skip to Main Content

মনোযতন I সীমান্ত ছোঁয়া সত্তার শঙ্কা

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। সংক্ষেপে বিপিডি। মনের ভেতর বাসা গড়া ভয়ানক মানসিক ব্যাধি। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান করেছেন আশিক মুস্তাফা

অনলাইনের যুগেও বিয়েবাড়ির জন্য ওত পেতে থাকেন কিছু তরুণ-তরুণী! পরিবারের সবচেয়ে বড় এই সম্মেলনে এসে সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে সিনেমার মতো ঠিকই ধাক্কা লাগে কোনো এক অপরাজিত কিংবা অপরাজিতার সঙ্গে। তারপর চোখের ইশারা। এরপর ফেসবুকে যুক্ত হয়ে মনের ভেতর ঢুকে যাওয়া! আশপাশে তাকানোর সময় কই? বিয়ে শেষে কেউ ঢাকায়, কেউ ওয়াশিংটনে কিংবা অজপাড়াগাঁয়ে। মন কিন্তু এসব দেখে না। একবার কারও ‘মনহোলে’ পড়লেই হয়। তবে এখানেও থাকতে পারে কাটাকুটি। তাই বলে দেবদাস বা পার্বতী? কিংবা ছুটির অপেক্ষায় না থেকে প্রায়ই ক্লাস-অফিস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে বের হন। মন যেদিকে চায়, সেদিকেই দেন ছুট। এই ছুট দিতে গিয়েই ট্রেন, বাস কিংবা বিমানের পাশের সিট কমন পড়ে যায়। এই-সেই বলাবলির পর দুজনের হার্টে তীরবিদ্ধ করে কিউপিড। এরপর সামনে শুধুই রঙিন দুনিয়া! চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল নয়—এমন চিরাচরিত কথা এখানে একেবারে ভাগ না-ও বসাতে পারে। আড়াল হলেই হারিয়ে যেতে পারে সে। তাই বলে মন পুড়িয়ে যাবেন? কিংবা এই রহস্যের খোঁজে শেষ করে দিবেন জীবন?
জানেনই তো, মানব মস্তিষ্কের নিউরনের অলিগলিতে বাস করে নানা অজানা রহস্য। কখনো কখনো মনে হয় নক্ষত্ররাজির চেয়ে বেশি মারপ্যাঁচ এসব সম্পর্কে। আর এগুলোর কোনোটা স্বাভাবিক, কোনোটা নয়। অস্বাভাবিক সম্পর্কগুলো আমাদের এক অসীম আপেক্ষিকতায় ছুড়ে ফেলে। স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতার অনেক সংজ্ঞায়ন আছে মনোবিজ্ঞানেও। যা কিছু স্বাভাবিক নয়, তাকে ফেলা হয় ডিজঅর্ডারের কাতারে। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার মানবমনের এমনই এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কিংবা একাকী করে দিয়ে যাওয়া আপনাকে অসহায় করে তোলে।
বলে কারে
বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার (বিপিডি) একধরনের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত অসুস্থতা, যা একজন মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলতে পারে। লাগামহীন আবেগ মানুষের মাঝে অসহিষ্ণুতা বাড়িয়ে দেয়। অন্যরা কী ভাবছে, তা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে নেতিবাচক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে। এই ডিজঅর্ডারের শিকার মানুষেরা ‘সেলফ ইমেজ’ সমস্যায়ও ভোগেন। যতই যোগ্যতা, প্রতিভা ও দক্ষতা থাকুক না কেন, সময়ে সময়ে তাদের কাছে নিজ অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে হয়। অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করে জীবন চালিয়ে নেওয়া দুঃসহ হয়ে ওঠে। অস্তিত্ব সংকট এই ডিজঅর্ডারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
সীমান্তের বাসিন্দা
সাধারণত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই ডিজঅর্ডার বেশি দেখা দেয়। মানে, তারাই এই রোগের সীমানায় বসবাস করা মোটাদাগের বাসিন্দা। মূলত বড় হয়ে ওঠার এই বয়সেই মানুষ নতুন নানা পরিস্থিতি এবং অনুভূতির সম্মুখীন হয়। হুট করে অনেক দায়িত্বও বেড়ে যায় এ সময়ে। দায়িত্ব সামলাতে না পারার ভয় থেকেও বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার তৈরি হতে পারে এই বয়সীদের। এর সাক্ষ্য পাবেন আশপাশেই। কিংবা দেখতে পারেন জেমস ম্যানগোল্ড পরিচালিত ‘গার্ল, ইন্টার‌্যাপটেড’ মুভিটি। যেটি এগিয়েছে এক কিশোরীর ১৮ মাস মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবস্থানের ঘটনা নিয়ে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
বিপিডির বেশ কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ থাকলেও এই রোগ নির্ণয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নয়টি উপসর্গ খুঁজে বের করেছেন। আপনার নিজের কিংবা কাছের কারও মধ্যে এগুলোর মধ্যে যেকোনো পাঁচটি উপসর্গ খুঁজে পেলেই তাকে বিপিডিতে আক্রান্ত হিসেবে ধরে নিতে পারেন। চলুন, এবার মিলিয়ে নিই উপসর্গগুলো।
 ছেড়ে যাওয়ার ভয়: পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব কিংবা একান্ত কাছের মানুষ একদিন আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে, এই ভয়ে যদি তাদের কাছ থেকে দূরে থাকেন, তবে ধরে নিতে পারেন, আপনি বিপিডির পথে এক পা দিয়ে রেখেছেন। শুধু তা-ই নয়; তাদের ধরে রাখতে বাড়াবাড়ি ধরনের প্রচেষ্টা চালানোও এর উপসর্গ।
 অস্থিরতায় দ্রুত সম্পর্কের ইতি টানা: প্রেমে পড়তে সময় লাগে না যাদের, আবার প্রেমে পড়তে না পড়তেই হতাশ হয়ে পড়েন যারা, তারাও যেন এ পথের পথিক! এই পথিকেরা কাছের মানুষটির কাছে প্রতিনিয়ত উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার সান্ত¡না খুঁজে বেড়ান। একটু উনিশ-কুড়ি হলেই সম্পর্ক খারাপের দিকে নিয়ে যান।
 শরীরে পরিবর্তনের হাওয়া: আপনি আত্মকেন্দ্রিক? ভালো কথা! তাই বলে নিজেকে আজ ভালোবেসে কালই প্রচণ্ড ঘৃণা করবেন? যদি এমনটি হয়, তবে মনে রাখুন, আপনার মধ্যে বিপিডি ভালোভাবেই বাসা বাঁধছে। আর যদি জীবনের সঙ্গে নিজের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পারেন এবং আপনার সব ধরনের চাওয়া-পাওয়া মেজাজ ভালো-খারাপের সঙ্গে বদলে যেতে থাকে, এমনকি বন্ধু, কর্মক্ষেত্র, মূল্যবোধ, লক্ষ্য, ধর্ম বা যৌন পরিচয়ও পরিবর্তনের দিকে বাঁক নেয়; তবে বুঝে নেওয়া চাই, বিপিডির হাওয়া ভীষণ উলট-পালট করে দিচ্ছে আপনাকে।
 ধ্বংসাত্মক আচরণ ও নিজের ক্ষতি: অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে আপনি যদি ধ্বংসাত্মক উপায়ে বেপরোয়া গাড়ি চালান, মাদকে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন কিংবা যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করে মুহূর্তেই ভালো বোধ করেন, অথবা সহজে নিজেকে শারীরিকভাবে আঘাত দিতে স্বস্তিবোধ না করেন, তবে মনে রাখা ভালো, আপনি বিপিডির রেড জোনে চলে এসেছেন। আর যদি আত্মহননের পথে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেন, ধরে নেবেন, একদম রেড জোনেই আছেন।
 মুড সুইং: বিপিডি-আক্রান্তরা ভীষণ মুড সুইংয়ের শিকার হন। এতে তাদের রুচি, চাহিদা এবং ব্যক্তিবিশেষে সম্পর্কের অবনতিও ঘটে থাকে। তবে তাদের এই মেজাজ বিগড়ানোর বা পরিবর্তনের স্থায়িত্ব সাধারণত মাত্র কয়েক মিনিট কিংবা কয়েক ঘণ্টা।
 শূন্যতার হাতছানি: চলতে-ফিরতে, ঘরে কিংবা পথে-ঘাটে, এমনকি জনসমুদ্রেও আপনি যদি শূন্যতার ডাক শোনেন; সকলের মাঝে থেকেও নিজেকে একা অনুভব করেন, তাহলে সাবধান! আপনি ভালো বোধ করার জন্য মাদকে আশ্রয় খুঁজলে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ যৌন ব্যবস্থায় নিজেকে জড়িয়ে নিলেও এ পথেই আছেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
 অনিয়ন্ত্রিত রাগ: আপনার রাগ নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিনিয়ত অতিক্রম করলে কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারলেও আচমকা রাগের বিস্ফোরণ ঘটলে ধরে নিন, আপনার ক্ষেত্রে বিপিডি ঘণ্টি বাজছে!
 সন্দেহের থাবা: বিপিডি-আক্রান্তদের সর্বশেষ থাবাটা দেয় সন্দেহ নামের অদৃশ্য দানব। আপনি যদি কাউকে বিশ্বাস করতে না পারেন, যে কারও আচরণ আপনার চোখে ঘন-কুয়াশার মতো ঠেকে, সন্দেহের তীর থেকে পরিবারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কিংবা নিজের একান্ত প্রিয় মানুষও রেহাই না পায়, তবে আর বসে না থেকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ফোন নম্বরে ডায়াল করুন!
কারণ নির্ণয়
একদল মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের গবেষণা থেকে জানা যায়, বংশগত, পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলোই এই সমস্যার জন্য প্রধানত দায়ী। তবে পরিবারে অন্য কারও যদি বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার থাকে, বাকি সদস্যদেরও এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে মস্তিষ্কের কার্যরত অংশটির গাঠনিক পরিবর্তনের কারণে এই মনোরোগ উঁকি দিতে পারে। জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো বিশেষ দুর্ঘটনা; যা পরবর্তী সময়ে মানসিক ট্রমার কারণ হয়, সেটিও ডেকে আনতে পারে বিপিডি।
আরেক দল মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভিমত, বিপিডি জেনেটিকস ও ট্রমাটিক অভিজ্ঞতার মতো বাহ্যিক কারণগুলোর সংমিশ্রণের ফলেই ঘটে। রোগটির আসল ও যথাযথ কারণ এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি। তবে সব গবেষকই এই ক্ষেত্রে একমত, ব্যক্তিত্বের ব্যাধিগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে কিংবা পরিবারের সদস্যদের অন্যান্য মানসিক ব্যাধির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হতে পারে।
পরিত্রাণের পথ
বাস্তবে থেকেও অবাস্তবের সঙ্গে নিত্য বসবাস করেন বিপিডিতে ভোগা মানুষগুলো। চারপাশে সবকিছু থাকার পরও এক অসীম শূন্যতার অনুভূতি তাদের গ্রাস করে নেয়। শূন্যতার এ ভয়াবহ চক্র থেকে মুক্তির আশায় মন আঁকুপাঁকু করলেও কোনো পথের হদিস মেলে না যেন। নিজের মনের গোলকধাঁধাতেই ঘুরপাক খেতে থাকেন তারা। তবে সময়ের সঙ্গে অধিকাংশ মানুষ নিজেকে সামাল দিতে শেখেন; ডিজঅর্ডারের মাত্রাও কমে আসে। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে বিষয়টি একই মাত্রা বা গতিতে তৈরি কিংবা শেষ হয় না। তাই এসব বিষয়কে ‘মনের ভুল’ কিংবা ‘সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে’ ধরনের না ভেবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা চাই।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক ও নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার চিকিৎসার আগে রোগী এতে আক্রান্ত কি না, তা শনাক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; যেমন সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট অথবা ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কারের মাধ্যমে বিপিডি রোগী শনাক্ত করা চাই। তারা ভুক্তভোগীর আচরণগত মূল্যায়ন, পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা পারিবারিক চিকিৎসার ইতিহাস থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সম্ভাব্য লক্ষণগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণ শেষে এই রোগী শনাক্ত করেন। শনাক্তের পরেই নিতে হবে চিকিৎসা। তারা রোগীর অবস্থার ওপর সিদ্ধান্ত নেন, কীভাবে এই ব্যাধি দূর করা যায়। হয়তো কাউন্সেলিংয়ের পথেও হাঁটতে পারেন তারা। সেই সঙ্গে সাইকোথেরাপি, যেমন ডায়ালেক্টিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি (ডিবিটি), কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির (সিবিটি) মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন। এ ছাড়া কখনো কখনো মেডিসিনের দরকার হতে পারে রোগীর। সে ক্ষেত্রে ওষুধ ও কাউন্সেলিং একসঙ্গেই গ্রহণ করতে হয়।
এসবের বাইরে পারিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতা এ ধরনের মানসিক রোগীদের দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে মনে রাখা চাই, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই রোগ সারানোর চেষ্টা নিজেই করতে যাবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে আপনার পরিবার কিংবা কাছের মানুষটির—যোগ করেন ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top