রম্যরস I পরামর্শ-সুমন্ত আসলাম
দু হাত কচলাতে কচলাতে রাহিদ আবসার বলল, ‘বাতেন ভাই, আপনাকে ঠিক মানুষ মনে হয় না আমার!’
রাজিন্যপুরের কাশিনা থানার অফিসার ইনচার্জ বাতেন হাওলাদার পাউরুটি খাচ্ছিলেন চায়ে চুবিয়ে। প্রতিদিন ঠিক এগারোটায় দুটি গোল পাউরুটি আর ঘন দুধের এক মগ চা খান তিনি। চায়ে চিনি থাকে বেশি। এটা তার প্রিয় খাবার। ছোটকালে মা প্রায়ই দুধে পাউরুটি চুবিয়ে খাওয়াতেন, অভ্যাসটা রয়ে গেছে এখনো। একটা রুটি এরই মধ্যে শেষ করেছেন, আরেকটার একটা অংশ ছিঁড়ে চায়ে চুবিয়ে যেই-না মুখে দিতে যাবেন, তখনই কথাটা বলে উঠল রাহিদ। মুখ আর মগের মাঝামাঝিতে হাতটা থেমে গেল ওসি সাহেবের। রুটিতে ভরপুর বেশ কয়েক ফোঁটা চা-ও পড়ল টেবিলে, মেলে রাখা একটা কাগজেও আরও কয়টা; তিনি তবু স্থির, চোখে অবিশ্বাস। তার অফিসে, তার রুমে বসে, তারই সামনে কেউ একজন বলতে পারে, বলার সাহস পায়—‘আপনাকে ঠিক মানুষ মনে হয় না আমার!’
চায়ে চুবানো পাউরুটিটা আর মুখে দিলেন না বাতেন হাওলাদার। রেখে দিলেন মগে। টেবিলে দু কনুই ঠেকিয়ে কুঁজো হলেন রাহিদের দিকে, ‘রাহিদ, আমি সাধারণত এই সময়টাতে মিনিট দশেক একা থাকি, চুপচাপ থাকি, কারও সঙ্গে দেখা দিই না, দরজা বন্ধ করে রুটি আর চা খাই।’
‘সরি, ব্যাপারটা আমি জানতাম না, বাতেন ভাই।’
‘তুমি আমার ভার্সিটির ছোট ভাই। অনেক আগে থেকেই চিনি তোমাকে। তাই তোমাকে সামনে বসিয়ে চা খাচ্ছি, তোমাকেও অফার করেছি, খাওনি।’ বাতেন হাওলাদার বাম হাতের তালুতে থুতনি রাখলেন, ‘আমি তো জানি—তুমি চা খাও; আমি খাওয়াতে চাইলাম, খেলে না কেন?’
‘আমি অবৈধ টাকার কোনো জিনিস খাই না, বাতেন ভাই।’
‘আমার টাকা তোমার কাছে অবৈধ মনে হলো কেন?’
‘বাংলাদেশে প্রতিটি থানার ওসিই অবৈধ টাকার মালিক।’
টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিলেন বাতেন হাওলাদার। ঠোঁট দুটো মুছতে লাগলেন ধীরগতিতে। কপালটাও মুছে নিলেন এক ফাঁকে। ছোট্ট করে একটা শ্বাস ছাড়লেন তারপর, ‘চারদিকে এত বিভাজন, কেবল পুলিশের ক্ষেত্রে কোনো বিভাজন নেই সাধারণ মানুষের। তারা মনে করে—সব পুলিশ ঘুষ খায়!’
‘এর অনেকগুলো কারণ আছে। কিন্তু ওসব কারণ আপাতত থাক। আপনাকে বরং তিনটি প্রশ্ন করি।’
চাহনি কিছুটা শঙ্কিত হলো বাতেন হাওলাদারের, অনেকটা ফ্যাকাশেও হয়ে গেল চোখের ভেতরটা। তাই দেখে রাহিদ দ্রুত গলায় বলল, ‘না না, কঠিন কোনো প্রশ্ন না, সাধারণ তিনটি প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে—৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার একজন মানুষের ভুঁড়ির ওজন ঠিক কত হওয়া উচিত? দ্বিতীয় প্রশ্ন—থানার ঠিক বাম পাশে সরকারি জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের একটি পার্টি অফিস বানানো হয়েছে। এটা কার দেখার দায়িত্ব—একটি গরুর, না গাধার? তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে—একটা মানুষ যদি প্রতি পাঁচ বছর পর একই কথা বলে, তাকে কোন কানে থাপ্পড় মারা উচিত এবং কয়টা মারা উচিত?’
‘প্রশ্নগুলোর আক্ষরিক উত্তর চাও তুমি?’
‘না।’
‘এবার বলো—তুমি থানায় এসেছ কেন?’
‘হিসু করতে!’
‘মানে!’
‘মানে, আমার হিসু পেয়েছে।’
‘তুমি হিসু করতে থানায় এসেছ!’
‘এত অবাক হচ্ছেন কেন, বাতেন ভাই? আপনার থানার দশ কিলোমিটারের মধ্যে আপনি একটি হিসুখানা দেখাতে পারবেন, যেখানে সাধারণ পথচারী প্রয়োজনের সময় হিসু করতে পারবে?’
চেহারা চিন্তাযুক্ত করে ফেললেন বাতেন হাওলাদার।
‘শিবরাম চক্রবর্তী তো পড়েছ। তিনি একটি লেখায় লিখেছিলেন—প্রথমে ভেবেছিলাম, একটি মন্দির বানাব। পরে ভেবে দেখলাম—সেখানে কেবল হিন্দুরাই আসবে; মুসলমান, ক্রিশ্চিয়ান—এরা কেউ ছায়া মাড়াবে না। মসজিদ গড়লেও মুসলমান ছাড়া আর কেউ ঘেঁষবে না তার দরজায়। গির্জা হলেও তাই। যা-ই করতে যাই, সব ধর্মের সমন্বয় আর হয় না। তা ছাড়া পাশাপাশি মন্দির মসজিদ গির্জা গড়লে একদিন মারামারি-লাঠালাঠি বেধে যেতে পারে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে এই পায়খানাই বানিয়েছি। সবাই আসবে এখানে। আসবে চিরদিন।’
রাহিদ হাসতে থাকে, ‘আইডিয়াটা চমৎকার না? আমাদের দেশের এখানে-ওখানে উন্নয়নের দালান; অনেক টাকা খরচ করে বানানো ওগুলো, কোনো কোনোটা পড়ে আছে এমনি এমনি, কোনো কাজে লাগে না, ব্যবহার করা হয় না। অথচ পর্যাপ্ত ওয়াশরুম নেই আমাদের এই শহরে। তাই তো কোনো কোনো ফুটপাত ভিজে থাকে মানুষ নির্গত নোনাজলে।’ রাহিদ একটু থামল, ‘বাতেন ভাই, আমি আসলে একটা পরামর্শ নিতে এসেছি আপনার কাছে।’
সোজা হয়ে বসলেন বাতেন হাওলাদার, ‘বলো।’
‘তার আগে একটা গল্পি বলি আপনাকে। যদি অনুমতি দেন।’
‘বলো।’
‘এক রাজা প্রতি রাতে এক কেজি দুধ খান। দুধ জ্বাল এবং তাতে চিনি মিশিয়ে গ্লাসে পরিবেশন করার জন্য একজন চাকর রাখলেন তিনি। চাকরটি প্রথম প্রথম ঠিকমতো দুধ পরিবেশন করলেও কয়দিন পর আড়াই শ গ্রাম নিজের জন্য রেখে দিত, তারপর বাকিটাতে পানি মিশিয়ে রাজাকে দিত। ব্যাপারটা পাশের বাড়ির একজন দেখে ফেললেন এবং রাজাকে ঘটনাটি বললেন। রাজা মশাই প্রথম চোরকে পাহারা দেওয়ার জন্য আরেকটা চাকর রাখলেন। দু-তিন দিন পর দু চাকর মিলে আড়াই শ গ্রাম আর আড়াই শ গ্রাম—মোট পাঁচ শ গ্রাম দুধ নিজেদের জন্য রেখে বাকি দুধটাতে পানি মিশিয়ে রাজাকে দিল। পাশের বাড়ির লোকটি এটাও দেখে ফেললেন, রাজাকে জানালেন। রাজাই তৃতীয় আরেকটা চাকর নিয়োগ দিলেন আগের দুজনকে দেখে রাখার জন্য। দু-চার দিন পর আরও আড়াই শ গ্রাম দুধ গায়েব। চতুর্থ চাকর রাখার পর পুরো এক কেজি দুধ গায়েব।’ রাহিদ চোখ দুটো টান টান করে বাতেন হাওলাদারের দিকে তাকাল, ‘এবার রাজাকে কী দিয়ে বুঝ দেবে তারা?’
রাহিদ হাসতে থাকল, ‘রাজা ঘুমিয়ে ছিলেন। চার চাকর পরামর্শ করল। এক কেজি দুধ জ্বাল দিচ্ছিল। ওপরে তিরতির করে সর কাঁপছিল। এক চাকর তার থেকে কিছু সর আঙুলে তুলে তিনজনকে নিয়ে রাজার ঘরে গেল, তারপর ঘুমিয়ে থাকা রাজার গোঁফে লাগিয়ে দিল সরটুকু। রাজা ঘুম থেকে ওঠার পর বললেন, দুধ কোথায়? এক চাকর বলল, আপনি খেয়েছেন, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তারপর হাতে রাখা আয়নাটা মেলে ধরল রাজার মুখের সামনে। রাজা দেখলেন, গোঁফে দুধের সর, মানে তিনি দুধ খেয়েছেন।’
‘এই গল্পটার মানে কী?’
‘এই যে এত পুলিশ, এত নিরাপত্তাকর্মী, এত সরকারি কর্মকর্তা—সবাই যার যার সুবিধা নিয়ে নিচ্ছেন, ভাগ বুঝে নিচ্ছেন কায়দামতো, কেবল আমরা সাধারণ মানুষদের ঘুমিয়ে রাখা হয়, ফাঁকি দেওয়া হয়, বঞ্চিত করা হয়। অথচ আমাদের টাকাতেই তারা সবাই বাঁচে, গাড়িতে চড়ে, বিদেশে যায়, বড় বড় দালান বানায় নিজের।’
‘তোমার কথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে।’
‘খুবই স্বাভাবিক। হাসার জন্য আমাদের এখন আর গোপাল ভাঁড়ের গল্প পড়তে হয় না, কৌতুক পড়তে হয় না, ফানি ছবি দেখতে হয় না। চারদিকে এত এত হাসির জিনিস—তিন হাজার টাকা চুরি করা চোরকে মেরে আমরা জেলে দিই, তিন হাজার কোটি টাকা চুরি করা মানুষটাকে আমরা ভোট দিই, ক্ষমতায় বসাই, উঠতে-বসতে সালাম দিই।’
‘আমি কি শব্দ করে এবার একটু হাসতে পারি?’
‘ওই যে বললাম—হাসার জন্য এখন কোনো কৌতুক লাগে না, চারদিকে কত মজার মজার ঘটনা। আরও একটা কথা, একটু আগে বলেছিলাম—আপনাকে ঠিক মানুষ মনে হয় না আমার! আপনি আসলেই মানুষ নন। এত কিছুর পর মানুষ এভাবে হাসে না, হাসতে পারে না।’
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাতেন হাওলাদার বললেন, ‘তুমি এতক্ষণ বললে, এবার আমি একটু বলি?’
‘অবশ্যই, বাতেন ভাই।’
‘এই যে এত ঘটনা ঘটে গেছে, ঘটে যাচ্ছে, ঘটবে আমাদের দেশে; তারপরও আমরা টিকে গেছি, টিকে আছি, থাকব।’ রাহিদের দিকে চোখ একটু প্রসারিত করে তাকালেন বাতেন হাওলাদার, ‘জানো, কেন?’
কৌতূহলী চোখে বাতেন হাওলাদারের দিকে তাকাল রাফিদ, কিছু বলল না।
‘লাও জুকে তুমি চেনো, পড়েছ তার লেখা—চীনা দার্শনিক, লেখক।’
‘জি।’
‘শক্ত খাবার বাদ দিয়ে তিন বেলা নরম ভাত, যাকে বলে জাউ খাওয়া শুরু করলেন লাও জু। কারণ, তার দাঁত নেই, শক্ত খাবার চিবাতে পারেন না তিনি। একদিন সকালবেলা তার শিষ্যরা ঘিরে ধরল তাকে। নাশতা করা থামিয়ে তিনি তাদের বললেন, “জীবনে বহুবার দাঁত কামড়ে দিয়েছে জিহ্বাকে। অথচ দেখো, আমার সেই শক্ত দাঁতগুলো আর নেই, কিন্তু নরম জিহ্বাটা এখনো আছে।” তারপর মুচকি হাসলেন লাও জু, জিতে যায় শেষ পর্যন্ত নরমই। ঝড় এলে শক্ত গাছ ভেঙে যায়; কিন্তু নরম ঘাস কিংবা তৃণলতা তেমনই থাকে। পানি কত নরম, আর লোহা কঠিন শক্ত। অথচ শক্ত লোহা নরম পানির স্পর্শে কয়দিনের মধ্যেই গলে যায়। পুরুষ শক্ত, নারী নরম। ঝগড়া লাগলে শেষ পর্যন্ত কিন্তু পুরুষ হারে, নারী জেতে। শক্ত পেশির চেয়ে নরম অশ্রুর শক্তি অনেক বেশি।’
হাসতে থাকেন বাতেন হাওলাদারও, ‘সুতরাং যদি জিততে চাও, নরম হও।’
বাতেন হাওলাদার হাসতেই থাকেন, ‘আমরা বাংলাদেশিরা হচ্ছি মূলত আবেগপ্রবণ, নরম; আমরাও তাই টিকে আছি। করোনা আসে, প্রতিবছর ঝড় আসে, বন্যা আসে, প্রতি পাঁচ বছর পর দানব শাসক আসে, তবু আমরা টিকে ছিলাম, আছি, থাকব। আসো হাসি, চারপাশের সবকিছু দেখে মুক্ত মনে হাসি।’
হাসতে হাসতে টেবিলে জোরসে একটা থাপ্পড় দিলেন বাতেন হাওলাদার। চায়ের মগটা উল্টে পড়ে গেল, চায়ে লেপ্টে গেল পুরো টেবিল, ভিজে গেল অনেক কাগজপত্রও।
প্রিয় পাউরুটি চুবিয়ে ঘন দুধের মিষ্টি চা-টা আর শেষ করা হলো না বাতেন হাওলাদারের! পরামর্শটাও আর নেওয়া হলো না রাহিদ আবসারের!
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু