ফিচার I মধ্যপ্রাচ্যের রোজার খাবার
রমজান মাসে মুসলমানদের অভ্যস্ত খাদ্যাভ্যাসে আসে নির্দিষ্ট পরিবর্তন বা পরিমার্জন; বিশেষত ইফতার ও সেহরিতে। মুসলিম-অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যে এ মাসে সাধারণত কোন কোন খাবার গ্রহণের চল বেশি, জানা যাক একঝলকে
ইফতারের খাবারের কথা বলতে গেলে ফিউশনের কৌশল নিয়ে আলাপ শুরু করা ভালো। কারণ, এসব খাবার ঐতিহ্যবাহী স্বাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্বাদ মিলিয়ে জিবে অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। যেমন মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী খাবার তাজিনে এশিয়ান অনুপ্রাণিত গ্লেজ কিংবা ইন্ডিয়ান কারির সঙ্গে লাতিন আমেরিকান টুইস্ট একটি নতুন মাত্রা দেয় স্বাদে। গম্বুজ আকৃতির মাটির ঢাকনা ও থালার ভেতরে রান্নার উপাদানগুলো সাজিয়ে চুলার ওপর রেখে এটি তৈরি করা হয়। খাবারটির নামকরণ এর রান্নার পাত্রের নাম ‘তাজিন’ থেকেই, যা দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পিঠা বানানোর সরার মতো।
খাদ্যশিল্পে স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষ নজর থাকায় ক্রিয়েটিভ ফালাফেল, কাবাব ও ল্যান্টিল স্টুয়ের মতো মাংসভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী খাবারের পরিবর্তে উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্পগুলো দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্যসচেতন খাদ্যাভ্যাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, রমজানের মেনুতে হালকা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের বিকল্প ক্রমশ প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে স্যালাদ, ভাজা মাছ ও খাদ্যশস্যের বিকল্পগুলো খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইফতারের প্রধান একটি আকর্ষণ হিসেবে থাকে সৃজনশীল ও সুস্বাদু ডেজার্ট। ক্ল্যাসিক বাকলাভা ও কুনাফা থেকে শুরু করে উদ্ভাবনী মুজ কেক এবং ফলের টার্ট ইফতারে ডেজার্টের জমকালো আয়োজন নিশ্চিত করে। ওই অঞ্চলে উদীয়মান রন্ধনসম্পর্কীয় ট্রেন্ড খুব দৃশ্যমান। প্রতিটি দেশের রমজানের খাবারের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে, যা প্রায়শই কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও শর্করাসমৃদ্ধ। করোনা অতিমারির পর অনেকে স্বাস্থ্যকর খাবার অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সুস্থতার ওপর জোর দিয়ে স্বাস্থ্যকর মেনুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রিম স্যুপের পরিবর্তে হালকা ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার; যেমন মসুর ডাল, বার্লি কিংবা পার্ল মিলেট জনপ্রিয় বিকল্প, যা প্রোটিন, ফাইবার ও খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ এবং সেহরির সময় পোরিজের বিকল্প বা পানীয় হিসেবে ভালো কাজ করে। মাখন ও ঘিয়ের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর জলপাই তেল ব্যবহার করার প্রবণতা বেশি দেখা যায় বছরের এ সময়ে। তা ছাড়া, স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করতে ভাজার পরিবর্তে গ্রিল করা বর্তমানে অধিক জনপ্রিয়।
বর্তমান আরবের মানুষেরা ইফতারের আয়োজনে কফি, স্যুপ, ক্যুনাফা, ত্রোম্বা নামক নানা রকম হালুয়া, সরবা, জাবাদি দই, লাবান, খবুজ (ভারী ছোট রুটি) বা তমিজ (বড় রুটি) ইত্যাদি খেয়ে থাকেন। এ ছাড়া সাম্বুচা নামক একধরনের খাবার রয়েছে, যা দেখতে সমুচার মতো। এটি মাংসের কিমায় তৈরি; তবে এতে কোনো মরিচ ব্যবহার করা হয় না।
ঐতিহ্যগতভাবে সৌদি আরবে খেজুর, কেশতার সঙ্গে আরব কফি দিয়ে ইফতারে খাবার গ্রহণ শুরু হয়। এরপর পরিবেশন করা হয় স্যুপ ও ভাজা সমুচা। এই ভোজপর্বের আইকনিক খাবারের মধ্যে রয়েছে জারাশ, মাংস এবং মাংসের ঝোল দিয়ে রান্না করা ক্রিমড ও ক্রাসড গমের স্টু, আফগানিস্তানে উদ্ভূত তমিজের সঙ্গে ফাউল (খাবারবিশেষ), তাজা বেকড রুটির সঙ্গে ফাভা বিন স্টু ইত্যাদি। বেশির ভাগ আরব পরিবারে এই খাবার জনপ্রিয় হওয়ার কারণ, এটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু তো বটেই, সারা দিন রোজা রাখার পর প্রথম আহারপর্বে পেটের জন্য আরামদায়ক। একে মূল খাবার কিংবা রমজানের অন্যান্য খাবারের সঙ্গেও রাখা যায়। এটি প্রস্তুত করে একটি অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে প্রথমে ফ্রিজে রাখা হয়; পরে চুলায় গরম করে পরিবেশন করা হয়। প্রতিবেশীর মাঝে খাবারটি ভাগ করে নেওয়ার চল রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ওমান, কুয়েতসহ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন পরিবারে ইফতারে হারিস নামের একটি খাবার বহুল প্রচলিত। গম, ভেড়া বা মুরগির মাংস ও মাখন দিয়ে তৈরি পোরিজ-জাতীয় খাবার এটি। মাংসের ব্যবহার যত বেশি, স্বাদও তত খোলতাই হয়।
রমজানে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান খাবারে প্রায়শই ভেড়ার মাংস বা মুরগির খাবসা থাকে। অন্যদিকে কুনাফা, কাতায়েফ, সৌদি হানিনি (গমের রুটি), খেজুর ও ঘিয়ের মতো সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হয়। কোমল পানীয় হিসেবে ভিমটোর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে।
রমজানের মেনু একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে, যা বিভিন্ন দেশের রন্ধন ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটায়। সাধারণ খাবারের মধ্যে রয়েছে স্যুপ, ফাত্তুশের মতো স্যালাদ, সুস্বাদু পেস্ট্রি এবং ঠান্ডা ও গরম অ্যাপেটাইজারের সমাহার। প্রধান খাবারের ক্ষেত্রে, প্রতিটি দেশ তাদের রমজানের ঐতিহ্যকে মূর্ত করে, এমন আইকনিক ক্ল্যাসিক খাবারের সরবরাহ ঘটায়। ফিলিস্তিনিরা এ সময়ে বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরি করতে পছন্দ করেন। তাদের রমজানের রান্নায় জায়গা পাওয়া খাবার স্থানভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। গাজায় সাধারণত মাকলুবা, সুমাগিয়াহ ও মাফতউল খাওয়ার চল বেশি। পশ্চিম তীরে মুসাখান ও মনসাফ বিখ্যাত। তবে আচার ও স্যালাদ সব সময়ই ফিলিস্তিনি ইফতারে জায়গা করে নেয়। এখানকার সঙ্গে বাংলাদেশের ইফতারির বেশ মিল রয়েছে। পুরোনো জেরুজালেমের বাসিন্দারা ঐতিহ্য অনুযায়ী জনপ্রিয় পানীয় তামারিন জুস পান করেন। তবে সাধারণত তাদের ইফতার শুরু হয় খেজুর খাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেহরিতে তারা পনির ও দইজাতীয় খাবার গ্রহণে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
লেবানিজ প্রধান খাবার; যেমন সায়াদিহ মাছ, ব্রাউন রাইস, কাব্বেহ লাবানিয়েহ এবং সামকেহ হাররা বেশ প্রশংসিত। এ দেশের বিখ্যাত স্যালাদ ফ্যাটুস। প্রায় সব পরিবারেই ইফতার আয়োজনে এর উপস্থিতি থাকে। লেবাননের তুমুল জনপ্রিয় খাবার তাবুলেহের সঙ্গেও ফ্যাটুস খাওয়া হয়। ইফতার হিসেবে এটি বেশ স্বাস্থ্যকর খাবার। ফ্যাটুস তৈরিতে শসা, টমেটো, মুলা, থানকুনি ও লেটুসপাতা ব্যবহার করা হয়।
জর্ডানের ল্যাম্ব মানসাফ ইফতারের একটি জনপ্রিয় মেনু, যা ন্যাশনাল ট্রেজার হিসেবে বিবেচিত। এ সময়ে পানীয় হিসেবে সাধারণত মিক্সড জুস ও লাচ্ছি পান করেন দেশটির নাগরিকেরা। তাদের টেবিল আলোকিত করে আরও থাকে সে দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার মানসাফ ও কাতাইফ।
মিসরে মলখিয়া, স্টাফড পায়রা ও কোশারির মতো আইকনিক খাবারগুলো রোজার দিনে আরামদায়ক স্বাদ এনে দেয়; অন্যদিকে মরক্কোর ল্যাম্ব তাজিন হৃদয়গ্রাহী এক মসলাদার ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। ইয়েমেনি মুরগির কোমল মাংসের মান্ডি, যা সুগন্ধযুক্ত ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। তা ছাড়া সিরিয়ান মিক্সড গ্রিল, আলেপ্পো স্টাইলের কাবাব এবং স্টাফড সবজি (মাহাচি) থেকে রমজানের উৎসবের তাৎপর্য বহন করে এমন সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় স্বাদ পাওয়া যায়।
রমজান মাসে খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থতার মধ্যে যোগসূত্র সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যকর রন্ধনপ্রণালিরও বিকল্প খুঁজছেন। রোজার সময় এই বোধগম্যতা বিশেষভাবে উৎসাহব্যঞ্জক। এই পরিবর্তনকে সমর্থন করার জন্য বাদাম, বীজ, হোল গ্রেইন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বিজাতীয় উপাদানগুলোকে ঐতিহ্যবাহী রেসিপিতে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়, যেন খাবারগুলো আরও সুষম এবং পুষ্টিকর পদ্ধতিতে তৈরি করা যায়। এ রকম খাবারে শুধু পুষ্টির মানই বৃদ্ধি করে না, মজাদার অনুভূতি বজায় রাখতেও সাহায্য করে। রোজার সময় মানবদেহে এসব খাদ্য উপাদান বিশেষ উপকারী হিসেবে প্রমাণিত।
মুসলিম বিশ্বে ইফতার ও সেহরির খাবার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব খাবারগুলোর চল বেশ জনপ্রিয়। তবে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম সংস্কৃতির বিভিন্ন খাবারেও এক্সপ্লোর করে যাচ্ছেন অনেকে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট