’ এই সুরার পূর্ববর্তী, অর্থাৎ ২৩ থেকে ২৬ নং আয়াতে অবিশ্বাসী কাফের-মুনাফিকদের কঠিন শাস্তির বর্ণনা শেষে এবার (২৭-৩০ আয়াতে) প্রকৃত বিশ্বাসী মুমিন নর-নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে। মুমিনদের হৃদয়কে এখানে সম্বোধন করা হয়েছে ‘প্রশান্ত আত্মা’ বলে। কেননা, অবিশ্বাসীরা দুনিয়াতে যতই ভোগ-বিলাস ও বিত্ত-বৈভবের মধ্যে জীবনযাপন করুক, তারা হৃদয়ের প্রশান্তি অর্জন থেকে সব সময় বঞ্চিত থাকে। অন্যদিকে, প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি সুখে-দুঃখে সব সময় আল্লাহর ওপরে ভরসা রাখেন এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকেন। নাজাতের মর্মার্থ হলো, সকল দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত করে ও পবিত্র রেখে এবং সদ্‌গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে মুক্তি নিশ্চিত করা; অর্থাৎ পাপাকৃষ্ট ও অনুতপ্ত সত্তা থেকে প্রশান্ত আত্মায় পরিণত হওয়া।

চার
ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, নাজাত বা মোহমুক্তির উপায় হলো তওবা ও ইস্তিগফার করা। তওবা মানে পাপ ছেড়ে পুণ্যে মনোনিবেশ করা। অন্যদিকে, ইস্তিগফার হলো কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুনরায় ওই অপরাধ বা পাপ না করার অঙ্গীকারবদ্ধ ও দৃঢ়সংকল্প হওয়া। এমন মানবজীবন অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় পবিত্র রমজান মাস। তাই শুধু সাধনার জন্য সাধনা নয়; বরং যথার্থভাবে উপলব্ধি করে সিয়াম সাধনা করা শ্রেয়।

পাঁচ
নাজাতের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করার এবং সেই অনুসারে জীবন সাজানোর সুযোগ গ্রহণের সৌভাগ্য সবার হোক, মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা।
সবার জীবনে শান্তি আসুক। জীবন অর্থবহ হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top