এডিটর’স কলাম I হাসি মহৌষধি
হাসি যে শুধু হৃদয় নয়, হৃদ্পি-ের জন্যও ভালো, সে কথা মোটামুটি সর্বজনবিদিত। এর ফোয়ারা শরীরের রক্তনালির কার্যকারিতার উন্নতি ঘটায় এবং রক্তপ্রবাহ ইতিবাচকভাবে বাড়িয়ে তোলে
সময় যখন পাগলা ঘোড়ার মতো দিগ্বিদিক দে ছুট ব্যস্ততায় পিষ্ট, জীবন যখন পাওয়া না পাওয়া, আশা-নিরাশা, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের দোলাচলে ক্লান্ত-শ্রান্ত, আপামর মানুষের মুখে ভেসে বেড়ায় রাশি রাশি গুমোট মেঘের দঙ্গল, এমন জীবনচর্চায় অন্দরমহল কিংবা বহিরাঙ্গনে চেনা অথবা অচেনা কারও মুহূর্তকালীন হাসিমুখও মহৌষধির মতো কাজ করতে পারে। হাসি এমনই এক সংক্রমণ, যা এক মুখ থেকে অজস্র মুখে ছড়িয়ে অস্থির কিংবা বিমর্ষ অন্তরে এনে দিতে পারে অপার্থিব প্রশান্তি। ‘মানবজাতির রয়েছে একটি সত্যিকারের কার্যকর হাতিয়ার, আর তা হলো হাসি,’ বলেছেন প্রসিদ্ধ আমেরিকান সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন। উপমা হিসেবে এই হাতিয়ার যে ইতিবাচক অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত, বলা বাহুল্য।
দুই
বিশেষজ্ঞরা হাসিকে মহৌষধ হিসেবে গণ্য করেন। তা শুধু রূপক অর্থেই নয়; আক্ষরিক অর্থেও। হাসি মানুষের শরীরে স্বাস্থ্যকর শারীরিক ও আবেগাত্মক পরিবর্তন এনে দেয়। হাসির ঝলকে বাড়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, উন্নতি ঘটে মেজাজের, প্রশমিত হয় ব্যথা; পাশাপাশি বিবিধ মানসিক চাপ থেকে সুরক্ষাও মেলে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, হাসি পুরো শরীরকে শিথিল করে। একটি উন্নত ও প্রাণবন্ত হাসির রেশ শরীরে পরবর্তী ৪৫ মিনিট পর্যন্ত সক্রিয় থেকে শারীরিক চাপ উপশম করে এবং মাংসপেশি স্বস্তিতে রাখে। হাসির কারণে স্ট্রেস হরমোন হ্রাস পায় এবং ইমিউন সেল ও ইনফেকশন-ফাইটিং অ্যান্টিবডির বৃদ্ধি ঘটে; ফলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শাণিত হয়ে ওঠে। সুস্থ থাকার জন্য ভালো অনুভূতি অনুভবের রাসায়নিক—এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ করে এটি। ফলে ভালো থাকার একটি সামগ্রিক বোধ ছড়িয়ে পড়ে; এমনকি সাময়িকভাবে হলেও ব্যথা থেকে রেহাই মিলতে পারে।
হাসি যে শুধু হৃদয় নয়, হৃদ্পিণ্ডের জন্যও ভালো, সে কথা মোটামুটি সর্বজনবিদিত। এর ফোয়ারা শরীরের রক্তনালির কার্যকারিতার উন্নতি ঘটায় এবং রক্তপ্রবাহ ইতিবাচকভাবে বাড়িয়ে তোলে; যার প্রভাবে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ক্যালরি বার্ন করতেও ভূমিকা রাখে হাসি। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাসতে পারলে প্রায় ৪০ ক্যালরি বার্ন হয়; যারা স্থূলব্যাধিতে ভুগছেন, এই চর্চার মাধ্যমে তারা বছরে তিন-চার পাউন্ড ওজন কমাতে পারবেন! হাসি যেহেতু মানসিক অবস্থার শারীরিক প্রকাশ; তাই মানসিক স্বাস্থ্যেও এর ইতিবাচক প্রভাব প্রচুর। এটি প্রথমত যেকোনো ক্রোধকে হালকা করে দেয়। দুজন মানুষের মধ্যে চলমান ক্রোধ ও বিবাদকে মুহূর্তে উধাও করে দেওয়ার জন্য হাসি বিনিময়ের মতো এত দ্রুত কার্যকর উপায় সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই!
তিন
হাসি এমনিতে আপনাআপনিই আসে। তবু জীবনের ভার যদি অধিক ভারী হয়ে ওঠে, নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা অনেকের পক্ষে হয়ে পড়ে দুরূহ। তবে হাসিচর্চারও রয়েছে উপায়! বিশেষত, হালে লাফিং ইয়োগা বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দল বেঁধে এর অনুশীলন করা যায়; একা একাও। শুরুটা হতে পারে নিজের শরীরকে শিথিল ও অন্তরকে শান্ত করার জন্য ব্রিদিং এক্সারসাইজ দিয়ে। নাক দিয়ে ধীরে ধীরে গভীর নিশ্বাস টেনে নিয়ে, এক মুহূর্ত ধরে রেখে, তারপর মুখ দিয়ে আলতোভাবে ছেড়ে দেওয়া। এই চর্চার বারকয়েক পুনরাবৃত্তি আপনাকে গভীর মনোনিবেশ করতে এবং শরীরকে আরও উদারভাবে হাসির জন্য প্রস্তুত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলেই বিশেষজ্ঞদের মত। এটি অক্সিজেন লেভেলের উন্নতি সাধনেও সহায়ক, যা লাফটার সেশনে রাখে কার্যকর ভূমিকা। দ্বিতীয় ধাপে হাততালি ও জপের মাধ্যমে নিজেকে আরও প্রস্তুত করে নেওয়া সম্ভব। এ পর্যায়ে নিজের শরীর মৃদু নাড়িয়ে, তালে তালে হাততালি দিতে দিতে বলতে পারেন, ‘হো হো হো… হা হা হা…’। তালির সময় দুই হাতের তালু সমান রাখা শ্রেয়। এরপর অন্তস্তল থেকে উগরে দিতে পারেন অট্টহাসির জোয়ার! তবে এ ধরনের চর্চা সংশ্লিষ্ট খাতের কোনো বিশেষজ্ঞের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কিংবা পরামর্শমতেই করা মঙ্গল।
চার
ঈদুল ফিতর। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আনন্দ উদ্যাপনের দিন। কোনো উদ্যাপনই একা একা পূর্ণতা পায় না। যথাসম্ভব সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হয়। এমন দিনে চোখের সামনে চেনা-অচেনা কারও যদি বিমর্ষ বদন ধরা পড়ে, আনন্দ মুহূর্তেই হয়ে যেতে পারে ম্লান। তাই অন্যদের মুখেও হাসি ছড়িয়ে দিতে নিজ নিজ সাধ্যমতো ভূমিকা রাখা সবার জন্যই গুরুত্ববহ।
পাঁচ
বলা হয়ে থাকে, শরীর ও মনের মধ্যকার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হাসির চেয়ে দ্রুততর কিংবা অধিক নির্ভরযোগ্য উপায় আর নেই। হাসির ঢেউ দোলা দিয়ে যাক সকলের অন্তরে।
ঈদ মোবারক।