skip to Main Content

প্রাগৈতিহাসিক I পারস্য প্রসূত

ইরান। মধ্যপ্রাচ্যের এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ। পারস্য নামেও জানেন অনেকে। অতীতে এ নামেই অধিক পরিচিত ছিল। কেমন ছিল প্রাচীন পারস্যের খাদ্যসংস্কৃতি?

প্রাচীন পারস্যে অভিজাতদের জন্য বড় বাটিতে পোলাও ও কাবাব মাত্র দু-তিনজনের জন্য প্রস্তুত করা হতো। বড় কলসিতে খাবারের সঙ্গে বিভিন্ন পানীয় পরিবেশন করার রেওয়াজ ছিল। টেবিলে রুমাল থাকত না। চামচ ও কাঁটাচামচ ব্যবহারের চল কম ছিল। আমজনতা বেশির ভাগ সময় হাত দিয়ে খাবার মুখে তুলত। হাত ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো তামা বা রুপার পাত্র; নাম আফতাবেহ ও লাগান। অভিজাতদের টেবিলের কাছে সব সময় ভৃত্য থাকতেন দণ্ডায়মান। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের নিরামিষযোগে ভাত রান্না করত। পরিবারের সবার একসঙ্গে খাবার গ্রহণের চল ছিল। দিনের দুটি প্রধান খাবার ছিল সকালের নাশতা ও দুপুরের আহার। এই প্রথাগুলো সাফাভিদ রাজবংশের (১৫০১-১৭৩৬) পরে এবং কাজার যুগ (১৭৮৯-১৯২৫) পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
ইতিহাসে উঁকি
প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে ইতিহাসের প্রথম দিকের রেকর্ড পর্যন্ত, পারস্যের মালভূমির (ককেশাস, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার কিছু অংশ) বিশাল এলাকায় একটি নির্দিষ্ট খাদ্যসংস্কৃতি ছিল। আর তা বিশ্বের প্রাচীনতম খাদ্য ঐতিহ্যগুলোর অন্যতম, বলা বাহুল্য।
ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে দক্ষিণ থেকে উত্তর এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমের ঐতিহ্য ভিন্ন। পারস্যের খাদ্যসংস্কৃতিতে প্রাক্-ইসলামি যুগের খুব বেশি তথ্য মেলে না। বর্তমানে প্রচলিত অধিকাংশ ঐতিহ্যই ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে। তবে অভিজাত ও রাজাদের সঙ্গে সম্পর্কিত খাদ্যসংস্কৃতির কথা কিছুটা জানা যায়। সম্ভবত পারস্য রন্ধনপ্রণালিকে উপস্থাপন করতে পারে, এমন নথির সেরা উদাহরণগুলোর একটি হলো আরজান ব্রোঞ্জ কাপ। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৫০০ অব্দে এর অস্তিত্ব মেলে। এ ধরনের বস্তু সাধারণত বিভিন্ন যুগের খাদ্যসংস্কৃতির শৈলীকে চিত্রণ করে।
অন্যদিকে, পারস্যে ইসলামের বিস্তারের পর, প্রায় ৪০০ বছর আগে সাফাভিদ রাজবংশের শেফদের রেখে যাওয়া চিঠি ও পাণ্ডুলিপি পারস্য খাবারের তথ্যের অন্যতম উৎস। তাদের লেখায় প্রাচীন ইরানের রান্না ও পরিবেশনের একটি অত্যন্ত বিলাসবহুল এবং অভিজাত শৈলীকে চিত্রণ করে। সাফাভিদ ভ্রমণকাহিনিতেও পারস্যের খাদ্যাভ্যাস ও রীতিনীতি সম্পর্কে বেশ কিছু দরকারি তথ্য পাওয়া যায়।
তারও আগে, সাসানি রাজবংশের (২২৪-৬৫১ খ্রিস্টাব্দ) পতনের পর আরবরা পারস্যদের জীবনধারার সঙ্গে আরও পরিচিত হয়। আব্বাসীয় খলিফাদের প্রাসাদে পারস্যের দরবারিদের উপস্থিতিও এ বিষয়ে প্রভাব ফেলে। পারস্য ভূখণ্ড শাসনকারী তিনটি রাজবংশ সেলজুক (১০৩৭-১১৯৪), ইলখানাত (১২৫৬-১৩৩৫/১৩৫৩) ও মোঙ্গলকেও (১২০৬-১৩৬৮) পারস্য খাবার প্রভাবিত করেছিল। তা ছাড়া পারস্য আক্রমণকারী বিদেশিরা এ অঞ্চলের খাবারকেও প্রভাবিত করেছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তুর্কিদের মাধ্যমে জনপ্রিয় ক্র্যানবেরির কথা বলা যায়, যা ছিল একধরনের কালো দই বা ময়দা। সময়ের সঙ্গে এটি কিছু পারস্য খাবারের অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে, বিশেষত মধ্য এশিয়ায়।
কাজার যুগে পারস্য খাবারের সমৃদ্ধি ভ্রমণকারীদের কাছে দৃশ্যমান ছিল এবং এর সাক্ষ্য অনেক পুরোনো ভ্রমণকাহিনিতে আজও পাওয়া যায়। সে যুগে খাবার ব্যবস্থাপনা ছিল ভীষণ চমৎকার। মেঝেতে একটি টেবিল ক্লথে সুন্দরভাবে তা পরিবেশন করা হতো। অভিজাতদের খাবার সাধারণ মানুষের চেয়ে ছিল বেশ আলাদা। পারস্যের খাদ্যসংস্কৃতি ভাতের সঙ্গে যুক্ত পদ এবং রান্নার সামগ্রিক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার জন্য পরিচিত ছিল। চাল ছিল খাবারের প্রধান উপাদান। প্রাচীনকালে পারস্যদের ব্যবহৃত বেশির ভাগ চাল আসত ওই ভূখণ্ডে উত্তর প্রদেশ (বর্তমান ইরানের গিলান, মাজানদারান ও গোলেস্তান) থেকে।
পদের পরিধি
চালে চর্চা
সাফাভিদ ও কাজার যুগের বেশ কিছু ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করা হয়, পোলাও ছিল তৎকালীন পারস্যের জাতীয় ও প্রধান খাবার। অস্ট্রিয়ান চিকিৎসক, লেখক ও বিশ্ব পরিব্রাজক জ্যাকব এডওয়ার্ড পোলাকের (১৮১৮-১৮৯১) লেখা থেকে জানা যায়, পোলাও, চেলো ও অ্যাশ ছিল পারস্যের তিনটি প্রধান খাবার; তিনটিই চাল দিয়ে তৈরি। পার্সিয়ানরা স্টু দিয়ে পোলাও খেতেন; সঙ্গে থাকত বিভিন্ন মাংস, পানীয় ও সবজি। পারস্য রন্ধনপ্রণালির রান্না ছিল সময়সাপেক্ষ। এর নেপথ্য কারণ, পারস্য খাবারের সব উপাদান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রান্না করার রেওয়াজ ছিল। এমনকি ভাজা খাবার মৃদু তাপে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাজা হতো। এই রেওয়াজ এখনো রয়েছে। পারস্য খাবারের স্বাদ মোটেই মসলাদার নয়; বরং বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন খাদ্যসংস্কৃতির তুলনায় স্বাদের দিক থেকে কম মসলাদার। যদিও পারস্য খাবারে সব ধরনের মসলা ব্যবহার করা হয়; তবে শেফের সব প্রচেষ্টা ও শিল্প যেন মসলায় ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য! বিপরীতে, পারস্য সাইড ডিশগুলো স্বাদে সমৃদ্ধ। প্রধান খাবারের সঙ্গে আচার, পানীয় ও সবজির মতো বিভিন্ন সাইড ডিশ যুক্ত করার কারণে ভোজনরসিক পর্যটকদের কাছে এ এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হতে পারে।
খাস্তা খামিজ
সাসানীয় আমলে খামিজ নামে একটি বিখ্যাত খাবার ছিল। মূলত কাঁচা মাংসের পাতলা স্লাইস লবণ ও ভিনেগার মিশিয়ে হালকা ভেজে ঠান্ডা করে পরিবেশন করা হতো। তাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের মাংসের ব্যবহার। ঐতিহাসিক বিবরণ অনুসারে, খরগোশ, হরিণ ও ছোট উটের মাংস বেশি ব্যবহৃত হতো। কারণ, এগুলো গরু, খাসি ও ভেড়ার মাংসের তুলনায় বেশি কোমল। ভিনেগার মেশানোর কারণ, এটি মাংসের ছাঁচ ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এবং মাংসকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দেয়। ভিনেগার ও লবণের বাইরে অন্য কোনো উপাদান ব্যবহার করা হতো না। কোনো মসলা তো নয়ই। কাঁচা খাবারের ডায়েট তখন জনপ্রিয় ছিল না; তবে খামিজ খাওয়ার বেশ চল ছিল।
খোরেশ শাহি বা কিংস স্টু
সাসানীয় যুগের আরেকটি খাবার। নাম থেকেই বোঝা যায়, শাসক ও তাদের পরিচারকদের জন্য এই স্টু প্রস্তুত করা হতো। রেড মিট, মুরগির মাংস, তিতিরের মাংস, উটপাখির মাংস, চাল, খেজুর, সুগন্ধি পাতা, লবণ বা ক্যারামেলাইজড চিনি এর মূল উপাদান। সে সময়কার শাসকদের উচ্চ প্রোটিন ও চিনিসমৃদ্ধ অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আসক্তির কারণে সাধারণত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্ত-সম্পর্কিত নানা ব্যাধি সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি হতো। রাজাদের জন্য খোরেশ শাহি বস্তুত মুখরোচক অথচ ক্ষতিকর হলেও প্রাচীন পারস্য উৎসবগুলোর একটি প্রধান খাবার হিসেবেও মর্যাদা পেয়েছিল।
পার্থিয়ান ল্যাম্ব স্টু অ্যান্ড ব্রেড
২৪৭ খ্রিস্টপূর্ব, অর্থাৎ পার্থিয়ান যুগের সূচনালগ্ন থেকেই এ খাবার তৎকালীন পারস্য জনগণ রান্না করতেন বলে জানা যায়। এই থালায় ভেড়ার মাংসের সঙ্গে বরই, পেঁয়াজ, জলপাই, অলিভ অয়েল, বাঁধাকপি, রসুন, গোলমরিচ ও লবণ থাকত। সঙ্গে একটি বিশেষ রুটি। সেই রুটি ছিল আজকালকার রুটির চেয়েও শুষ্ক। শুষ্কতা ও পুরুত্বের জন্য একে বিস্কুটের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই শুকনো রুটি পানি বা ঝোল দিয়ে নরম করে খাওয়া হতো। পার্থিয়ান ল্যাম্ব স্টু অ্যান্ড ব্রেড সে যুগের সৈন্য থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল।
হারিরা বার্লি অ্যান্ড ফ্রুটস
হাখমানেশি বা আচিমিনীয় যুগের (৫৫০-৩৩০ খ্রিস্টপূর্ব) পারস্য খাবারে গম ও চালের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে; তবে বার্লির ব্যবহার ছিল অত্যধিক। অন্যদিকে, বাদাম পোরিজ এবং হারিরা সমসাময়িক ইরানি খাবারের অংশ এবং সাধারণত এক বছরের কম বয়সী শিশু ও ছোট বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়। ক্যাফেগুলোতে পোরিজকে বিশেষায়িত ও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত করে বিক্রির চলও রয়েছে। অন্যদিকে, হারিরা বার্লি অ্যান্ড ফ্রুটস ছিল আচিমিনীয় যুগের এমন একটি খাবার, যা বার্লি ও বিভিন্ন ফল, যেমন শুকনো অ্যাপ্রিকট, ডুমুর ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশন করা হতো। স্বাস্থ্যসচেতন অনেকে এখনো সকালে এ খাবার গ্রহণ করেন।
মালমাই রাইস
সাফাভিদ রাজবংশের সময়ে জনগণ যেসব খাবার উপভোগ করত, সেগুলো অনেকটাই বর্তমান ইরানের খাবারের মতো ছিল। মোরাসা পোলাও বা ঘেমেহ নেসার কাজভিনের সঙ্গে খুব সাদৃশ্যপূর্ণ সেই খাবারগুলোর মধ্যে একটি ছিল সাফাভিয়ান মালমাই পোলাও। ঝোল করা মুরগির মাংস ও ছোলার টুকরো দিয়ে চাল সেদ্ধ করে, তারপরে এতে পেস্তাবাদাম, বাদাম, খেজুর, ডুমুর ও বারবেরি যোগ করে রান্নার চল ছিল। উৎসব অনুষ্ঠানে সুস্বাদু মালমাই রাইসের বেশ ছিল। অতিথিরা প্রতিটি চামচে স্বাদ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি, লবণাক্ত, টকসহ বিভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা নিতেন।
সাফাভিদ সাম্রাজ্যের সময় শিল্প খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং রন্ধন একটি শিল্প হিসেবে বিবেচিত হতো। এ কারণেই সাফাভিদ শাসনে পারস্য রান্নার চমৎকার বিকাশ ঘটে।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি ও চিত্রকর্ম: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top