skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I রূপসী রাবাত

রাজধানী। তবু ভিড় নেই অত। ছড়িয়ে আছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। নীল সাগর। স্থানীয় বাজারে ঐন্দ্রজালিক পণ্যসম্ভার। মরক্কোর রাজধানী ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান

বাসে চেপে আসছি তাঞ্জিয়ের থেকে। অসামান্য সুন্দর এক দেশ মরক্কো। পুরো দেশ ঘুরে আমার গন্তব্য এখন রাজধানী। বাসে আমার পাশে যে ছেলে বসে আছে, সে বারবার জিজ্ঞেস করছে, ‘ঘাওয়া যাবে তুমি, ঘাওয়া?’ অবাক হই প্রতিবার। বলে কী! আমি তো যাব রাবাত। এ ঘাওয়া পেল কোথায়? পরে খেয়াল করে শুনলাম, সে আসলে রাবাতই বলছে; কিন্তু আরবি উচ্চারণ অন্য রকম হওয়ায় শুনতে একেবারে অন্য শব্দ মনে হচ্ছে।
এদিকে আমার জানালার পাশ দিয়ে বিশাল বিশাল সবুজের রত্নভান্ডার সরে সরে যাচ্ছে। পাশের ছেলেটি আলাপ জমাতে চাইলেও আমি জানালা থেকে সরে সরে যাওয়া তরমুজ আর হানি মেলনের খেতের দিকে চোখ দিলাম। জীবনে প্রথম হানি মেলনের খেত দেখছি। পাকা হানি মেলনে ভরে হলুদ হয়ে গেছে। পেছনে একটি নদী; স্বচ্ছ গাঢ় নীল রং তার। আর তারও পেছনে সবুজ পাহাড়ের বহর। এই অশেষ পাহাড়ই মরক্কোজুড়ে আমার সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে।
হানি মেলন একধরনের গুল্মজাতীয় গাছ, তরমুজের মতোই। হানি মেলনের খেত শেষ হতেই দেখি, পাশাপাশি কয়েকটি পিকআপজাতীয় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশে স্তূপাকারে হানি মেলন রাখা। পিকআপে করে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাশে তরমুজের খেতে বিশাল আকারের তরমুজ ফলেছে। এই খেতের পেছনেও নীল নদী আর পাহাড়ের বহর। একটা নদী ঘিরে কত যে ফসল ফলে! আমাকে বিস্মিত করে সামনে হলুদ গমখেত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে পেছনের পাহাড়ের সঙ্গে। আমি মুগ্ধ নয়নে প্রকৃতির এই রহস্য দেখি। কিন্তু মাঝেমধ্যে পাশে বসে থাকা ‘ঘাওয়া’ ছেলেটির কথায় আমার মুগ্ধ হওয়ায় ছেদ পড়ছিল। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কী?’ জানতে চাইল, আমি ঘাওয়াতে নাকি তার আগের স্টপেজে নামব? বললাম, ঘাওয়াতেই নামব। সে আগের স্টপেজে নেমে যাবে। ঘাওয়া বা রাবাত এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে? মরক্কোর রূপ দেখতে দেখতে এতটা সময় পার হয়েছে, টেরই পাইনি।
ছেলেটি রাবাত শহরের টুইন সিটি সালেতে নেমে যাবে। আমাকে বারবার বলল, কোনো দরকার পড়লে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। মরক্কোর মানুষের অতি অতিথিপরায়ণতায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
রাবাতের অতি আধুনিক ঝকঝকে বাসস্টেশনে নেমে অবাক হয়ে গেলাম। স্টেশনটি দেখতে এয়ারপোর্টের মতো। কোনো কোনো দেশের এয়ারপোর্টও এত আধুনিক ঝাঁ-চকচকে আর সুন্দর হয় না। স্টেশনের বাইরে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম হোটেলে। হোটেলটি রাবাতের মেদিনাতে। মরক্কোর যেকোনো শহরের পুরোনো বাসস্থলকে মেদিনা বলা হয়। আদতে মেদিনা হলো পুরোনো শহর। মরক্কোর বেশির ভাগ শহরের মেদিনা ঘিরেই পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে।
মেদিনার কাছে আমার হোটেলটি বেশ সুন্দর এক বাগান দিয়ে ঘেরা। বাগানে চেয়ার-টেবিল পাতা আছে, পাখি ডাকছে; বাইরের গরম নেই। এই আবহাওয়া বাগানটিকে স্পর্শ করতে পারছে না; বাগানের ভেতরে বেশ শীতল ভাব। আমি এক কাপ মরোক্কান পুদিনা-চা পান করে এই মনোরম বাগান থেকে উঠে, হোটেলের চৌহদ্দি থেকে বের হয়ে ভাবলাম, মেদিনার সুক বা বাজারের দিকে যাই। মরক্কোর যেকোনো সুক খুব রঙিন আর নানা হস্তশিল্পের দোকানে ভরপুর থাকে।
মরক্কোর পথঘাট দেখলে আফ্রিকা মহাদেশ বলে আলবত মনে হবে না! মনে হয় ইউরোপের কোনো এক শহরে এসে নোঙর ফেলেছি। এত গোছানো; আর জনসংখ্যাও কম। হোটেল থেকে বেরিয়ে বেশি হাঁটতে হলো না। সামনেই সুকের রঙিন গলি চলে এলো। চোখের সামনে নানা শিল্প দেখে দিশেহারা হয়ে গেলাম। কী রেখে কী যে দেখি! একটা সুকে সাধারণত অনেক গলি থাকে। সামনের গলির মুখে যে দোকান, তাতে নানা রঙের মরোক্কান কার্পেট বা রাগ ঝোলানো আছে। প্রায় প্রতিটা কার্পেটেই জ্যামিতিক নকশা বোনা। হাতে বোনা বিভিন্ন আকারের এই কার্পেটগুলো মরক্কোর ঐতিহ্য বহন করে। শীতকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে, তাই মেঝেতে কার্পেট এবং তার ওপর গদি বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা বহুকাল ধরে এ দেশের ব্যারব্যার জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত। কার্পেটের দোকানের সামনে দোকানির সঙ্গে এক নারী খোশগল্পে মেতে উঠেছেন। মনে হচ্ছে, যেন কতকালের প্রিয় বন্ধু এরা। এদের পাশ দিয়ে দুপাশের সারি সারি কার্পেটের দোকানের মাঝের পেভমেন্ট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন স্থানীয় নারীরা। কেউ মরোক্কান কাফতান, কেউবা কাফতানের ওপর মাথায় একটা স্কার্ফ পরেছেন। এই বাজারে স্থানীয় মানুষজনও আসে বাজার করতে।
মরক্কোর বাজার সাধারণত একটা সরু গলির দুপাশে সারি সারি দোকান দিয়ে সজ্জিত থাকে। এ রকম আলাদা আলাদা পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গলি নিয়ে গড়ে ওঠে সুক। আমি এখন গলির কার্পেটের দোকানের শোভার মুগ্ধ যাত্রী। গলিতে যাতে সূর্য তেমন বাড়াবাড়ি করতে না পারে, সে জন্য মাথায় ওপর কাঠের ছাদ করা। সে ছাদের নানা জ্যামিতিক নকশা করা ফোকর গলে সূর্য এখন মেঝেতে আলোর নকশা কাটছে।
কার্পেটের বহর শেষ হলে শুরু হয় সিরামিক পণ্যের এক ঐন্দ্রজালিক জগৎ। এ এমন এক জগৎ, যেখানে প্রবেশ করা খুব সহজ; কিন্তু খালি হাতে বের হওয়া একেবারেই সহজ নয়। সাদার ওপর মরক্কোর নিজস্ব নকশা, হাতে পেইন্ট করা। কিছু সিরামিকের প্লেট, ওয়াল হ্যাংগিং, ফুলদানি, শোপিস ইত্যাদি আছে নীল বা সবুজ রঙের। এমন রুচিশীলতায় দেশটি পৃথিবীতে সবচেয়ে ওপরে অবস্থান করছে। পাশের গলিতে কাঠের তৈরি নানা জিনিসপত্র। চেয়ার, টুল, কর্নার টেবিল, শোপিস ইত্যাদি নানা খোদাইয়ে বা অঙ্কনে শোভা পাচ্ছে। পরের গলি হলো চামড়াজাত পণ্যের জন্য বরাদ্দ করা। বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, জুতা, বসার কুশন, জ্যাকেট…কী সাজিয়ে রাখা নেই এখানে! সব রঙের সব আকারের চামড়ায় তৈরি জিনিস যেন এদের সংগ্রহে থাকা চাই।
সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম এ দেশের জুতার কালেকশন দেখে। স্থানীয় ভাষায় পাম্প শু ধরনের জুতাকে বলে বাবোশ। এই বাবোশ যে কত রঙের, কত নকশার, কত দোকানে আছে, তা না দেখলে বোঝার উপায় নেই। বাবোশের এত ধরনের দোকান আছে, শুধু জুতা দিয়েই আলাদা একটা সুক তৈরি করা যাবে।
বাবোশের গলির পরে দেখা মিলবে পিতলের সূক্ষ্ম কারুকাজের ল্যাম্পের গলির। এই গলির সোনালি সৌন্দর্য কহতব্য নয়! চারদিক স্বর্ণ রঙে ঝলমল করছে। এখানে দিনের আলো প্রবেশ না করলেও চলবে! আমি ভেবেছিলাম, মরক্কো কঠোর মুসলিম দেশ; অথচ সুকের বিভিন্ন দোকানে হাতে আঁকা ছবি দেখে আমার ভুল ভাঙল। নানা রঙের ও আকারের নারী-পুরুষের আঁকা সারি সারি ছবি দোকানের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। শুধু যে শৌখিন জিনিসপত্রই আছে, তা নয়। এ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও আছে। আর আছে নারী-পুরুষের বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক কাফতান ও জেলাবা।
রঙিন সুক দেখে আমার কখনোই মনের ক্ষুধা মেটে না। এদিকে বেলা পড়ে এলো। কাছেই সমুদ্রসৈকত, হেঁটে সেখানে চলে এলাম। এখন অবধি যত সমুদ্রসৈকত দেখেছি, রাবাত তার মাঝে অন্যতম সেরা। রাজধানী হলেও কোনো ভিড় নেই। রাস্তায় গাড়ির জ্যাম বা হর্নের শব্দ নেই। পথঘাট এত পরিচ্ছন্ন, মনে হয় পটে আঁকা ছবি। আর সমুদ্রসৈকতে খুব বেশি মানুষ নেই। দু-একজন স্থানীয় মানুষ এদিক-সেদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একজন ইউরোপীয় তরুণীকে দেখলাম, সাঁতারের পোশাক পরে বিচে রোদ পোহাচ্ছেন। মরক্কো মুসলিম দেশ হলেও রক্ষণশীল নয়। অতিথিদের জন্য খুব বেশি বিধিনিষেধ নেই।
সূর্যাস্তের সময় অবধি রাবাত সৈকতের লাল থেকে ফিকে কমলা হওয়া দেখতে দেখতে অনেকখানি সময় পার হয়ে গেল। বিশাল বাগিচায় ঘেরা হোটেলে ফিরে এলাম আমি। এই হোটেলের আলাদা আকর্ষণ আছে। দেখতে সুদৃশ্য লা জারদিন বা মরক্কোর বিখ্যাত সব বাগানের মতো। এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাষা আরবি; তবে বহু বছর ধরে ফ্রেঞ্চ ভাষাও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। লা জারদিন আসলে ফ্রেঞ্চ শব্দ, যার অর্থ বাগান।
পরদিন সকালে হোটেলে মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী নাশতায় ছিল মরোক্কান রুটি, পনির, প্যানকেক, ফল, ডিম, মরোক্কান পেস্ট্রি ইত্যাদি। খেয়ে টেবিল ছেড়ে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়েছিল! আমি এখন যাব শহরের পুরোনো স্থাপনা ‘বাব এ ঔদায়া’ বা ‘বাব এ উদায়া’য়। আমার হোটেল থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্ব। গতকাল পাশের সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার পথে পড়েছিল; কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ভেতরে ঢুকিনি।
বাব এ উদায়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে। রাবাত শহরের তৎকালীন শাসক আবদেল মুমিন সাগরপারে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এটি শুধু দুর্গই ছিল না; তিনি এখানে কাসবা বা বসবাসের জন্য একটি মহল্লাও গড়েন। গতকাল বিশাল একটি দরজা আর তার পাথরের খোদাই দেখে অপলক তাকিয়ে ছিলাম। দরজাটি মিহরাব আকারের। মানে উপরিভাগ গোলাকার। বিশাল দরজাটি কাঠের; তবে পাথরের ফ্রেমে জ্যামিতিক নকশা খোদাই করা। দরজার কোনা ধরে ওপর থেকে নিচ অবধি আরবিতে আয়াত লেখা আছে।
এই বিশাল দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরের সরু পথে কবলস্টোন বিছানো। সামনে ঘুরে ভেতরে যেতেই একই দরজার ভেতরের অংশ চোখে পড়ল; যেন বহিরাংশের অবিকল ছবি। ঘুরে গিয়ে কাসবার পথ ধরলাম। দেখে মনে হচ্ছে অত্যাধুনিক মহল্লা। পথের দুপাশে সাদা রঙের একতলা ছোট ছোট বাড়ি, কাঠের দরজা আর জানালা। কী ছিমছাম আর শান্ত!
পথের প্রথমেই পড়ল টাইলস দেওয়া মসজিদের বারান্দার মতো একটি বারান্দা। কিন্তু এটি বারান্দা নয়; পথচারীদের হাত-মুখ ধোয়ার বা অজু করার স্থান। পুরো দেয়ালের টাইলসে সাদার ওপর নীল, সবুজ সূক্ষ্ম নকশা আঁকা। মাঝখানে পাশাপাশি দুটো অনুচ্চ পানির কল বসানো। এ দেশের পথচারীদের জন্য এখনো ভাবে সরকার। আগেকার দিনে পথচারীদের পানি পান বা বিশ্রামের জন্য আলাদা সরাইখানা রাজার পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হতো। সেই ঐতিহ্যের ধারা এখনো বজায় আছে। অন্তত হাতমুখ ধোয়ার স্থান তো আছে।
সামনেই পথের দুপাশে সারি সারি সাদা একতলা বাড়ি। অল্প কিছু বাড়ির সম্মুখভাগে স্যুভেনির শপ। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ছোট ছোট স্যুভেনির; যেমন ফ্রিজ ম্যাগনেট, ছোট ঝুড়ি, ছোট ছোট পেইন্টিং ইত্যাদি। বড় জিনিসপত্রের পসরা তো বসেছে বাব এ উদায়ার উল্টো দিকের মেদিনায়, গতকাল যা দেখে এসেছি।
আরেকটু সামনে দুর্গের মসজিদ। পেছনে চারকোনা সোনালি রঙের স্যান্ডস্টোন পাথরের অনুচ্চ মিনার না থাকলে অন্যান্য বাড়ির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতাম। খুবই সাধারণ বহিরঙ্গ; অন্যান্য সাদা বাড়ি দেখতে যেমন, ঠিক তেমনই। মসজিদের সামনে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। দরজার কাঠে নকশা খোদাই করা। দরজাটি আকারে অন্যান্য বাড়ির দরজার মতোই। জোহরের নামাজের আগে বোধ হয় দরজা খুলবে না। তাই আরেকটু এগিয়ে যেতে দেখি, ডানের পথটা দেখতে গ্রিসের সান্তোরিনি দ্বীপের পথের মতো লাগছে। কালবিলম্ব না করে আমি সান্তোরিনিসদৃশ পথের দিকে বুভুক্ষুর মতো এগিয়ে চললাম। মানুষের অনেক ধরনের ক্ষুধা বা তৃষ্ণা থাকে। কারও টাকাপয়সার তৃষ্ণা, কারও ভালো ভালো খাবারের খিদে, কারও আবার অন্য কিছু। আমার নতুন পথের প্রতি অপার তৃষ্ণা। নতুন পথের পানে আমি তৃষিতের মতো ছুটে যাই। আর যা পাই, তা অমূল্য। পাই নতুন এক দিগন্ত। আর এই পথের বাঁক ঘুরে পেলাম সাদা এক নতুন জগৎ, যার পথের দুদিকে সাগরের মতো নীল রঙের সারি সারি টবে সাজানো। এর ডানে-বাঁয়ে আরও গলি চলে গেছে, এ রাজ্য যেন শেষ হওয়ার নয়। কয়েকটা বাড়ি পরে সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।
মরক্কো পাহাড়ের কোলের দেশ। প্রায় প্রতিটি কাসবায় আমি এমন সিঁড়ি দেখেছি—যেন খেলার ছলে নেমে যাওয়া, আবার খেলতে খেলতে উঠে আসা যায় মহল্লার এক কোনা থেকে আরেক কোনায়। গলির দুপাশে যেমন নীল সাদা রঙের অবাধ আসা-যাওয়া আছে, তেমনি আছে নীল টবে সবুজ গাছের নীরবে রং ছড়ানো। সব বাড়ির কাঠের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ; হয়তোবা ট্যুরিস্টদের উৎপাতের কারণে। অবশ্য মরক্কোর পরিবারগুলো রক্ষণশীল হয়; তাদের নারীদের যে কেউ দেখে ফেলতে পারে না। পথেঘাটে ইচ্ছা করলেই নারী তো দূর কী বাত, পুরুষদের ছবিও তোলা যায় না। যস্মিন দেশে যদাচার, তাই আমি এ দেশের মানুষের ছবি তোলা থেকে নিবৃত্ত থাকি।
কাসবা থেকে আবার একই পথ ধরে বের হয়ে মূল পথ ধরলাম। কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে দেখি, সদর দরজার মতো একটা দরজার ওপাশে খোলা ছাদের মতো একটা জায়গা। সে দরজা যেন কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা আবাসিক এলাকা থেকে আমাকে বিশাল এক চত্বরে নিমেষে নিয়ে এলো। এ চত্বরে এখন নানা মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক ট্যুরিস্টও আছে। আর এই বিশাল চত্বর ছাদে দেয়াল দেওয়া। দেয়ালের ওপাশে অবিশ্বাস্য সুন্দর নীল অতলান্তিক সাগর। কী শান্ত আর স্থির হয়ে সে নীল চোখ তুলে চেয়ে আছে। সত্যি যেন এই দুর্গের একটি কোনা ছাড়া তার আর কোথাও যাবার নেই।
চত্বরের এক দিকে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। পাথরের চওড়া সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বাতাসের তোড়ে উড়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। পুরো দুর্গই পাথরে নির্মিত। সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নামতেই দেখি, সাগরের দিকে মুখ করা দেয়ালের ফোকরে সারি সারি কামান বসানো। সাগরপারে দুর্গ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা।
দুর্গের দেয়ালের কয়েকটা ফোকরে কামান নেই। ফোকরগুলো ছোট দেখালেও কাছ থেকে দেখতে একেকটি বিশাল আকারের জানালার মতো। নিচে তাকালে দেখা যাবে, অতলান্তিকের ঢেউ তীরে সজোরে আছড়ে পড়ছে। এই বিশালকায় কামানের জানালায় কলেজফেরত তিনটি মেয়ে বসে কিচিরমিচির করছে! আরেকটা জানালায় এক যুগল পিঠ ফিরিয়ে গুফতাগু করায় ব্যস্ত। আমার পেছনের সিঁড়িতেও একটি স্থানীয় যুগল হাত ধরে বসে আছে। ভালোবাসা সর্বত্র বিরাজমান। যেমন এখানে, তেমনি দুনিয়ার আরেক কোণে। ভালোবাসা সব জায়গায় রঙিন ফুলের মতো দৃশ্যমান, সুগন্ধের মতো অপ্রতিরোধ্য।
আমি ভালোবাসায় মগ্ন যুগল আর অন্যদের পেছনে ফেলে দুর্গের আরও নিচের ধাপের দিকে সিঁড়ি বেয়ে নামি। এই ধাপেও খোলা চত্বর আর তার দেয়ালে কামান বসানো আছে। দ্বাদশ শতাব্দীর কামান একটুও ক্ষয় হয়ে যায়নি। আমি দুর্গের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে দেখি আর বোঝার চেষ্টা করি, এখান থেকে সাগরে নামার পথ আছে কি না। খুঁজে না পেয়ে দ্বাররক্ষীকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আসলে দুর্গ থেকে সাগরে নামার কোনো পথ নেই। দুর্গে প্রবেশের একটাই পথ; তা হলো বাব এ উদায়া।’
দ্বাদশ শতাব্দীর দুর্গ আর ভেতরের কাসবা আমার দেখা হয়ে গেছে। দিনের বাকি সময় রাবাতের অতি আশ্চর্য মসজিদে কাটানো উত্তম পন্থা মনে করে বাব এ উদায়া দরজা থেকে ট্যাক্সি ডেকে চড়ে বসলাম। রাবাতের ট্যাক্সিচালকদের আমার খুব মনে ধরেছে। এরা বেশি ভাড়া চান না; মিটারে যা আসবে, তা-ই দিতে হবে। এরা একই সঙ্গে ভীষণ অমায়িক।
বারো শতকে রাবাতের শাসক আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মনসুর যে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন, সে ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও উঁচু একটি মসজিদ বানিয়ে মুসলিম জাহানকে তাক লাগিয়ে দেওয়া। দুর্ভাগ্যবশত মসজিদ নির্মাণাধীন অবস্থায় তার দেহাবসান ঘটে। এরপর মসজিদের কাজ আর এগোয়নি। যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে রয়। তবে ইয়াকুব আল মনসুরের নির্মিত মসজিদের নাম হাসান টাওয়ার হলো কীভাবে, তা কেউ জানে না।
মুরিশ স্থাপত্যকলা বা আন্দালুসিয়ান শিল্পে নির্মিত এই অর্ধসমাপ্ত মসজিদের মিনার দেখতে মরক্কোর অন্যান্য মিনারের মতোই। উচ্চতায় ৪৪ মিটার আর চারকোনা স্যান্ডস্টোনের মিনারের গায়ে খোদাই করা আছে পাতার নকশা। মসজিদ ভবন বলে তেমন কিছু দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না। তবে উন্মুক্ত স্থানে মসজিদ প্রাঙ্গণে মিনারের সামনে সারি সারি কলাম বা স্তম্ভ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলাম। দেখতে অনেকখানিই রোমান রাজপ্রাসাদের মতো লাগছে। এখন এই প্রাঙ্গণে কেউ নেই। ৩৪৮ খানা স্তম্ভের মাঝে জিগজ্যাগ করে ছুটে বেড়ানো কিংবা সোজা চলে যাওয়া যায় মিনারের কাছে। আমি সেভাবেই গেলাম। ঘুরে ঘুরে, দৌড়ে দৌড়ে, কিশোরকালের সব উচ্ছলতা নিয়ে।
আমি এই অনবদ্য শিল্প দেখি। দেখি বিখ্যাত হতে হতে, বিখ্যাত না হতে পারার কাহিনি। দেখি রাবাতের মতো অসামান্য সুন্দর এক নগরীর রূপকথার মতো রূপ আর সীমাহীন সাগরের ছুড়ে দেওয়া অপার ঐশ্বর্য।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top