ফিচার I সৌদি আরবের সিনে-ক্যাপিটালিজম
সৌদি সংস্কৃতি সামন্ততন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে প্রবেশ করেছে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয়। চলচ্চিত্র দিয়ে এর উদ্বোধন ঘটলো
রক্ষণশীল রাজতন্ত্রের বদলে পুঁজিবাদ ও গ্লোবালাইজেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডেমোক্রেটিক ভ্যালুজে নিজেদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অভ্যস্ত করাতে চান সৌদি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান। সে লক্ষ্যে তিনি অগ্রসরমাণ। তার হাত ধরেই সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থায় দ্রুত বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে সৌদি আরবে। তাই চিরাচরিত কালচারাল ট্যাবু সরিয়ে এখন ‘লিবারাল’ ভুবনায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে চাইছে সৌদি দুনিয়া। গোটা দুনিয়াকে চমক লাগিয়ে দিয়ে জ্বালানি তেল ও ধর্মীয় পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল সৌদি রাষ্ট্র বলছে, আগামী দিনে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে সে দেশে সিনে-ক্যাপিটালিজম অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। সেই পুঁজিবাদের হাত ধরে সৌদিজগৎ প্রবেশ করছে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অঙ্গনে। তারা চাইছে, ধর্মের সঙ্গে বিনোদনজগতের দূরত্ব ঘুচিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রকে বিশেষভাবে কাজে লাগতে। তাই সৌদি রাজপুত্রের হাত ধরে সিনেমা প্রদর্শনের ওপর দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের সূচনা করেছে সৌদি আরব।
শুধু তা-ই নয়, সে দেশের রাজপুত্র ভিশন টোয়েন্টিথার্টির কর্মসূচি হিসেবে স্থির করেছেন, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সার্বিক রূপ দেওয়া হবে।
বলা যায়, সৌদি আরবে এখন বসন্তের হাওয়া। ফিল্ম প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে মার্বেল স্টুডিও প্রযোজিত হলিউড ফিল্ম ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ প্রদর্শিত হয়েছে সৌদি আরবের বাণিজ্যিক নগরী রিয়াদে। নানা দেশ থেকে চলচ্চিত্রকার, শিল্পপতি, লেখকসহ নানা ধরনের মানুষ ছবিটির প্রদর্শনীতেও উপস্থিত ছিলেন। রিয়াদে আমেরিকার সিনেমা প্রদর্শনীর করপোরেট চেইন এএমসির উদ্যোগে নির্মিত প্রেক্ষাগৃহে এই প্রদর্শনীর সূচনা অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে মোট ৫০০ জন আমন্ত্রিত দর্শক উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় সাধারণ মানুষ এই ছবি প্রেক্ষাগৃহে দেখার সুযোগ পেয়েছেন পয়লা মে থেকেই। এএমসির উদ্যোগে নির্মিত এই প্রেক্ষাগৃহে পরপর হলিউড ফিল্ম প্রদর্শিত হবে বলেও শোনা যাচ্ছে। রিয়াদের পাশাপাশি আগামী ৫ বছরের মধ্যে সৌদি আরবের ১৫টি শহরে ৪০টির বেশি প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করতে চলেছে এএমসি। এই বিষয়ে তাদের ছাড়পত্র দিয়েছে সৌদি আরবের সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়। তবে সরকারের পরিকল্পনা, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে গোটা দেশে ৩৫০টি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করে সেগুলোর ২০০০ স্ক্রিনে চলচ্চিত্র সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে।
তবে শুধুই হলিউড ফিল্মের প্রদর্শনী ও সম্প্রচার নয়, যাতে দেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারে, সেই লক্ষ্যেও এগোচ্ছে দেশটি। ৭১তম কান ফেস্টিভ্যালে সৌদি আরবের বেশ কিছু ইন্ডি-ফিল্ম ও শর্ট ফিল্ম প্রদর্শিত হয়, যা ইতিহাসে প্রথম। এ ছাড়া কান ফেস্টিভ্যালে সৌদি রাষ্ট্রের তরফে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, গোটা সৌদি আরবকে এখন থেকে চলচ্চিত্রশিল্প অথবা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির উপযুক্ত জায়গা হিসেবে তুলে ধরা হবে। চলচ্চিত্রশিল্পের প্রসারে কিছু অর্থনৈতিক রিবেট বা ছাড়ের ব্যবস্থা করছে সৌদি সরকার। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান, বাণিজ্য ও পর্যটনের মাধ্যমে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গ্রাফকে ওপরে নিয়ে যেতে চাইছে দেশটি।
কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরবের জেনারেল কালচারাল অথরিটির সিইও আহমেদ আল মাজিয়াদ। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, সৌদি আরব চাইছে সেই দেশে সুদৃঢ় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠুক। ফিল্ম তৈরির ক্ষেত্রে ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিশেষ রিবেটের কথাও সৌদি সরকার ঘোষণা করেছে। বিশ্বের ফিল্ম কোম্পানিগুলো যাতে সৌদি আরবে গিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, সে জন্যই এ ঘোষণা। এ ছাড়া সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ও ফিল্ম ইন্ডিপেন্ডেন্টের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। সৌদি আরবের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের চলচ্চিত্র নির্মাণের শিক্ষায় গড়ে তোলার জন্য এই চুক্তি। চলচ্চিত্র নির্মাণের শিক্ষায় উৎসাহিত করতে মেয়েদের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত স্কলারশিপ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে সৌদি আরবের জেনারেল কালচারাল অথরিটি। আহমেদ আল মাজিয়াদ জানিয়েছেন, তাদের কালচারাল এজেন্সিতে শিল্পকলা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যারা যুক্ত রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ কর্মীই মহিলা।
এবারের কান ফেস্টিভ্যালে গোটা বিশ্বের ৮১ জন মহিলা চলচ্চিত্রীর সঙ্গে রেড কার্পেটে হাঁটেন সৌদি আরবের প্রথম মহিলা চলচ্চিত্রকার হাইফা আল মনসুর। পাঁচ বছর আগে হাইফাকে তাঁর নিজের দেশে লুকিয়ে ফিল্ম শুট করতে হয়েছিল। তাঁর প্রথম ছবিও নিজের দেশে মুক্তি পায়নি। কারণ, তখনো সৌদি আরবে সিনেমাজগৎ নিষিদ্ধ।
এবারের কান ফেস্টিভ্যালে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি নিয়ে এই ফেস্টিভ্যালে উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরবের ৩১ বছর বয়সী মহিলা পরিচালক মারম তাইবাহ। তাঁর ছবির নাম ‘ডোন্ট গো টু ফার’। মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জড এক আরব ব্যক্তি নিউইয়র্কের একটি সাবওয়েতে তার বোনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটি ন্যারেটিভকে কেন্দ্র করে এই ছবি। তাইবাহের বক্তব্য, ‘মানুষের যেমন বহু গল্প বলার আছে, তেমনি আমারও রয়েছে আমার নিজস্ব কিছু গল্প, যেগুলো সিনেমার মাধ্যমে আমি বলতে চাই।’ তাইবাহের মতো সৌদির নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের গল্প, পর্যবেক্ষণ, অনুভূতি ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এভাবেই হয়তো বিশ্বের সামনে তুলে ধরবেন অচিরেই। এমন আশা গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্র-অনুরাগী মানুষের। তবে সৌদি আরব যেভাবে ফিল্মকে কেন্দ্র করে ক্যাপিটালিজমের চর্চা শুরু করতে চলেছে, তা শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের পক্ষে কতটা কার্যকর হবে, সেই প্রশ্ন থাকছেই। কেননা, সিনেমা পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে তৈরি হওয়া একটি কমিউনিকেশন মিডিয়াম হলেও এটি শুধুই পুঁজির জয়গানের বিনোদননির্ভর না-ও হতে পারে। পৃথিবীর মূল্যবান ছবিগুলোর ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই বিনোদনের নয়, বরং তা নান্দনিকতার ও দার্শনিক গভীরতার। কিন্তু সৌদি দুনিয়া চায়, বিনোদনকে কেন্দ্র করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বড়সড় আকার ধারণ করুক। আর তাই হলিউড এখন তাদের প্রধান সঙ্গী। অবশ্য আমেরিকাও তো সৌদি রাষ্ট্রের অন্তরঙ্গ বন্ধু।
অতনু সিংহ
ছবি: ইন্টারনেট